আইনপ্রণেতার প্রতিষ্ঠানই ভঙ্গ করছে আইন


ইউএনভি ডেস্ক:

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন তৈরিতে জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন সীতাকুণ্ডের এমপি দিদারুল আলম। অথচ সেই আইন ভঙ্গ করেই এমপির মালিকানাধীন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড ‘মেসার্স তাসিন স্টিলস লিমিটেড’ প্রতিনিয়ত দূষণ ছড়াচ্ছে সাগরে। গত ১৯ আগস্ট পরিচালিত এক অভিযানে এমপির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসহ তিন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের বিরুদ্ধে সাগর দূষণ করার প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

অয়েল ওয়াটার সেপারেটর, ইনসিনেরেটর ও হেপা ফিটার অকার্যকর রেখে সাগর দূষণ করার অভিযোগও আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। দেওয়া হয়েছে তাদের নোটিশও। ১ সেপ্টেম্বর সশরীরে উপস্থিত হয়ে জবাব দিতে বলা হয়েছে অভিযুক্তদের। জবাব সন্তোষজনক না হলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা হতে পারে উভয়দণ্ড।

নোটিশ পাওয়া অপর দুই প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মাস্টার আবুল কাশেমের মালিকানাধীন ম্যাক করপোরেশন ও সিরাজ উদ-দৌলার মালিকানাধীন মেসার্স আর এ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, ‘সাগরে তেল ফেলার প্রমাণ পেয়েছে আমাদের পরিদর্শক টিম।

ঘটনাস্থলের ছবিও তুলে এনেছে তারা। তিন প্রতিষ্ঠানের মালিককে তাই সশরীরে হাজির হয়ে জবাব দিতে নোটিশ ইস্যু করেছি। জবাব সন্তোষজনক না হলে আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেব আমরা।’ এমপির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আগেও একাধিকবার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে সীতাকুণ্ডের এমপি দিদারুল আলম বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো নোটিশ আমি পাইনি।

আমার কোনো প্রতিষ্ঠান দূষণের সঙ্গে জড়িত নয়। সম্ভবত কোথাও ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।’ পরিবেশ দূষণের দায়ে আগেও তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই। দূষণ ছড়ানোর মতো কোনো জাহাজ কখনোই আমদানি করিনি আমরা।’ অভিযুক্ত আরেক প্রতিষ্ঠান ম্যাক করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাস্টার আবুল কাশেম বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন ইয়ার্ড পরিদর্শন করেছে বলে আমি শুনেছি। কিন্তু আমার নামে নোটিশ ইস্যু হয়েছে বলে শুনিনি। আসলে দূষণ ছড়ানোর মতো বড় কোনো জাহাজ নেই আমার ইয়ার্ডে।’ আর এ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সিরাজ উদ-দৌলার মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি টিম ১৯ আগস্ট সরেজমিনে ইয়ার্ড পরিদর্শন করে। ২০ আগস্ট তিন প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ ইস্যু করে অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন। তার স্বাক্ষরিত নোটিশে উল্লেখ আছে, ‘সরেজমিন পরিদর্শনকালে পরিবেশগত ছাড়পত্র/নবায়নের শর্ত ভঙ্গ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সরঞ্জাম অয়েল ওয়াটার সেপারেটর, ইনসিনেরেটর ও হেপা ফিটার অকার্যকর রেখে পরিশোধন ব্যতীত বর্জ্য তেল ড্রেনের মাধ্যমে সমুদ্রে ফেলে ইয়ার্ডের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা জানাতে নিজ নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ১ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টার মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সশরীরে উপস্থিত হয়ে জবাব দিতে বলা হয়েছে। এই জবাব সন্তোষজনক না হলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে সীতাকুণ্ডে গিয়ে ইয়ার্ড পরিদর্শন করেন কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শ্রীরূপ মজুমদার ও পরিদর্শক নুর হাসান সজীব।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলের সমুদ্রের পানিতে প্রায় সময় ভাসতে দেখা যায় ছোপ ছোপ কালো তেল। আমদানি করা স্ট্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে নির্গত হয় এই দূষিত তেল। নিয়ম না মেনে জাহাজ কাটার ফলে এসব তরল বর্জ্য সমুদ্রের পানিতে মিশে সর্বনাশ করছে উপকূলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের। স্ট্ক্র্যাপ জাহাজের তরল এবং কঠিন বর্জ্য (এসবাসটস) দূষণমুক্ত করতে প্রতিটি ইয়ার্ডে রয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি।

