একে একে খুলছে পর্যটনের দুয়ার


ইউএনভি ডেস্ক:

কাজী জারিন তাসনিম নুহা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে ১৭ মার্চ থেকে দেশের অন্যসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো তার স্কুলও বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় নুহার ‘গৃহবন্দি’ জীবন।

ছোট ভাই ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিপড়ূয়া ফাইয়াজ রহমানকে নিয়ে প্রথম দিকে বেশ আনন্দেই দিন কাটে নুহার। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘতর হওয়ায় দিনে দিনে বিষিয়ে ওঠে তাদের ‘বন্দিজীবন’। তবে প্রায় পাঁচ মাস পর মুক্তি মিলেছে তাদের। বাবা-মায়ের হাত ধরে ছুটে গেছে প্রকৃতির কোলে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে ভুলতে চাইছে কষ্টের দিনগুলো।

নুহা-ফাইয়াজের মতো অনেক শিশু-কিশোরই ঘরবন্দি করোনা পরিস্থিতির কারণে। ইট-পাথরে ঘেরা শহরে ঘরের বাইরেও পা রাখতে না পারায় দমবন্ধ অবস্থা তাদের। একই সময় বন্ধ ছিল দেশের পর্যটন স্পটগুলোও। তাই সাধ থাকলেও শহর থেকে দূরে কোথাও ঢুঁ মারার সাধ্য ছিল না কারও। অবশেষে আগস্টের শুরু থেকে একে একে খুলতে শুরু করেছে পর্যটনের সব দুয়ার। সাগর, পাহাড়, সবুজ প্রকৃতির স্পর্শে গিয়ে দম ফেলতে শুরু হয়েছে শহরবাসীর দৌড়।

নুহার বাবা ব্যবসায়ী কাজী মাহাবুবুর রহমান বলছিলেন, ‘পাঁচ মাসকে পাঁচ যুগের মতো মনে হয়েছে। অঘোষিত লকডাউনের মধ্যে বাচ্চাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সমুদ্রের খুব কাছে গিয়ে মনটা হালকা হয়ে গেছে। ওরা খুব আনন্দ করেছে।’

আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ আগস্ট খুলে দেওয়া হয় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এবং সেখানকার হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টগুলো। তবে ঈদুল আজহার পর থেকেই সৈকতে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়। মাহাবুবুর রহমান স্ত্রী নুরুন নাহার ও দুই সন্তানকে নিয়ে সৈকত ভ্রমণে যান ১২ আগস্ট। তিনি জানান, এর আগে আটবার কক্সবাজার সৈকতকে কাছ থেকে দেখেছেন। কখনও এমন শান্ত-স্নিগ্ধ, নিরিবিলি পরিবেশ দেখেননি। স্বচ্ছ পানি আর মেরিন ড্রাইভ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে অপরূপ প্রকৃতি দেখে তারা ভুলেই গিয়েছিলেন পেছনের দিনগুলোতে রেখে এসেছেন করোনার ভয়ংকর পরিস্থিতি।

দেড় মাস আগে খুলে দেওয়া হয়েছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার এ সৈকতও প্রাণ ফিরে পেয়েছে হাজারো প্রাণের মেলায়। কক্সবাজারে হোটেল-মোটেল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় সৈকতপ্রেমীদের দৌড় ছিল কুয়াকাটার দিকে। তবে করোনা সংক্রমণ এড়াতে পর্যটকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রয়েছে বলে জানান কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক।

সমুদ্রের তুলনায় পাহাড়ে জনস্রোত কম। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি এবং সিলেটের পাহাড়ি পর্যটন স্পটগুলো তাই এখনও জমে ওঠেনি। বান্দরবানের পর্যটন স্পট এবং হোটেল-মোটেল খুলে দেওয়া হয়েছে গতকাল শুক্রবার। সেখানেও করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। খাগড়াছড়ির আলুটিলা, রিছাং ঝর্ণা, জেলা পরিষদ পার্ক, মায়াবিনী লেক, পানছড়ির অরণ্য কুঠিরসহ দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়েছে।

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ বলেন, আগস্টের শুরু থেকে পাহাড়ের হোটেল-মোটেল খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে পর্যটকের ভিড় আগের মতো নেই। তারপরও যারা আসছেন, তারা যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, সে বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেওয়া হয়নি। আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকায় টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলের বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে জনসাধারণের স্বাভাবিক যাতায়াতে ব্যবহূত ট্রলারে প্রায় প্রতিদিনই পর্যটকরা সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করছেন। সেখানকার হোটেল-মোটেলও মোটামুটি খোলা। যদিও পর্যটকের উপস্থিতি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম।

পাহাড়ি সৌন্দর্যের আরেক লীলাভূমি সিলেট। এখানে রয়েছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সোয়াম্প ফরেস্ট ‘রাতারগুল’। সীমান্তে মেঘের খেলা দেখার জন্য আছে বিছনাকান্দি, ঝর্ণাধারায় মন হারাতে জাফলং এবং সবুজাচ্ছাদিত মনোরম পরিবেশের চা বাগান লালাখাল ঘিরে। এসব পর্যটন স্পটেও পর্যটকের আনাগোনা শুরু হয়েছে। তবে ভ্রমণপিয়াসীর ভিড় দেখা গেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের প্রায় সব পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে পর্যটক এবং পর্যটন শিল্পের সঙ্গে নিযুক্ত সব শ্রেণির মানুষ যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, সে ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট প্রশাসনকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।

ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, প্রায় পাঁচ মাস বন্ধ থাকায় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার জীবনযাপন করছিলেন। তারাও হতাশা কাটিয়ে পুনর্জাগরণের প্রত্যাশায়। শুধু কক্সবাজারেই ৩০ হাজারের বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছিলেন। করোনার ছোবলে দিশেহারা হয় শহরের সাড়ে চার শতাধিক আবাসিক হোটেল, ১৪০টিরও অধিক রেস্তোরাঁ, দুই শতাধিক ট্যুর অপারেটর অফিস।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম তীর্থস্থান সুন্দরবন, বগুড়ার মহাস্থানগড়, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, রামসাগর, কুমিল্লার ময়নামতিসহ দেশের নানা প্রান্তের পর্যটন স্পটগুলো ফের জাগছে। তবে এর সঙ্গে নতুন করে জাগছে পুরোনো শঙ্কা। বিভিন্ন স্থানে পর্যটকশূন্য পরিবেশে জেগে ওঠা প্রকৃতির রূপ আবারও হারিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা। বিশেষ করে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের একাধিক স্পটে ডলফিন, ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া এবং লতাগুল্মের মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা মন কেড়েছিল। নান্দনিক সৌন্দর্য ধরে রাখার উদ্যোগও নেওয়া হয় এ সময়। একটি এলাকা ঘেরাও করে পর্যটকদের প্রবেশ সীমাবদ্ধ করা হলেও বড় অংশ এখনও উন্মুক্ত।

কক্সবাজারে পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি। সংস্থার প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, লাল কাঁকড়া বা লতাগুল্ম সংরক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কার্যকর হয়নি। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং জেলা প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় লম্বা সময় পর্যটকশূন্য থাকার সুযোগও কাজে লাগানো যায়নি। ফলে পর্যটকের ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৈকতে জেগে ওঠা প্রকৃতি আবার হারিয়ে যেতে পারে।


শর্টলিংকঃ