নরসুন্দরের সৎকারে বাধা, বৃষ্টির মধ্যে লাশ নিয়ে স্ত্রীর অপেক্ষা


ইউএনভি ডেস্ক:
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা যাওয়া নরসুন্দর নিতাই চন্দ্র শীলের (৫৪) সৎকারে বাধা দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় সৎকারের জন্য মরদেহ নিয়ে স্বজনরা শ্মশানে প্রবেশ করলে তাদের বের করে দেয়া হয়।

নরসুন্দরের সৎকারে বাধা, বৃষ্টির মধ্যে লাশ নিয়ে স্ত্রীর অপেক্ষা

উপায়ন্তর না দেখে স্বজনরা মরদেহ নিয়ে শ্মশানের বাইরে সড়কের পাশে অপেক্ষা করতে থাকেন। পরে বৃষ্টি শুরু হলে মরদেহটি মহাশ্মশানের ভেতরে ছাউনির নিচে রাখার অনুরোধ করেন স্বজনরা। তবে এতে কর্ণপাত করেননি মহাশ্মশান রক্ষা কমিটির নেতারা।

ফলে বৃষ্টির মধ্যে সড়কে মরদেহের পাশে বসে পাহারা দিয়েছেন মারা যাওয়া নিতাই চন্দ্র শীলের স্ত্রী মঞ্জু রানী ও শাশুড়ি কমলা রানী। প্রায় চার ঘণ্টা পর বরিশাল জেলা প্রসাকের মধ্যস্থতায় মরদেহ সৎকারের অনুমতি দেন মহাশ্মশান রক্ষা কমিটির নেতারা।শনিবার (৩০ মে) রাতে নগরীর কাউনিয়া এলাকার মহাশ্মশানে এ ঘটনা ঘটে।

নরসুন্দর নিতাই চন্দ্র শীলের আদি বাড়ি বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি গ্রামে। তবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে নগরীর ধান গবেষণা রোডে স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। নগরীর চাদমারী খেয়াঘাট সংলগ্ন এলাকায় নিজের সেলুনে কাজ করতেন নরসুন্দর নিতাই চন্দ্র শীল।

নিতাই চন্দ্র শীলের স্বজনরা জানান, শনিবার সকালে হঠাৎ করে নিতাই চন্দ্র শীলের বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। পরিবারের সদস্যরা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাকে নিয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। এ সময় শ্বাসকষ্টের কথা শুনে জরুরি বিভাগ থেকে করোনা ইউনিটে পাঠানো হয়।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে করোনা ইউনিটে তার মৃত্যু হয়। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে হাসপাতাল থেকে পরিবারের সদস্যদের কাছে নিতাই চন্দ্র শীলের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। এরপর মরদেহ সৎকারের জন্য কাউনিয়া মহাশ্মশানে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা।

শ্মশানে মরদেহ নিয়ে প্রবেশের পর করোনা ইউনিটে মৃত্যুর কথা শুনে বাইরে বেরিয়ে যেতে বলেন মহাশ্মশান রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তমাল মালাকার, সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব সেন গুপ্তসহ কমিটির আরও কয়েকজন সদস্য। তাদের বাধার মুখে মরদেহ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন পরিবারের সদস্যরা।

মরদেহ নিয়ে শ্মশানের বাইরে সড়কের পাশে অবস্থান করতে থাকেন তারা। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় বৃষ্টি। অন্যরা দূরে সরে গেলেও বৃষ্টির মধ্যে মরদেহের পাশে বসে পাহারায় ছিলেন নিতাই চন্দ্র শীলের স্ত্রী মঞ্জু রানী ও শাশুড়ি কমলা রানী।

এদিকে নরসুন্দর নিতাই চন্দ্র শীলের মৃত্যুর খবর পেয়ে শ্মশানে উপস্থিত হন বরিশাল জেলা নরসুন্দর কল্যাণ ইউনিয়নের সভাপতি নির্মল চন্দ্র। তিনি জানান, অনেক অনুরোধের পরও মহাশ্মশান রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তমাল মালাকার, সাংগঠনিক সম্পাদক বিপ্লব সেন গুপ্তসহ কমিটির আরও কয়েকজন মরদেহ সৎকার করতে বাধা দিয়ে যাচ্ছিলেন।

এমনকি মরদেহ নিয়ে শ্মশানের মধ্যে তারা অবস্থান করতে নিষেধ করেন। তাদের কারণে মরদেহ শ্মশানের বাইরে নিয়ে যেতে বাধ্য হন পরিবারের সদস্যরা। কমিটির লোকজনের একটাই কথা ‘শ্মশানে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির দেহ দাহ করতে দেয়া হবে না’।

নরসুন্দর কল্যাণ ইউনিয়নের সভাপতি নির্মল চন্দ্র বলেন, মুঠোফোনে মহাশ্মশান রক্ষা কমিটির সভাপতি মানিক মুখার্জীকে বিষয়টি জানাই। তিনিও মরদেহ অন্য কোথাও সৎকার করতে বলেন। কোনো সমাধান না পেয়ে বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে রাত প্রায় সড়ে ৮টা পর্যন্ত সড়কের পাশে রাখা ছিল মরদেহ।

পরে বিষয়টি জেলা প্রশাসক স্যারকে জানাই। তিনি (জেলা প্রশাসক) হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য ও মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুরঞ্জিৎ দত্ত লিটু ও হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং মরদেহ সৎকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন।

জেলা প্রশাসক স্যারের মধ্যস্থতায় রাত সাড়ে ৮টার পর মরদেহ সৎকারের অনুমতি দেন মহাশ্মশান রক্ষা কমিটির নেতারা।নিতাই চন্দ্র শীলের স্ত্রী মঞ্জু বেগম জানান, আমার স্বামী বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা গেছেন। এরপরও তারা সৎকার করতে বাধা দেন। বিষয়টি কতটা কষ্টের তা বলে বোঝাতে পারবো না।

হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য ও মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুরঞ্জিৎ দত্ত লিটু বলেন, বিষয়টি আমাদের জন্য লজ্জাজনক। শ্মশানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির মরদেহ সৎকার নিয়ে যা ঘটেছে তা পরবর্তীতে যাতে না ঘটে সে বিষয়ে আমাদের আরও আন্তরিক হতে হবে।

বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। শ্মশান কমিটি হয়তো করোনা আক্রান্ত মনে করে সৎকার করতে দেরি করেছেন। তাদের বুঝানো হলে মহাশ্মশানে সৎকার সম্পন্ন হয়।

মহাশ্মশান রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তমাল মালাকার বলেন, পরিবারের সদস্যরা নিতাই চন্দ্র শীলের মরদেহ যখন শ্মশানে নিয়ে আসেন তখন আরও দুই জনের সৎকার চলছিল। শ্মশানের মধ্যে তখন ৩০০ থেকে ৪০০ লোক অবস্থান করছিল।

এ কারণে তাদের মরদেহ নিয়ে পরে আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা সৎকারের জন্য তাড়াহুড়া করছিল। এ কারণে সমস্যা দেখা দেয়। পরে মহাশ্মশানেই নিতাই চন্দ্র শীলের সৎকার করা হয়। মহাশ্মশান রক্ষা কমিটির সভাপতি মানিক মুখার্জী বলেন, জনসমাগম এড়াতে তাদের পরে ভেতরে প্রবেশ করতে বলা হয়েছিল। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতেই এমনটা বলা হয়েছিল। বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখার কিছু নেই।


শর্টলিংকঃ