কিন্তু খরচ বাঁচাতে এসব যন্ত্র ব্যবহার করেন না ইয়ার্ড মালিকরা। শুধু তাই নয়, জাহাজ কাটার সময় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দূষণ রোধের অধিকাংশ নিয়মনীতিও মানছেন না তারা। এজন্য বিভিন্ন ইয়ার্ডকে গত এক বছরে প্রায় ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। তারপরও ঠেকানো যাচ্ছে না দূষণ।

সীতাকুণ্ডের শীলপুরের চৌধুরী ঘাটায় অবস্থিত সিকো স্টিল ও এনআই ট্রেডার্স নামক ইয়ার্ড দুটি পুরোনো জাহাজ ভাঙার ছাড়পত্র নিয়ে সেখানে নতুন জাহাজ নির্মাণ করছিল। গত ২০ মার্চ সরেজমিনে পরিদর্শন করে এর সত্যতা মেলে।

একই এলাকায় সাগরিকা শিপ ইয়ার্ডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও অকার্যকর পাওয়া যায়। শুনানি শেষে তাই পরিবেশগত ছাড়পত্রের শর্তভঙ্গ এবং অনুমোদন ছাড়া জাহাজ নির্মাণ করে পরিবেশের ক্ষতিসাধন করায় সিকো স্টিলকে ১০ লাখ, এনআই ট্রেডার্সকে পাঁচ লাখ এবং সাগরিকা শিপ ব্রেকিংকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

এর আগেও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে এইচ এম শিপিং ইয়ার্ডকে ৮০ হাজার টাকা, জাহানাবাদ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডকে ৬০ হাজার টাকা, এসএনটি শিপ রিসাইক্লিংকে ৬০ হাজার টাকা, কদমরসুল স্টিল শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডকে ৫০ হাজার টাকা, খাজা শিপ ব্রেকিংকে পাঁচ লাখ টাকা, এসএল শিপ রিসাইক্লিংকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

বার বার জরিমানা করেও দূষণ ঠেকাতে না পারায় ক্রমশ ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তর একযোগে ১৩টি শিপ ইয়ার্ডেও অভিযান চালায় অতীতে। এই অভিযানে পিএইচপি এবং প্রাইম ছাড়া বাকি ১১টি শিপ ইয়ার্ডকে নিয়ম মেনে কাজ করতে দেখা যায়নি।

জানতে চাইলে শিপ ব্রেকিং এনজিও প্ল্যাটফর্ম অব বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মদ আলী শাহীন বলেন, সরকারি সংস্থার পাশাপাশি তারাও ইয়ার্ড মালিকদের নিয়ম মেনে জাহাজ কাটার জন্য বারবার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু ইয়ার্ড মালিকরা এসব অনুরোধে কর্ণপাত করেন না।

শিপ ইয়ার্ডগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে অয়েল ওয়াটার সেপারেশন প্লান্ট, ইনসিনারেটর, হেপা ফিটার থাকলেও খরচ কমাতে তা ব্যবহার করেন না মালিকরা। এজন্য প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে সাগর। প্রসঙ্গত, দেড় শতাধিক ইয়ার্ড থাকলেও কাগজে-কলমে সীতাকুণ্ডে ইয়ার্ড আছে ৮১টি। তবে এখন সচল থাকা ইয়ার্ডের সংখ্যা এরও অর্ধেক।


শর্টলিংকঃ