একুয়েডর কি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চকোলেটের আঁতুড়ঘর?


কলম্বিয়ার পার্শ্ববর্তী একুয়েডরের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত ইসমেরাল্ডাস প্রদেশের কৃষকরা গর্বের সঙ্গে বলে থাকেন তারা ‘ব্ল্যাক গোল্ড’ উৎপাদন করেন। তারা অবশ্য তেলের কথা না বরং বলছেন কোকো বীজের কথা। একুয়েডরের প্রধান রফতানিযোগ্য পণ্য। কোকো থেকে পাওয়া মসৃণ ও তেতো স্বাদযুক্ত বিন বা বীজের মিশ্রণ চকোলেট তৈরির মূল উপাদান। অ্যান্ডিয়ান রাষ্ট্রগুলোর একটি একুয়েডরের খ্যাতির অন্যতম অনুষঙ্গও এটি।

একুয়েডরের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এ কোকো। বিংশ শতাব্দী শুরুর আগে একুয়েডর ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোকো রফতানিকারক রাষ্ট্র। জটিল উদ্ভিদ রোগ এবং আফ্রিকা ও এশিয়ায় ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে কোকো চাষ হওয়ার ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে একুয়েডর তার শীর্ষস্থান হারাতে থাকে।

কোকো তার আকর্ষণ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। কৃষকরা কলা ও কফি চাষের প্রতি ঝুঁকতে থাকেন, যা তত্কালীন সময়ে বেশ আকর্ষণীয় হতে শুরু করে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো কোকো উৎপাদন ও রফতানিতে শীর্ষস্থান অর্জন করে। ‘বাল্ক’ অথবা ‘অর্ডিনারি’ বিন চাষে তাদের বিশেষ দক্ষতা রয়েছে, যা প্রক্রিয়াজাত চকোলেট স্বাদের ক্যান্ডি ও মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহূত হতো।

পুরনো ঐতিহ্যবাহী চকোলেট

গরমেট চকোলেট উৎপাদনে উন্নতমানের জাত হিসেবে ‘ফাইন’ অথবা ‘ফ্লেভার’ বিন ব্যবহূত হয় অধিকতর স্বাদের জন্য। বিশ্বের সর্বমোট কোকো উৎপাদনের যা মাত্র ৫ শতাংশ এবং এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অনেকটা ওয়াইনের মতোই চকোলেট কোন অঞ্চলে উত্পন্ন হয়েছে ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে, সেটা স্বাদের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে।

গত এক দশকে বিভিন্ন স্বাদের কোকো উৎপাদনের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে, ভালো মানের কোকো রফতানিকারক হিসেবে একুয়েডরের উত্থান লক্ষণীয়। চকোলেটপ্রেমীদের পছন্দের দর্শনস্থল হিসেবে একুয়েডরের চাহিদা বাড়ছে। পাশাপাশি একুয়েডরের চাষীদের কাছে টেকসই আয়ের উৎস হিসেবেও কোকো চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ষাটোর্ধ্ব কৃষক ইগ্নাসিও এস্তুপিনান, যিনি স্থানীয়ভাবে ডন নাচো হিসেবেও পরিচিত, কোকো চাষ সম্পর্কে বলেন, ‘আগে চাষীরা কোকো উৎপাদনে তেমন মনোযোগ দিতেন না।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখন সবাই জানে কোকো কতটা মূল্যবান। এটাই শ্রেষ্ঠ ব্যবসা।’

এ বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান রাখেন এমন পণ্ডিতরা মনে করেন কোকো প্রথম জন্মেছিল অ্যামাজন অববাহিকায়। বর্তমানে তা ভেনিজুয়েলা নামে পরিচিত এবং বর্তমানেও দেশটি কোকোর অন্যতম বৃহৎ রফতানিকারক। তবে সাম্প্রতিক এক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় বলা হয়েছে, একুয়েডর কোকো উৎপাদনের আঁতুড়ঘর হতে পারে।

