দুনিয়া পাল্টানো রেলযাত্রা


রাজনীতি কি কখনো কখনো জুয়াখেলার মতোই প্রচুর উত্তেজক, ভীষণ অনিশ্চিত; অথচ তুমুল নিবেদিত ও একাগ্র? তা যদি হয়, পৃথিবীর ইতিহাসের তেমন একটি সময় ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাস—যখন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন তার নির্বাসিত ২৯ বলশেভিক সঙ্গী ও দুই শুভানুধ্যায়ী সুইস ও পোল বিপ্লবীকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড থেকে রেলযাত্রা শুরু করেছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গের উদ্দেশে। ৯ থেকে ১৬ এপ্রিলের এ রেলযাত্রার গড় ফল ছিল বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব—প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা এবং প্রথম মহাযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে সরে এসে রাশিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান।

টানা আটদিনের এ রেলভ্রমণের আগে জুরিখে হতদরিদ্রের মতোই দিন কাটাতেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন ও তার স্ত্রী নাদেজদা ক্রুপস্কায়া; কিন্তু সেন্ট পিটার্সবার্গে পৌঁছার মাত্র আট-নয় মাসের মধ্যেই রচিত হয় নতুন এক ইতিহাস—লেনিন হয়ে ওঠেন সারা পৃথিবীতে নতুন দিনের প্রতীক, পৃথিবীর এক-ষষ্ঠাংশ ভৌগোলিক এলাকার ১৬ কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য তিনি যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেন, সেই বিপ্লব হয়ে ওঠে সারা পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বপ্ন।

সুইজারল্যান্ডের পুরনো জুরিখের স্পিজেলগেজের এক রুমের একটি বাসায় লেনিন চরম দরিদ্রতার মধ্যে বলতে গেলে বিচ্ছিন্ন এক জীবনযাপন করছেন। রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগও যেন দিনকে দিন ধূসর হয়ে উঠছে। অসুস্থ স্ত্রী নাদিয়াকে বাসায় রেখে প্রতিদিন সকালে উঠে তিনি চলে যান লাইব্রেরিতে—যেটি বলতে গেলে এক অদ্ভুত জায়গা। অনেক আগে ষোড়শ শতাব্দীতে সেটি ছিল চার্চ, কিন্তু কালক্রমে সেটিই হয়ে উঠেছে লাইব্রেরি। বৃহস্পতিবার বাদে প্রতিদিনই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এ লাইব্রেরিতে বইয়ের সামনে চোখ দুটো মেলে রাখেন তিনি। কারণ বৃহস্পতিবার লাইব্রেরি বন্ধ থাকে।

দিনটি ছিল ১৯১৭ সালের ১৫ মার্চ, যেদিন থেকে লেনিনের প্রাত্যহিক এ রুটিনে ছন্দপতন ঘটে। কেননা ১৫ মার্চ দুপুরে লেনিন লাইব্রেরি থেকে বাসায় ফেরেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পোল্যান্ডের বিপ্লবী ব্রনস্কি এসে তাদের খবর দেন, রাশিয়ায় জারের পতন ঘটেছে, নতুন অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে। লেনিন বুঝতে পারেন, ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে রাশিয়ায় ফেরার সময় হয়েছে তার।

কিন্তু ফিরবেন কেমন করে? রাশিয়ায় ফেরার জন্য দুটি পথ ছিল লেনিনের সামনে। একটি পথ ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মধ্য দিয়ে গিয়ে সমুদ্রপথে রাশিয়ার উত্তরাংশে। কিন্তু লেনিনের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে মিত্র রাশিয়া সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ফাটল ধরতে পারে, তাছাড়া লেনিনের রাজনৈতিক ভূমিকার ঢেউ ব্রিটেন ও ফ্রান্সকেও ধাক্কা দিতে পারে, এমন বিবেচনায় এ দুই দেশের সরকার রাজি ছিল না তাকে তাদের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে যেতে দিতে। ফেরার আরেকটি পথ ছিল জার্মানির ওপর দিয়ে। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধজনিত সেই সময় ফ্রান্স আর ব্রিটেনের মিত্রশক্তি রাশিয়া; যুদ্ধ চলছে তাদের জার্মানি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি ও তুরস্কের সঙ্গে। যুদ্ধের রণাঙ্গনে তখন জার্মানি বেকায়দায় পড়তে শুরু করেছে। সেই জার্মানি কোনো বিশেষ সুবিধা ছাড়া কেন ব্যবহার করতে দেবে লেনিনকে তাদের ভূখণ্ড। বিশেষত লেনিন যখন যেতে চাইছেন ক্ষমতাচ্যুত জারের দেশে ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ কায়েম করতে, যে জার কিনা জার্মানির কাইজারেরই কাজিন!

