তিন যুগ আগের মজুরি এখনও বহাল


ইউএনভি ডেস্ক:

পেঁয়াজ-রসুন কিংবা তেল-চিনির কথা বাদ। এক কেজি আলু ৫০ টাকা। মোটা চাল কিনতে লাগে ৬০ টাকা। গরুর মাংসের দাম ৮০০-৮৫০ টাকা। অথচ একুশ শতকেও বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের মাসিক মজুরি মাত্র ৭৯২ টাকা! অবিশ্বাস্য হলেও এটিই বাস্তবতা। পেট্রোল পাম্পের একজন শ্রমিক দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে মূল মজুরি (বেসিক) ৫৬০ টাকার সঙ্গে বাড়ি ভাড়া ১১২, চিকিৎসা ১০০ ও যাতায়াত ভাতা ২০ টাকা পেয়ে আসছেন।

শ্রম আইনে পাঁচ বছর অন্তর মজুরি পর্যালোচনার কথা। কিন্তু সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের ‘নিম্নতম মজুরি বোর্ড’ ১৯৮৭ সালে পেট্রোল পাম্প শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের পর থেকেই ঠুঁটো জগন্নাথ। শ্রমিকরা বারবার দাবি জানালেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি সভায় এখন পর্যন্ত মালিকপক্ষের কাউকে হাজির করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

মজুরি নিয়ে মহান মে দিবসের আগে গতকাল মঙ্গলবার ক্ষোভ প্রকাশ করলেন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের একটি পেট্রোল পাম্পের শ্রমিক সায়েদুল আরেফিন। সমকালকে তিনি বলেন, গার্মেন্টসহ সব খাতে কয়েক বছর পরপর মজুরি পুনর্নির্ধারণ করে সরকার। কিন্তু যুগের পর যুগ আমাদের প্রতি কারও নজর নেই। যা টাকা পাই, বাসা ভাড়াই দিতে পারি না। বেতন বাড়ানোর কথা বললেই মালিকরা ধমকান। সরকারের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে বলেন­, সরকারের নির্দেশনার বাইরে নাকি তাদের যাওয়ার সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে পেট্রোল পাম্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি নির্ধারণে গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি মাগুরা ফিলিং স্টেশনের মীর মোকছেদ আলী সমকালকে জানান, মজুরি বোর্ডের আহ্বানে তিনি কয়েকবার বৈঠকে গেছেন। একবারও মালিকপক্ষের প্রতিনিধি হাজির হননি। সর্বশেষ মাস দুয়েক আগেও বৈঠক হয়। সেদিনও মালিকপক্ষের কেউ আসেননি। প্রতিবারই ঢাকায় গিয়ে মজুরি বোর্ডের বৈঠকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়। মীর মোকছেদের অভিযোগ, নির্ধারিত মজুরি কাঠামো না থাকায় মালিকরা যাকে যত টাকা দিয়ে পারছেন, কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। মাগুরায় গড়ে তিন হাজার টাকা মাসিক বেতনে শ্রমিকরা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। জিনিসপত্রের যে দাম, তিন হাজার টাকায় এক সপ্তাহও চলে না। সরকারি সংস্থার গাফিলতিতে শ্রমিকদের ওপর জুলুম করছেন মালিকরা।

একাধিকবার যোগাযোগ করেও নিম্নতম মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি খুলনা বিভাগীয় পেট্রোল পাম্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ভৈরব ফুয়েল সাপ্লাইয়ের মালিক শেখ ফরহাদ হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

৩৭ বছর ধরে একই মজুরি ৭৯২ টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘মালিকপক্ষের অসহযোগিতায় ৩৭ বছরেও নতুন মজুরি নির্ধারণ করা যায়নি। পেট্রোল পাম্প শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে এ পর্যন্ত চারটি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এসব বোর্ডের বৈঠকে মালিকপক্ষের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত হন না। তারা পেট্রোল পাম্পকে শিল্পই স্বীকার করেন না।’ অবশ্য তিনি বলেন, ‘এভাবে আর চলতে পারে না। প্রতিকার চেয়ে গত সপ্তাহে শ্রম মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। তাদের নির্দেশনা পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ আগে কেন মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চাননি– প্রশ্নে সচিব বলেন, ‘আগে একবার হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছিল। তবে প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।’