প্রত্নতত্ত্ববিদ ফ্রান্সিস্কো ভালদেজ ৩,৩০০ খ্রিস্টপূর্বের একটি সিরামিকের ধ্বংসাবশেষের আণুবীক্ষণিক অবশিষ্টাংশ থেকে কোকোর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। এ আবিষ্কার থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে একুয়েডরের দক্ষিণে অবস্থিত অ্যামাজন অববাহিকার জামোরা চিনচিপে অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেও কোকো চাষ করা ও খাওয়া হতো।

চকোলেটের প্রতি পশ্চিমাদের আকর্ষণ তৈরি হয় অনেক পরে ষোড়শ শতাব্দীতে যখন অ্যাজটেক শাসক মন্টেজুমা স্প্যানিশ বিজয়ী হের্নান কর্তেজকে ঝালযুক্ত চকোলেট পানীয় ‘জোকোলাটল’-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কোকোর মিশ্রণে চিনি যুক্ত করা হলে পানীয়টি ইউরোপে অভিনব হয়ে ওঠে এবং চাহিদা অনেক বেড়ে যায়।

পশ্চিমে চকোলেটকে জনপ্রিয় করে তুলতে একুয়েডরের বিশেষ ভূমিকা আছে। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য স্প্যানিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বর্ণ ও রৌপ্যের প্রাচুর্য ছিল বলে কিন্তু একুয়েডরে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কোকোর কারণে।

একুয়েডরের স্থানীয় কোকো বিন পরিচিত ‘নাকিওনাল’ অথবা ‘আরিবা’ নামে। ধারণা করা হয়, নামগুলো এসেছিল কোকোর উত্পত্তিস্থল থেকে। আরিবার অর্থ ‘নদীর উজান’ এবং তত্কালীন কোকো বাগানগুলো গুয়াওস নদীর পাড় ঘেঁষে অবস্থিত ছিল এবং একুয়েডরের বৃহৎ শহর গুয়াওকুইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

উন্নত মান

সারা জেন ইভান্স, যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় ফুড ব্লগার এবং একাডেমি অব চকোলেটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, তার বই ‘চকোলেট আনর্যাপড’-এ বলেছেন, ‘একুয়েডরের কোকো অনেকটা ফুলেল আবরণে ঝাল ও কৃষ্ণাঙ্গ মিশ্রিত স্বাদ।’ চকোলেটের স্বাদ পরীক্ষা করেন এমন অনেকেই একুয়েডরের কোকোর স্বাদকে মিশ্রিত বলেছেন। কেননা এ অঞ্চলের কোকোর স্বাদ আসলে নির্ভর করে কোন অঞ্চলে সেই কোকোর চাষ হয়েছে তার ওপর।

একুয়েডরের সফল অর্গানিক চকোলেট ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সান্তিয়াগো পেরাল্টা বলেন, ‘প্রতিটি কোকো বিনের স্বাদ ভিন্ন ও বিশেষ ধরনের।’ তিনি আরো বলেন, একুয়েডরের চকোলেটের মানের তারতম্যের অন্যতম কারণ নিরক্ষীয় অঞ্চলের ভূখণ্ডের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য। একুয়েডরিয়ান চকোলেটের স্বাদকে অনেকটাই ফলের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কেননা কিছু কোকোর স্বাদ ফলের মতো আবার কিছু বাদামের মতো। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চকোলেট তৈরি করি ঠিক যে ধরনের কোকো বিন আমরা পাই সে রকম।’ তিনি আরো বলেন, নতুন কোকো বিনের ব্যাচ আসামাত্র আমি তা খেয়ে দেখি। একুয়েডরের কোকো চাষের সাফল্যের গল্পের পেছনে পেরাল্টার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ‘২৫০ বছর ধরে কোকো রফতানি করলেও একুয়েডরের মানুষ জানত না চকোলেট কীভাবে তৈরি করতে হয়।’