জারের পতনের খবর ছিল অবিশ্বাস্য। সারা দিনটাই গেল তাদের এর সত্যতা যাচাইয়ে আর রাশিয়ার নতুন সরকার সম্পর্কে জানতে। জার্মানির পত্রিকা ব্রনস্কির এ খবরের উৎস, তাই লেনিন বাসা থেকে বেরিয়ে সুইস পত্রিকাও দেখলেন এবং নিশ্চিত হলেন, সত্যিই জারের পতন ঘটেছে। বার্ন থেকে আসা গ্রেগরি জিনোভিয়েভের সঙ্গে অনেক রাতে সুইজারল্যান্ডের ‘নোয়া জারচার জাইটুং’ পত্রিকা অফিসে গিয়ে লেনিন আরো জানতে পারলেন, অস্থায়ী সরকারের বেশির ভাগ সদস্যই কাদেত পার্টির, তবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন প্রিন্স লুভভ, যিনি জার পরিবারেরই একজন। এছাড়া এ সরকারে রয়েছেন লেনিনের চেয়ে বছর দশকের ছোট আলেকক্সান্দার কেরেনস্কি, যিনি ৪৭ বছরের লেনিনের বিবেচনায় এ সরকারের সবচেয়ে চৌকস একজন। পরিস্থিতি ঘোলাটে। তার পরও তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, রাশিয়ায় ফিরতে হবে।

রেলযাত্রার আগে জুরিখে অবস্থানকালেই লেনিন রাশিয়ার অবস্থা ও জনগণের করণীয় বিষয়ে পরপর পাঁচটি লেখা বা চিঠি পাঠান বলশেভিকদের মুখপত্র ‘প্রাভদা’য় প্রকাশের জন্য। কিন্তু এগুলোর মধ্যে শুধু প্রথমটি প্রকাশিত হয়, তাও সম্পাদনা করে এবং খানিকটা অংশ আবার একেবারে বাদ দিয়ে। এ চিঠির নিচে আবার কামেনেভের পক্ষ থেকে এ ফুটনোট দেয়া হয় যে এ চিঠির বক্তব্য একান্তই লেনিনের, এর সঙ্গে পত্রিকার কোনো সম্পর্ক নেই। বিষয়টি লেনিনকে একই সঙ্গে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করে। তিনি বুঝতে পারেন, রাশিয়ায় ফেরা দরকার।

ব্রিটেনের কাছ থেকে কোনো সমর্থন মিলবে না, এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠায় লেনিনের দিক থেকে এ সময় সর্বতোভাবে জার্মানির সঙ্গে একটি সমানে সমান বোঝাপড়ার চেষ্টা চলছিল। এক্ষেত্রে বার্নে অনুষ্ঠিত রাশিয়ায় ফিরতে ইচ্ছুক বিপ্লবী নেতাদের এক সভায় লেনিনের বন্ধু জুলিয়াস মার্তভের প্রস্তাব ছিল, তারা অস্থায়ী সরকারের কাছে প্রস্তাব করবেন যে সরকারের পক্ষ থেকে জার্মানিকে এ প্রস্তাব দেয়া হোক যে তারা কোপেনহেগেন হয়ে জার্মানি দিয়ে তাদের ট্রেনে করে রাশিয়ায় ফিরে যাবেন; বিনিময়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকেও একই সংখ্যক জার্মানকে ফেরত পাঠানো হবে। বিপ্লবীরা মার্তভের এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন। সে অনুযায়ী মার্তভ রুশ সরকারের কাছে এ ব্যাপারে একটি চিঠি লেখেন, অন্যদিকে সুইস সমাজতন্ত্রী রবার্ট গ্রিমকে দায়িত্ব দেয়া হয় জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলার।

