উদ্ধার ৯০ হাজার পিস ইয়াবা গায়েব


ইউএনভি ডেস্ক:

গাজীপুরের টঙ্গীর অন্যতম শীর্ষ মাদক কারবারি শাহিদা বেগমকে এক লাখ পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারে ১০ হাজার পিস ইয়াবা দেখানো হয়। এক ঘটনাতেই ৯০ হাজার পিস ইয়াবা গায়েব হয়ে যায়। আবার টঙ্গীর মধ্যপাড়ার বাসা থেকে তাকে (শাহিদা) আটক করা হলেও এজাহারে ঘটনাস্থল বদলে হয়ে যায় ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার সাতরাস্তা মোড়।

সাক্ষী দুজনও ভুয়া। এরমধ্যে একজন অস্ত্র মামলার আসামি। এমনকি ইয়াবার মূল মালিক ছাত্রলীগের সাবেক নেতা রেজাউল করিমকে আসামি করা হয়নি। এছাড়া মামলায় শাহিদার সঙ্গে মাদক কারবারি শাকিলকে পলাতক দেখিয়ে আসামি করা হয়। সঠিক নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় চার্জশিট থেকে তার নামও বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে সেই শাকিলেরও সন্ধান পাওয়া গেছে। যুগান্তরের অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, মামলার তদন্তে ইয়াবার মালিক রেজাউলের সম্পৃক্ততা পাননি তদন্ত কর্মকর্তা। ইয়াবা উদ্ধার কম দেখিয়ে চালান দেওয়া, ইয়াবার প্রকৃত মালিকের নাম এজাহার ও চার্জশিট থেকে বাদ দিতে ৫২ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির ওই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও জোনাল টিমের তৎকালীন সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসাবে পদোন্নতি পেয়ে তিনি এখন এসপিবিএন-এ কর্মরত। মামলার বাদী এসআই শাহাব উদ্দিন এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই জামিনুর রহমান। টাকা লেনদেনের সঙ্গে এসআই জুলফিকারুল ইসলাম জড়িত ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আর গায়েব হওয়া ৯০ হাজার পিস ইয়াবার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় দুই কোটি ৭০ লাখ টাকা।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, প্রায় ১৯ মাস কারাভোগের পর অক্টোবরে জামিনে মুক্ত হন শাহিদা। মুক্ত হওয়ার পর রেজাউলের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। তাদের মোবাইল ফোনে দীর্ঘ কথোপকথনের একাধিক অডিও এখন পুলিশের হাতে। এসব অডিও রেকর্ড যুগান্তরের কাছেও সংরক্ষিত আছে। দু’জনের কথোপকথনে ডিবির অভিযান এবং এক লাখ পিস ইয়াবার বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে। এসব অডিও রেকর্ডের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামে গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) দক্ষিণ বিভাগ। ২৭ এপ্রিল ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল করিমকে ৫০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে পুলিশ।

জিএমপির দক্ষিণ বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ যুগান্তরকে বলেন, ওই ভয়েস রেকডিং শাহিদা ও রেজাউলের। ভয়েস রেকর্ডিংয়ের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নেমে রেজাউলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শাহিদা ও তার স্বামী তাজুল ইসলাম জানান, তাদের ছেলে মো. জয়ের মোবাইল ফোনে ভয়েস রেকর্ডিং করা হয়। রেজাউল ও শাহিদার কথোপকথনে জানা যায়, ২০১৯ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি ভারতে যান রেজাউল।

যাওয়ার আগে তিনি এক লাখ পিস ইয়াবা বিক্রির জন্য শাহিদার কাছে রেখে যান। ওই ইয়াবা শাহিদা টঙ্গী মধ্যপাড়ার বাড়িতে রাখেন। ডিবি তার ওই বাড়িতে অভিযান চালায়। এ সময় ডিবি কর্মকর্তারা শাহিদাকে জানান, তার ঘরে এক লাখ পিস ইয়াবা আছে এবং এ ইয়াবার মালিক রেজাউল। তারা বলেন, ‘রেজাউলের মাল কোথায়’। তারা মারধর ও ঘর ভাঙচুর করে। শাহিদার ভাষ্য, ডিবি পুলিশ নিশ্চিতভাবে জেনেই অভিযান চালায়। কার ইয়াবা ও কোথায় আছে। এমনকি কোন গাড়িতে করে ইয়াবা এসেছে এবং কে গাড়িচালক ছিলেন সেটাও বলেছিল পুলিশ।