২০০২ সালে পেরাল্টা ও তার স্ত্রী কারলা বারবোটো পুরনো কোকো গাছ খুঁজতে থাকেন এবং একই সাথে চাষীদের জন্য ‘বেটার পে ফর বেটার প্রডাক্ট’ নামে একটি ফেয়ার ট্রেড মডেল তৈরির কাজও করছিলেন। তাদের এ পরীক্ষামূলক গবেষণা কাজ করেছিল। তার চকোলেট কোম্পানিটি ২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল চকোলেট অ্যাওয়ার্ডসে কয়েকটি পুরস্কার জিতেছিল স্বাদের সংমিশ্রণ এবং একটি সফল বিকল্প ব্যবসায়ের মডেল প্রদানের জন্য। পাকারির একটি র-চকোলেটকে বলা হয়েছিল বিশ্বের সেরা ‘ডার্ক প্লেইন’ বার চকোলেট। একুয়েডরিয়ান চকোলেট কোম্পানিটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। একুয়েডরিয়ান কোম্পানিগুলো এরপর থেকে নিজেরা চকোলেট উৎপাদন করতে শুরু করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চকোলেট কোম্পানিগুলো একুয়েডর থেকে স্থানীয় কোকো বিন সংগ্রহ করার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে চকোলেট বার উৎপাদন করেছে।

স্থানীয় গৌরব

নিউইয়র্কভিত্তিক রেড থালহামার কোকো উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশ ঘুরে শেষ পর্যন্ত একুয়েডরকে বাছাই করেছিল। অস্ট্রিয়ান নারী থালহামার গরমেট খাবার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তিনি তার এ ব্যবসা ছেড়ে চকোলেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হতে চাননি। কিন্তু তিনি বলেন, ‘একুয়েডরের কোকোর মান ছিল সর্বোত্তম।’ পরে তিনি তার নিজস্ব চকোলেট ব্র্যান্ড ‘অ্যান্টিডট চকো’ বাজারে নিয়ে আসেন, যা একুয়েডরেই প্রস্তুত হতো।

অনেকেই একইভাবে চকোলেট উৎপাদন করেছে। ‘একুওটোরিয়ানা দ্য চকোলেটস’ ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি চকোলেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, যারা বিন চাষ থেকে শুরু করে চকোলেট প্রস্তুতের কাজ করত একটি জায়গায়।

ইসমেরাল্ডাস একুয়েডরের একটি অন্যতম দরিদ্র একটি প্রদেশ, যেখানে চাষীরা উন্নতমানের কোকো চাষ করে তাদের দারিদ্র্য নিবারণ করতে পারেন। ইসমেরাল্ডাসের একজন সামাজিক কর্মকর্তা ডায়সি রড্রিগেজ বলেন, ‘এখানে একসময় শুধু কোকো উৎপাদন করা হতো আর এখন বিশ্বের সেরা চকোলেট প্রস্তুত হয়। এখন আমাদের গর্ব হয়।’

ডন নাচো তার ফার্মে পঞ্চাশোর্ধ্ব কোকো গাছের দেখাশোনা করেন। তিনি তার নিজস্ব ফার্মে কাজ করেন, যার আয়তন ৬০ হেক্টর। সেখানে তিনি ৩০ ধরনের বিভিন্ন ফলের সঙ্গে কোকোর চাষও করেন। তিনি বয়সের ভারে অনেকটা ক্লান্ত হলেও একুয়েডরের কোকো ও তার ভবিষ্যতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনেক ভাবেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক কঠোর পরিশ্রম করতে হবে দেশের বাইরে নিজের দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে।’

একুয়েডরের নতুন ‘ব্ল্যাক গোল্ড’ হয়তো স্থানীয় চাষীদের একটি নির্ভরযোগ্য ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার পাশাপাশি চকোলেটের মানচিত্রে দেশটিকে আবারো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবে।

 

বিবিসি


শর্টলিংকঃ