তবে শুধু এভাবেই নয়, চেষ্টা চলছিল নানা প্রস্তাবের ভিত্তিতে এবং নানা উপায়ে। প্রসঙ্গত বলা ভালো, প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুর দিকেই জার্মানির পক্ষ থেকে লেনিনকে জার সরকারকে উত্খাতের জন্য কি অর্থনৈতিক কি সামরিক, উভয় দিক থেকেই সহায়তা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। জার্মান সরকার ও ট্রটস্কির খুবই ঘনিষ্ঠ, সাবেক বামপন্থী আলেক্সান্দর পারভাস লেনিনের কাছে এ প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু লেনিন তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আবারো নতুন করে জার্মানির সঙ্গে একটি বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে ঘটনাটি ছিল একটি বিষফোঁড়ার মতো। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে পুরনো সেই বিষফোঁড়া আবারো ফিরে এল এবং পারভাস তার একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠালেন লেনিনের সঙ্গে কথা বলতে। লেখাই বাহুল্য, এ আলোচনা এগোল না, বরং ভেস্তে গেল।

তবে পরিস্থিতি অনুকূলে আসতে শুরু করল অন্যদিক থেকে। বার্নে অবস্থানরত জার্মান রাষ্ট্রদূত ব্যারন গিসবার্ট ভন রোমবার্গ অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করলেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জিম্মারম্যানের সঙ্গে। রোমবার্গ তার কাছে জানতে চাইলেন, সুইজারল্যান্ডে রয়েছেন এমন অনেক রাশান বিপ্লবীই এখন জার্মানি দিয়ে দেশে ফিরতে আগ্রহী। এমন কোনো প্রস্তাব তার কাছে এলে তাদের অবস্থান কী হবে। অবশ্য রোমবার্গকে এ যোগাযোগে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন সুইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার হফম্যান ও সুইস সোস্যাল ডেমোক্র্যাটস রবার্ট গ্রিম। যদিও এ ঘটনার পরিণতি খুব একটা সুখকর ছিল না, বিশেষ করে আর্থার হফম্যানের জন্য। কারণ লেনিন সেন্ট পিটার্সবার্গে পৌঁছার পর রবার্ট গ্রিম তা জানিয়ে টেলিগ্রাম করেন হফম্যানের কাছে। দুর্ভাগ্যবশত এ টেলিগ্রাম বার্তা ফাঁস হয়ে যায় এবং হফম্যান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। গ্রিম নিজেও অপদস্থ হন নানাভাবে।

জার পতনের ষোলোতম দিনে লেনিন আনুষ্ঠানিকভাবে সুইস সমাজতন্ত্রী রবার্ট গ্রিমকে জানান, তাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ট্রেনে করে জার্মানির ভেতর দিয়ে রাশিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে। এ ব্যাপারে গ্রিম যেন দ্রুত উদ্যোগ নেন। লেনিন আরো জানান, রোমবার্গকে এটাও জানাতে হবে, তার দুটো শর্ত রয়েছে। প্রথমত, যে ট্রেনে তারা জার্মানির মধ্য দিয়ে যাবেন, সেই ট্রেনটিকে বিদেশী রাষ্ট্রের দূতাবাসের অর্থাৎ সিলড ট্রেনের মর্যাদা দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, এই যাত্রাপথে কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না বা সাক্ষাৎ চাইতে পারবেন না।

স্বভাবতই লেনিনের এ প্রস্তাব রোমবার্গকে বিস্মিত করেছিল। কিন্তু তিনি এ বার্তা জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিম্মারম্যানের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন, যিনি মনে করতেন, রাশিয়ার বিপ্লবী শাখাকে জার্মানির স্বার্থে কাজে লাগানো যাবে। তার প্রভাবে খুব তাড়াতাড়িই কাইজার ও তার জেনারেলরা লেনিনের এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। রোমবার্গের কাছে বার্তা আসে, লেনিন ও তার ভ্রমণসঙ্গীদের নামের তালিকা এবং যাত্রার সময় সীমান্ত অতিক্রমের কমপক্ষে চারদিন আগে জানাতে হবে। সীমান্তবর্তী স্টেশনে তাদের হস্তান্তর করবেন দূতাবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ কর্মকর্তারা। এ ট্রেন যাবে সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে।