মজুরি বোর্ডের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পেট্রোল পাম্পের চেয়েও কম মজুরি পান টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পের শ্রমিকরা– ৫২১ টাকা। সরকার ১৯৮২ সালে এ মজুরি নির্ধারণ করে। যদিও মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে জড়িত পেশাটি প্রায় বিলুপ্ত।

মজুরি বোর্ড সূত্র জানায়, সাধারণত শ্রমিক কিংবা অন্য কোনো পক্ষের চাপে সংশ্লিষ্ট শিল্পের জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। বোর্ড সব পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে মজুরি নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায়। এর ভিত্তিতে সরকার মজুরি নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করে। চাপ না এলে মজুরি বোর্ড গঠন করে না সরকার। শ্রমিকপক্ষের চাপ না থাকায় পেট্রোল পাম্পের মতো ১৬টি খাতে দীর্ঘদিন একই মজুরি চলছে। আয়ুর্বেদ কারখানায় সর্বশেষ মজুরি নির্ধারণ হয় ২০০৯ সালে। ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে ২০১০, কোল্ডস্টোরে ২০১২ এবং ২০১৩ সালে সিনেমা হল ও ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজে মজুরি নির্ধারণ করে সরকার। এসব খাতের ন্যূনতম মাসিক মজুরিও নামকাওয়াস্তে। সিনেমা হলে ২ হাজার ৬১০ এবং হোটেল-রেস্তোরাঁয় ৩ হাজার ৭১০ টাকা।

সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরিও বাস্তবায়ন করে না অনেক শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠান। শিল্পকারখানা, দোকানপাটসহ অন্যান্য কারখানার নিরাপত্তা এবং শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করে সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)। মজুরি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ও শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে প্রতিষ্ঠানটি গত এক বছর ১ হাজার ১৩১টি মামলা করেছে। সবচেয়ে বেশি ১৮৬টি মামলা হয়েছে পোশাকবহির্ভূত খাতে। পোশাক খাতের বিরুদ্ধে মামলা হয় মাত্র তিনটি। গত বছরের জুন পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত কারখানা, দোকান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮১ হাজার ৩০৪টি।

ডিআইএফইর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঘোষিত ন্যূনতম মজুরিও শতভাগ বাস্তবায়ন হয় না। শ্রমিকরা গত এক বছরে ৫ হাজার ৫৮১টি অভিযোগ দিলেও ২৫ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়নি।

৫৫ শিল্প খাতে নেই ন্যূনতম মজুরি

সিমেন্ট কারখানা, পোলট্রি খামার, সিরামিকস ও ব্যাটারি– এ চার শিল্প খাতকে মজুরি কাঠামোর আওতায় আনা হয়নি। এখানে মালিকপক্ষ যা দেন, তা মেনে নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এ বিষয়ে মজুরি বোর্ডের সচিব বলেন, ‘সিমেন্ট ও সিরামিকস শিল্পের বিষয়ে কাজ চলছে। ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে বর্তমানে ৪২টি শিল্প রয়েছে। বাকি দুটিও আনা হবে।’ ডিআইএফইর ওই কর্মকর্তা জানান, পরিদর্শনে তারা শ্রমসংক্রান্ত অনেক অনিয়ম পেয়েছেন। অনেক কারখানা ন্যূনতম মজুরি পরিশোধ করে না। তিনি আরও জানান, শিল্প ও সেবা মিলিয়ে ৫৫টি খাত এখনও ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর বাইরে রয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল) নির্বাহী সদস্য শাকিল আক্তার চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘মজুরি কাঠামোতে বেতনের পাশাপাশি শ্রমিকের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা থাকে। নিত্যপণ্যের চড়া দামে সংকটে শ্রমিক সমাজ। মূল্যস্ফীতির বর্তমান বাস্তবতায় পণ্যের দর কমানোর সুযোগ হয়তো কম। তবে মজুরি বাড়ানোর মাধ্যমে শ্রমিকদের একটু ভালো রাখা সম্ভব। শ্রমিকদের জন্য রেশন চালু সময়ের দাবি।’


শর্টলিংকঃ