কথোপকথনে উঠে আসে- শাহিদাকে ছেড়ে দেবে বলে তার স্বামী তাজুল ইসলামের কাছ থেকে প্রথম দফায় সাড়ে ১৯ লাখ টাকা নেয় পুলিশ। স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক রেখে এবং ঋণ করে ডিবিকে মোট ৩২ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ঘটনার সময় রেজাউল ভারতে ছিলেন। এ সময় রেজাউলের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসআই জুলফিকারুল ইসলাম (জুলফিকার) বলেন, শাহিদাকে ‘ক্রসফায়ার’ দেওয়া হবে। মামলায় আপনার নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। শাহিদাকে ছেড়ে দেওয়া এবং মামলায় তার (রেজাউল) নাম বাদ দেওয়া হবে বলে তখন রেজাউলের সঙ্গে এসআই জুলফিকারের ২০ লাখ টাকায় রফা হয়। রেজাউল তার পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে ঢাকার মহাখালীতে প্রথম দফায় জুলফিকারকে ১০ লাখ টাকা দেন। রেজাউল দেশে ফিরে দুদফায় তাকে আরও ১০ লাখ টাকা দেন।

রেজাউল জানান, তিনি যখন এসআই জুলফিকারের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তাকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো কোনো কনস্টেবল তাকে ফোন করেছেন। তখন ওভারফোনে তাকে রেখে জুলফিকার হেফাজতে থাকা শাহিদাকে জিজ্ঞাসা করেন এ ইয়াবা কার, রেজাউল কে? তখন শাহিদা বলেন, ‘রেজাউলের মাল।

তিনি অনেক বড় নেতা।’ তখন তিনি বিশ্বাস করেন, টাকা না দিলে সমস্যা হবে। এ কারণেই তিনি টাকা দিতে রাজি হন। কথোপকথনের একপর্যায়ে রেজাউল বলেন, ওই এক লাখ পিস ইয়াবা তিনি বাকিতে এনেছিলেন। ইয়াবা বিক্রি করে টাকা দেওয়ার কথা ছিল। যারা বাকি দিয়েছিল তারা তাকে খুঁজছে বলেও তিনি দাবি করেন। গ্রেফতার হওয়ার আগে রেজাউল যুগান্তরকে বলেন, তিনি আগে মাদক ব্যবসা করতেন। তবে ওমরা করে আসার পর তিনি মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।

মোবাইল ফোনে শাহিদা যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রলীগ নেতা রেজাউলের সঙ্গে তার কথোপকথনের রেকর্ডিং সঠিক। ভারতে যাওয়ার আগে বিক্রি করার জন্য রেজাউল এক লাখ পিস ইয়াবা তার কাছে দেন। টঙ্গী থেকে তাকে ধরে নিয়ে ৪ দিন আটকে রাখে ডিবি পুলিশ। মাদক কারবারে তার সহযোগীদের নাম জানতে ইলেকট্রিক শকও দেওয়া হয়। তিনি বলেন, শত শত মানুষ দেখেছেন- টঙ্গীর বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়েছে। বাসা থেকে এক লাখ পিস ইয়াবা পেলেও ঢাকায় নিয়ে ১০ হাজার পিস ইয়াবা দিয়ে মামলা দেওয়া হয়।

শাহিদার স্বামী তাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শাহিদাকে টঙ্গীর বাসা থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এ সময় তার সঙ্গে থাকা সব স্বর্ণালঙ্কারও কেড়ে নেওয়া হয়। অডিও রেকর্ডিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার ছেলে জয় রেকর্ডিং চালু করে শাহিদার সঙ্গে রেজাউলের কথা বলিয়ে দেন। বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে আসামিদের সুবিধা দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে ডিবির এসআই জুলফিকার যুগান্তরকে বলেন, টাকা নেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। রেজাউলকে তিনি চেনেন না বলেও দাবি করেন। আসামি সংক্ষুব্ধ হয়ে অনেক কিছুই বলতে পারেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়- টিম লিডার শিবলী নোমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে পরিদর্শক আব্দুল মতিন, পরিদর্শক মাজেদুল ইসলাম, এসআই জুলফিকারুল ইসলাম, এএসআই আনোয়ার হোসেন, এএসআই মো. ইমরান আলী, এএসআই মিজানুর রহমান, এএসআই আবুল মুনসুর, কনস্টেবল এজিএম শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সিরাজুল ইসলাম অংশ নেন। জব্দ তালিকা তৈরি ও জব্দ তালিকায় সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেন মামলার বাদী এসআই শাহাব উদ্দিন।

ভিন্ন ঘটনাস্থল, ভুয়া সাক্ষী এবং ইয়াবা কম দেখিয়ে মামলা করা সম্পর্কে তিনি বলেন, তার কিছুই মনে নেই। তিনি এখন ডিবিতে নেই। এ কারণে তার এ বিষয়ে জানারও কোনো সুযোগ নেই। অভিযানের নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা এবং টিম লিডার শিবলী নোমান যুগান্তরকে বলেন, ইয়াবা কম দেখানো, ঘটনাস্থল ভিন্ন দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। এখানে কোনো ধরনের আইনের ব্যত্যয় হয়নি। এ বিষয়ে আপনি আসামির সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আর জব্দ তালিকার বিষয়ে যিনি জব্দ তালিকা করেছেন তিনি বলতে পারেন।