রোমবার্গ জার্মান সরকারের এ সিদ্ধান্ত জানলেন। তবে বিপ্লবীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের কোনো তাড়া ছিল না তার, কারণ বিপ্লবীরা তার সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন রবার্ট গ্রিমের ওপর। তিনি গ্রিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে বরং জানতে চাইলেন, জুলিয়াস মার্তভের দেয়া প্রস্তাবটি কোন পর্যায়ে আছে, তার পাঠানো তারবার্তার ব্যাপারে রুশ সরকারের ইতিবাচক সাড়া মিলেছে কিনা।

মহাযুদ্ধের মাঠ তখন জমে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র মিত্রপক্ষে যোগ দেয়ার পথে। বলশেভিকরা রাশিয়ায় ফিরে গেলে সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো দ্বন্দ্বমুখর আর সংকটাপন্ন হয়ে উঠবে এবং যুদ্ধের সপক্ষে সরকারের অবস্থানও ব্যাহত হবে, পূর্ব রণাঙ্গনে জার্মানিকে মনোযোগ কম দিতে হবে, এটা বোঝার জন্য কাইজার ও তার পারিষদদের বাঁকাপথে হাঁটার প্রয়োজন ছিল না। যুদ্ধের প্রয়োজনে সক্ষম কৃষকদেরও সেনাবাহিনীতে যোগদানে বাধ্য করায় জার্মানিতে তখন কৃষি উৎপাদন ভয়ানক কমে এসেছে, দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দিয়েছে, ওদিকে সৈনিকদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। সব মিলিয়ে জিম্মারম্যান চাইছিলেন দ্রুত লেনিন ও তার সহযোগীদের দেশে ফেরার ব্যাপারে সহায়তা করতে। রোমবার্গ দেখলেন, গ্রিম রাশিয়ার দিক থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছেন না; কিন্তু জিম্মারম্যানের তাড়ায় তিনি নিজেই জার্মান সাংবাদিক পল লেভির মাধ্যমে সরাসরি যোগাযোগ করলেন লেনিনের সঙ্গে।

৫ এপ্রিল ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আর্থার বলফর দুটো তারবার্তা পেলেন। যার একটিতে নিশ্চিত করা হয়েছে যে লেনিন সিলড ট্রেনে রাশিয়ায় ফিরছেন। দ্বিতীয় তারবার্তা থেকে তিনি জানতে পারলেন, আমেরিকা থেকে কানাডা হয়ে রাশিয়ায় ফেরার পথে ট্রটস্কিসহ ছয়জন রাশান বিপ্লবী আটক হয়েছেন। সে রাতেই বলফর রাশিয়ায় ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত জর্জ বুকাননকে তারবার্তায় জানতে চাইলেন, লেনিন রাশিয়ায় ফিরলে যে বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা দেবে, সে ব্যাপারে সেখানকার সরকার কী ভাবছে। তিনি এও জানালেন, রাশিয়া যা চাইবে, ট্রটস্কি ও তার সঙ্গীদের ক্ষেত্রে সে রকম ব্যবস্থাই নেয়া হবে। ওদিকে একই দিন জুরিখে রোমবার্গের কাছেও জার্মানি থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসে পৌঁছল। তারবার্তায় বলা হলো, ৭ এপ্রিল শনিবার সন্ধ্যায় সুইস সীমান্ত লাগোয়া গোতমাদিগেন স্টেশনে দুটো দ্বিতীয় শ্রেণীর বগিসহ একটি ট্রেন প্রস্তুত থাকবে। জুরিখ থেকে বিপ্লবীদের সেখানে পৌঁছে দিতে হবে দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে।

