চাঁপাইয়ের চরবাসীর জীবনধারা বদলে দিয়েছে শেখ হাসিনা সেতু


চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি :

“একটি সেতু চরবাসীর চিরদিনের ভোগান্তি লাঘব করে দিয়েছে। চর পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে বড় বড় ইটের বাড়ি তৈরি হচ্ছে। কেউ আর পৈত্রিক সম্পত্তি রেখে শহরমূখী হতে চাইছে না। চরের মানুষ এখন যেভাবে জীবনযাপন করছেন, তা শহরের চেয়ে খুব একটা কম নয়। তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজেই শহরে পৌঁছে দিতে পারছে।ভালো দামও মিলছে চরের চাষীদের।চরাঞ্চলের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায় সত্যিকার অর্থেই সেতুবন্ধন তৈরী করেছে এই সেতু।.. ”

চাঁপাইনবাবগঞ্জে মহানন্দা নদীর উপর নির্মিত শেখ হাসিনা সেতুতে দিনভর এমন ব্যস্ততা চোখে পড়ে। ছবি: তারেক রহমান।

পদ্মা, মহানন্দা ও পাগলা নদীবেষ্টিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলা। পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে উপজেলাটি গঠিত। যার মধ্যে ৭টি ইউনিয়নই চরাঞ্চলে অবস্থিত। এসব ইউনিয়নের বাসিন্দারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সবদিক থেকেই ছিল অবহেলিত। জেলা ও সদর উপজেলা শহরের সঙ্গে এখানকার বাসিন্দাদের যাতায়াতের মাধ্যম ছিলো গরুরগাড়ি ও নৌকা।

দুর্গম এলাকা হওয়ায় সেখানকার চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে দেখা মিলতো না চিকিৎসকদের। কেউ অসুস্থ হলে গরুরগাড়ি কিংবা বাঁশের খাটলিতে শুইয়ে নৌকায় নদী পার হয়ে সদর হাসপাতালে নিতে হতো। অধিকাংশ প্রসূতি নারী হাসপাতালে নেওয়ার সময় মাঝপথে সন্তান প্রসব করতো। ফলে মৃত্যু ঝুঁকি তাড়িয়ে বেড়াতো তাদের।

এছাড়া শিক্ষকদের যাতায়াত সমস্যায় পাঠদান ব্যাহত এবং কৃষি পণ্য বাজারে পরিবহন করতে না পেরে ফাড়িয়াদের কাছে কমমূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হতেন চরবাসীরা। নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ছিল উন্নয়ন বঞ্চনাও।

তবে ২০১৫ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর উপর শেখ হাসিনা সেতু নির্মিত হওয়ার পর থেকে বদলে গেছে চরবাসীর জীবনযাত্রার মান। সেতু নির্মাণের পাশাপাশি এলাকার রাস্তাঘাটও ব্যাপকভাবে পাকাকরণ করা হয়েছে। ফলে নদীর ওপারের বিচ্ছিন্ন থাকা ৭টি ইউনিয়নের মানুষ এখন সরাসরি জেলা ও সদর উপজেলার শহরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেতু নির্মাণের পর থেকে চরাঞ্চলের ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি থেকে ছোট-বড় যানবাহন চলাচল করছে। এখন কোন মানুষ অসুস্থ হলে ২০ থেকে ৩০ মিনিটরে মধ্যে সদর হাসপাতালে নেওয়া যায়। অটোরিকশা ভাড়া দূরত্ব অনুয়ায়ি মাত্র ২০ থেকে ৫০ টাকা। অনেক শিক্ষার্থী এখর বাড়ি থেকে শহরে এসে লেখাপড়া করছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর ওপর নির্মিত শেখ হাসিনা সেতু।

সরকারি চাকজীবিরাও এখন নিয়মিত চর এলকায় অফিস করছেন। এলাকার মানুষ শহরমুখী না হয়ে গ্রামেই পাকা ঘরবাড়ি করে বসবাস করছে। বিদ্যুৎ সুবিধাও চালু করা হয়েছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য অল্প খরচে শহরে এনে বিক্রি করতে পারছে। সদর উপজেলা ও জেলা সদরের সাথে মেলবন্ধন তৈরী করে দিয়েছে চরবাসীর শতশত বছরের স্বপ্নের একটি সেতু। তবে আলাতুলি ও নারায়নপুর ইউনিয়ন পদ্মার ওপারে হওয়ায়, এখনো ইউনিয়ন দু’টির মানুষের নাজুক অবস্থার খুব বেশি পরির্তন হয়নি।

জেলা প্রকৌশল দফতর সূত্র জানায়,  নামোশংকর বাটি জিসি হতে ধুলাউড়ি রাস্তায় মহানন্দা নদীর উপর সাহেবের ঘাটে ৫৪৬ দশমিক ৬০ মিটার লম্বা ও ৮ দশমিক ১০ মিটার প্রস্থের সেতুটি নির্মাণ ব্যয় হয় ৪৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। নকশা মোতাবেক এ সেতুতে ৪২ মিটার দৈর্ঘ্যরে স্প্যান রয়েছে ১৩টি, পাইল রয়েছে ১৬৫টি, প্রোটেকশনসহ এপ্রোচ রাস্তা ১ হাজার ৮৫০ মিটার।

এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় আরও ২টি সংযোগ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটির দৈর্ঘ্য ৪৫ মিটার ও অপরটি ৪৮ মিটার। উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়কে বৃহৎ সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এলজিইডি’র এটি সব চেয়ে বড় সাফল্য। সেতুটির নাম করণ করা হয় ‘শেখ হাসিনা সেতু’।

শেখ হাসিনা সেতুর প্রবেশমুখ।

২০১৫ সালের ১৬ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুটির উদ্বোধন করেন। সেদিন থেকেই চলাচলের জন্য সেতুটি খুলে দেওয়া হয়। ধীরেধীরে বদলে যেতে থাকে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান। সেতু নির্মাণের ফলে সুবিধাপ্রাপ্ত ইউনিয়নগুলো হলো- ইসলামপুর, দেবীনগর, শাহজাহানপুর, চরবাগডাঙ্গা, সুন্দরপুর ও চরঅনুপনগর।

চরবাসীরা জানান, একটি সেতু তাদের চিরদিনের ভোগান্তি লাঘব করে দিয়েছে। এলাকায় বড় বড় বাড়ি উঠেছে। কেউ আর এলাকা ছেড়ে শহরমূখি হতে চাইছেনা আগের মতো। এলাকার মানুষ এখন যে জীবন-যাপন করছেন, তা শহরের চেয়ে খুব একটা কম নয়। এখন, সাত ইউনিয়নে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজেই নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে শহরে। চরাঞ্চলের মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবায় সত্যিকার অর্থেই সেতুবন্ধন তৈরী করেছে এই সেতু।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আ.ন.ম ওয়াহেদুজ্জামান জানান, চরাঞ্চলের সঙ্গে জেলা শহরের যোগাযোগ স্থাপন করার জন্যই সেতুটি নির্মাণ করা হয় এবং সেতুটি নির্মাণের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছে।


শর্টলিংকঃ