প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শাকিল : মামলার দুই নম্বর আসামি মো. শাকিলকে খুঁজে পায়নি পুলিশ। এমনকি তার সঠিক নাম-ঠিকানাও পায়নি তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তবে যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে- এজাহারে উল্লেখ করা শাকিলের প্রকৃত নাম মুরাদ শাকিল। স্থানীয়রা জানান, মুরাদ শাকিল টঙ্গীর নোয়াগাঁও এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারি।

এলাকায় তিনি একটি লাল গাড়িতে ঘুরে বেড়ান। ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। এলাকায় তিনি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। মামলার চার্জশিটের বিষয়ে ডিবির তেজগাঁও জোনাল টিমের বর্তমান এডিসি শাহাদাত হোসেন সুমা যুগান্তরকে বলেন, চার্জশিটটি অনেক আগে দেওয়া হয়েছে। তখন তিনি ওই টিমের দায়িত্বে ছিলেন না। খোঁজ নিয়ে তিনি জানান, চার্জশিটে একজনকে (শাহিদা) আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামির বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি বলে তাকে আসামি করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ভালো বলতে পারবেন।

মুরাদ শাকিল সম্পর্কে শাহিদা বলেন, মামলার এজাহারে শাকিলের নাম পুলিশ দিয়ে দেয়। তবে কি কারণে আবার চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে তা তিনি জানেন না। মুরাদ শাকিল যুগান্তরকে বলেন, ওই মামলায় তাকে আসামি করা হয়নি। এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে তার দাবি। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জামিনুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মামলার বাদী ঠিকানা দিতে পারেননি বলে তিনি আসামিকে শনাক্ত করতে পারেননি।

তদন্ত করেছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসামির রিমান্ড মঞ্জুর না হওয়ায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। তাই বিস্তারিত তথ্য জানাও সম্ভব হয়নি। তবে শাহিদা যুগান্তরকে বলেন, ডিবি পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড চায়। দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে তাকে নির্যাতন করা হয়। অসুস্থ হয়ে পড়লে একদিন পরেই তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ডিবির তৎকালীন সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান বলেন, ২০১৯ সালের ২০ মার্চ ডিবি থেকে বদলি হয়ে তিনি ডিএমপির মোহাম্মদপুর জোনে চলে যান। চার্জশিট পরে দেওয়া হয়। এ কারণে তিনি আসামির নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে কিছুই জানেন না।

মামলার ভুয়া সাক্ষী : যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে- এ মামলার দুজন সাক্ষীর দুজনই ভুয়া। আকরাম হোসেন নামে এক সাক্ষী তেজগাঁও ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় পুলিশের সোর্স। অস্ত্র মামলায় তিনি দীর্ঘদিন জেলও খেটেছেন। এজাহারে তার ঠিকানা দেওয়া হয় তেজগাঁও ফকিরনিবাজার ওভারব্রিজ বস্তি।

সেখানে গিয়ে দেখা যায়- মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য ওই বস্তি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তবে ওই এলাকায় পুলিশের সোর্স হিসাবে আকরামকে সবাই চেনেন। মাদক কারবারি শাহিদার বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, তিনি ওই মামলার সাক্ষী নন। বাবার নাম এবং স্থায়ী ঠিকানার কথা জানালে তিনি বলেন, পুলিশ তাকে সাক্ষী হিসাবে স্বাক্ষর করতে বলেছে। এ কারণে তিনি স্বাক্ষর করেছেন। ইয়াবার বিষয়ে কিছুই জানেন না। তিনি আরও জানান, ডিবি পুলিশ মিন্টো রোডে ডেকে নিয়ে জব্দ তালিকায় তার স্বাক্ষর নেয়। একপর্যায়ে তিনি বলেন, অপর সাক্ষী বাবুলও তার লোক। আসামি যদি তাকে কিছু খরচ দেন তবে আদালতে গিয়ে তিনি বলবেন, পুলিশ তাকে জোর করে সাক্ষী বানিয়েছে। তিনি কিছুই জানেন না। তবে বাবুলকে ওই এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাক্ষী আকরাম হোসেন জানান, বাবুলকে সাক্ষ্য দিতে তিনিই নিয়ে গিয়েছিলেন।

ভুয়া সাক্ষীর বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা শিবলী নোমান বলেন, মামলার বাদী এবং জব্দ তালিকা যারা করেছেন তারা এ বিষয়ে বলতে পারবেন। মামলার বাদী এসআই শাহাব উদ্দিনকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে প্রশিক্ষণে আছেন জানিয়ে বলেন, তিনি কিছুতেই ঘটনাটি মনে করতে পারছেন না।


শর্টলিংকঃ