৫ এপ্রিল বৃহস্পতিবার আরো একটি ঘটনা ঘটল, ফরাসি সংবাদপত্র ‘লা প্যারিসিয়ানে’ রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পল মিলিয়ুকভের উদ্ধৃতি দিয়ে এক খবরে জানানো হলো, জার্মানি থেকে যেসব রাশান ফিরবেন, তারা রাশিয়ায় বড় রকম বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন। এভাবে আবারো পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠল। লেনিন বুঝতে পারলেন, ‘সিলড ট্রেনে’ ভ্রমণ করেও তিনি ষড়যন্ত্রের দায় থেকে রক্ষা পাবেন না। অতএব যাত্রার সময় আবারো পেছাল। লেনিন এ ভ্রমণে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীর অনুমোদন পেতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। চেষ্টা করলেন এ ভ্রমণের সমর্থনে তাদের একটি বিবৃতি পেতে। অবশ্য খুব অল্পেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো তাকে। বিবৃতিতে পোল্যান্ডের ব্রনস্কি, ফ্রান্সের গিলবাউস ও সুইজারল্যান্ডের প্লাতেন ছাড়া কারো স্বাক্ষর মিলল না। সুইজারল্যান্ডে অবস্থানকারী ফরাসি লেখক রমা রঁলা স্বাক্ষর তো দিলেনই না, উল্টো জানালেন যে ‘লেনিন হলো বিপজ্জনক আর ছদ্দবেশী শৌখিন বিপ্লবী!’ লেনিনের এ ট্রেনযাত্রাকে আরো নিরাপদ ও বিতর্কমুক্ত করতে রোমবার্গ চাইলেন, শুধু বলশেভিক নয়, নির্বাসনে থাকা অন্যান্য সমাজতন্ত্রী রাশানরাও যাতে তার সহযাত্রী হন। কিন্তু সুইজারল্যান্ডে অবস্থানরত মেনশেভিক, সোস্যালিস্ট কোনো রাজনীতিকই চাইলেন না তার সঙ্গে যেতে। শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন ইহুদি বুন্ডিস্ট দলের এক রাজনৈতিক নেতা। লেনিনের অনুরোধে এ ট্রেনযাত্রার মুখপাত্র ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্লাতেনও ভ্রমণসঙ্গীর তালিকায় যুক্ত হলেন।

এদিকে রাশিয়ার অস্থায়ী সরকারের বামপন্থী অংশ যুদ্ধের অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে, এ বিবেচনায় বিশ্বরাজনৈতিক মঞ্চে তখন শুরু হয়েছে দ্রুত পালাবদলের খেলা। ১৯১৭ সালের ৬ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকা যুদ্ধ ঘোষণা করল জার্মানির বিরুদ্ধে। জার্মানিকে বেকায়দায় ফেলতে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা পশ্চিম রণাঙ্গন খোলার পথে এগোল। ঠিক হলো ৯ এপ্রিল থেকে পশ্চিম রণাঙ্গন উন্মুক্ত করা হবে।

এদিকে জার্মান কর্তৃপক্ষ লেনিনের সফরসঙ্গীদের তালিকা ও পাসপোর্ট চেয়ে পাঠাল। তা জানতে পেরে লেনিন আবারো বেঁকে বসলেন। জানালেন, তিনি বড়জোর সংখ্যা জানাতে পারেন, নাম বা পাসপোর্ট কোনোটাই দেয়া হবে না। যুক্তরাষ্ট্র মিত্রপক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হওয়ার পর জার্মানি এত বেকায়দায় ছিল যে তাকে এ প্রস্তাবও মেনে নিতে হলো।

৯ এপ্রিল লেনিন যখন সঙ্গীদের নিয়ে জুরিখের বার্ন রেলস্টেশনে গিয়ে পৌঁছলেন, সেখানে তখন অপেক্ষা করছে অনেকেই। তাদের বেশির ভাগই বিক্ষুব্ধ। তারা লেনিনের দিকে গালি ছুড়তে শুরু করলেন, ‘জার্মানির দালাল’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘জার্মানির চর’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার ভীষণ আশঙ্কিত, লেনিন রাশিয়ায় পৌঁছলেই তাকে গুলি করে মারা হবে। তার উচিত এ পাগলামি ত্যাগ করা—এমন সব পরামর্শ দিতে শুরু করলেন তারা। এমন এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে অবিচল লেনিন যাত্রা করলেন স্বদেশের দিকে। ট্রেন ছেড়ে দিল, ট্রেনের জানালার পাশে বসা লেনিন দেখলেন, তার সঙ্গী বলশেভিকরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গাইছেন। একসময় তারা তার দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন, তাদের সঙ্গীতের রেশও মিলিয়ে গেল।

এ ছিল এক ভয়ংকর অনিশ্চিত যাত্রা। লেনিন জানতেন, তাকে ‘জার্মানির চর’ মনে করা হচ্ছে এবং তিনি দাঁড়িয়ে আছেন গভীর এক গিরিখাতের কিনারে, একটু এদিক-সেদিক হলেই পতন ঘটবে তার। নিক্ষেপিত হবেন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু তিনি জানতেন না, রাশিয়ায় তার জন্য কী অপেক্ষা করছে। যদিও এ রকম অনুমান করেছিলেন, স্ট্যালিন ও কামেনেভদের মতো সহযোদ্ধাও হয়তো তার হাতছাড়া হয়ে গেছে। এ ট্রেনযাত্রায় তার এ ধারণা আরো বদ্ধমূল হয়। কারণ ট্রেনে যেতে যেতে তিনি প্রাভদার ২৮ মার্চের সংখ্যায় স্ট্যালিনের একটি নিবন্ধ পড়েন, যেটিতে স্ট্যালিন মহাযুদ্ধের বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়ে লিখেছিলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ করো—এটি একটি চরম অবাস্তব স্লোগান।’ যাত্রাপথে মালমেতে লেনিন, নাদিয়া ও জিনোভিয়েভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন গেটেনস্কি। তার কাছ থেকে দলের বিভিন্ন খবর পান লেনিন। তাকে জানানো হয়, প্রাভদার দায়িত্ব থেকে মলোটভ ও শিলাপনিককে সরিয়ে স্ট্যালিন ও কামেনেভ ক্রমেই বলশেভিক নীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। মেনশেভিক ও বলশেভিকদের এক হয়ে যাওয়ার প্রস্তাবেও স্ট্যালিন ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছেন। সাইবেরিয়া থেকে কামেনেভ, স্ট্যালিন ও সেভারদিলেভরা পেত্রগ্রাদে ফিরে এসে জারের রক্ষিতা ও বিখ্যাত ব্যালে নর্তকী শেসিনস্কয়ার রাজপ্রাসাদের মতো বাসভবন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেটিকে বলশেভিক পার্টির সদর দপ্তর বানিয়ে এসব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য গ্রেগরি জিনোভিয়েভের স্মৃতিকথা থেকে এ রকমও জানা যায়, স্ট্যালিন এবং আরো একজন উচ্চ পর্যায়ের বলশেভিক নেতা নাকি রাশিয়ার মধ্যে প্রথম যাত্রাবিরতি স্থল বেলোস্ট্রোভে লেনিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।

জুরিখ থেকে জার্মানি পেরিয়ে ফেরিতে বালটিক সাগর পাড়ি দিয়ে, তারপর আবারো রেলে টানা ১৮ ঘণ্টায় স্টকহোম থেকে সুইডেনের একেবারে প্রত্যন্ত প্রান্তরে এসে পৌঁছেন লেনিন। এ রকম একটি অভিমত আছে, বার্লিনে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে লেনিনের বৈঠক হয়। যদিও এর কোনো বিশ্বস্ত বিবরণ আজও মেলেনি। এ যাত্রাপথে বরফ হয়ে ওঠা নদী। স্লেজগাড়িতে পাড়ি দিতে হয় তাদের। ফিনিশ শহর টরনিওতে পৌঁছার পর লেনিনের টিমকে সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস কর্মকর্তা হ্যারল্ড গ্রুনেরের মুখোমুখি হতে হয়। তিনি তাদের তল্লাশি করেন, প্রশ্ন করেন, চেষ্টা করেন দেরি করিয়ে দেয়ার। নানাভাবে তিনি এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন এই আশায় যে পেত্রগ্রাদ থেকে অস্থায়ী সরকারের নির্দেশ আসবে এবং তিনি এদের প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন। কিন্তু রাশিয়ার নতুন সরকার প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি নিতে চাননি। গ্রুনের তাই বাধ্য হন সুইস সোস্যাল ডেমোক্র্যাট ফিটজ প্লাতেন বাদে অন্য সবাইকে সীমান্ত অতিক্রমের অনুমতি দিতে।

ফিনল্যান্ড ও রাশিয়ার বর্ডারের কাছাকাছি বেলোস্ট্রভ রেলস্টেশনে এসে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার বাতাস এসে গায়ে লাগে লেনিনের। তার ধারণা ছিল, কসাক সৈনিকে ভরা থাকবে স্টেশনটি, গ্রেফতার হতে হবে তাকে; কিন্তু তার বদলে তিনি দেখতে পান, রেলস্টেশনজুড়ে শ্রমিকদের ভিড়। স্টেশনের ছোট ওয়েটিং রুমে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন কামেনেভ, আলেকজান্দার শিলাপনিকভ আর ছোট বোন মারিয়া ইলিনচা ও থিওডোর রাসকলনিকভ। ট্রেনটি থামার পর লেনিন স্টেশনে নামতে না নামতেই শ্রমিকরা তাকে কাঁধে তুলে নেন। বাঁধভাঙা উল্লাসের মধ্য দিয়ে তাকে নিয়ে যান ওয়েটিং রুমে। কাঁধ থেকে শ্রমিকরা লেনিনকে নামিয়ে দিলে তিনি তার ছোট বোনকে জড়িয়ে ধরেন—তারা নিজেরাও ভুলে গেছেন, কত বছর দেখা হয় না তাদের! একে একে সবার সঙ্গে আলিঙ্গন করেন লেনিন। তারপর অপেক্ষারত শ্রমিকদের উদ্দেশে বক্তব্যও রাখতে হয় তাকে। একটি চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন তিনি। তারপর আবারো সবার সঙ্গে ট্রেনে চাপেন। এভাবে একের পর এক ১৫টি স্টেশনে অপেক্ষারত শ্রমিক-জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা রাখতে হয় তাকে। অবশেষে রাত সোয়া ১১টার দিকে তিনি পৌঁছেন সর্বশেষ স্টেশন পেত্রগ্রাদের ফিনল্যান্ডে; যেখানে অনেক আগেই রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে ট্রাম চলাচল, মানুষে ঠাসা স্টেশনটি। মাত্র কয়েকদিন আগে দেশে ফিরে এসেছেন প্লেখানভ, কিন্তু সেদিনের তুলনায় এদিন ফিনল্যান্ড স্টেশন ছিল জনসমুদ্র। এখানেও বক্তব্য দেন লেনিন। সব বক্তৃতাই তিনি শেষ করেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আহ্বান জানিয়ে এবং তা মাত্র একদিনেই রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।

ফিনল্যান্ড স্টেশন থেকে লেনিন পৌঁছেন বলশেভিক হেডকোয়ার্টার খেসিনস্কায়া ম্যানসনে। সেখানকার আলেকজান্দ্রাভস্কি পার্ক অত রাতেও লোকে লোকারণ্য। কাছেই পিটার অ্যান্ড পল দুর্গ, যেখানে ৩০ বছর আগে বন্দি ছিলেন লেনিনের ভাই সাশা। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা দেন লেনিন। কিন্তু বারবার তাঁর চোখ চলে যায় সেই দুর্গের দিকে। এ সভা শেষে বলশেভিকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি বড় হলরুমে। এখানেই তিনি আওয়াজ তোলেন—‘সব ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে ন্যস্ত করতে হবে’—যে আওয়াজ রাশিয়াকে নিয়ে যায় সমাজতন্ত্রের পথে।

এ অনিশ্চয়তায় ভরা রেলযাত্রায়ই লেনিন রচনা করেন তার ঐতিহাসিক এপ্রিল থিসিস। এতে অস্থায়ী সরকারকে জাতীয় বুর্জোয়া সরকার হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, এ সরকারকে সামান্যতম ছাড়ও দেয়া যাবে না। এ থিসিস অনেককে বিস্মিতও করে। কেননা ৯ এপ্রিল দুপুরে লেনিন জুরিখের পুরনো লাইব্রেরি ভবনের পাশের এক রেস্টুরেন্টে শুভানুধ্যায়ী রাজনৈতিক সঙ্গীদের সঙ্গে ভোজসভায় সুইস কমরেডদের প্রতি একটি লিখিত বক্তব্য দেন। এ সময় কথা প্রসঙ্গে লেনিন বলেছিলেন, রাশিয়া একটি কৃষিপ্রধান দেশ। ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে পশ্চাত্পদ, অবিকশিত দেশ। এখানে সমাজতন্ত্র আসতে অনেক দেরি হবে, আমাদের আরো অনেক অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু লেনিন তার এপ্রিল থিসিসে এ কথা তুলে ধরেন যে পুঁজিবাদ অবিকশিত হলেও রাশিয়ায় বুর্জোয়া সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পেত্রগ্রাদে পৌঁছেই তিনি তার সংক্ষিপ্ত অথচ তাত্পর্যপূর্ণ বক্তৃতায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আহ্বান জানান। পরে ১৭ এপ্রিল (রাশিয়ার পুরনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৪ এপ্রিল) তিনি বলশেভিক নেতাদের সভায় এবং ১৮ এপ্রিল বলশেভিক ও মেনশেভিকদের সভায় পূর্ণাঙ্গ এপ্রিল থিসিস তুলে ধরেন। প্রাভদায় এপ্রিল থিসিস প্রকাশিত হয়। বলশেভিকদের মধ্যে এ থিসিস জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকলেও ব্যাপক অপপ্রচার শুরু হয় লেনিনের বিরুদ্ধে। বলা হয়, জার্মান সাম্রাজ্যবাদীদের চর হিসেবে তাদের সহযোগিতা করার জন্যই এ থিসিস রচনা করেছেন তিনি। কিন্তু টানা অপপ্রচারণার পরও বলশেভিকদের পেত্রগ্রাদ নগর সম্মেলনে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে অনুমোদন পায় এ থিসিস। এ ভোটাভুটির সময় লেনিনের থিসিসের পক্ষে ভোট দেন স্ট্যালিন, যা কামেনেভকে বিস্মিত করলেও পুরো পরিস্থিতিকে পাল্টে দেয়।

ব্যক্তিগতভাবেও এ সময়টি লেনিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও বেদনামথিত। কেননা জার্মানি হয়ে দেশে ফেরা নিয়ে প্রেমিকা ইনেসা আরমান্দের সঙ্গে তার রাজনৈতিক দূরত্ব দেখা দেয়। ইনেসাকে তিনি রাশিয়ায় ফেরার ব্যাপারে ব্রিটেনের সঙ্গে দূতিয়ালির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তার নীরবতাও লেনিনকে আহত করে। সিলড ট্রেনেই রাশিয়ায় ফিরেছিলেন ইনেসা, কিন্তু তার রাজনৈতিক অবস্থান থেকে দূরে সরেননি। বরং পরে জার্মানির সঙ্গে শান্তিচুক্তিরও বিরোধিতা করেন তিনি। লেনিনের সান্ত্বনা বোধকরি এটুকুই যে ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরে ইনেসার মৃত্যুর পর তিনি তার কফিনের ওপর একগুচ্ছ সাদা লিলি রাখতে পেরেছিলেন—লংজুয়িমুর টিলার পাদদেশে দাঁড়িয়ে যে ফুল তার হাতে তুলে দিয়ে একদিন ইনেসা বলেছিলেন, ‘এই সাদা লিলি আমাদের ভালোবাসার স্মারক হয়ে রইল।’

এ প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত যে জার্মানির সঙ্গে লেনিনের সিলড ট্রেনকেন্দ্রিক বোঝাপড়াটা ঠিক কোন পর্যায়ের ছিল, বলশেভিকদের উত্থানের পেছনে জার্মানির ভূমিকা ঠিক কোন মাত্রার ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত রাশিয়ায় এবং বিশ্বরাজনীতিতে যেসব ঘটনা ঘটে, তা থেকে কেবল এমন একটি সিদ্ধান্তেই পৌঁছা যায়, এটি ছিল লেনিন ও জার্মানি উভয়ের জন্যই সমানে সমান মিশন। বলশেভিকরা ১৯১৭ সালের নভেম্বরে বিপ্লব সম্পন্ন করেন। অন্যদিকে লেনিন ১৯১৮ সালের মার্চে জার্মানিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে আলাদা শান্তিচুক্তি করেন। এতে সমালোচকরা জার্মানির সঙ্গে সমঝোতার গন্ধ পেলেও এটি স্বীকার করতেই হবে যে সদ্য বিপ্লব হওয়া রাশিয়ার যুদ্ধক্লান্ত জনগণ স্বস্তি পেয়েছিল, বিপ্লবী সরকার যুদ্ধের মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে দূরে সরে আসতে পেরেছিল।

 

ইমতিয়ার শামীম: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

 


শর্টলিংকঃ