পলাশীর আগে : বাংলা ও বাঙালি


কাশিমবাজারে ফরাসি কুঠির অধ্যক্ষ ছিলেন মঁশিয়ে ল। প্রাক-পলাশী আমলে বাংলার সেনাদের মানসিকতা নিয়ে তার মন্তব্য ভাবনার খোরাক জোগায়। তার মনে হয়েছে, দেশের সিপাহি লাল জামা আর বন্দুক হাতে পেলেই আপাদমস্তক বদলে যায়। তারা নিজেদের হঠাৎই ‘অপর’ বিবেচনা করতে শুরু করে—নিজেরা হয়ে ওঠে ইউরোপীয়দের সমকক্ষ আর দেশীয় ভাইয়েরা নিম্নস্তরের মানুষ।

দেশবাসীকে তারা রীতিমতো ঘৃণা করতে শুরু করত। ‘এ দেশের মানুষ ইউরোপীয় সৈনিকদের কাছে যে ব্যবহার পায় তা এ দেশীয় সিপাইদের ব্যবহার থেকে অনেক ভালো। এমনকি বিশৃঙ্খল অবস্থায়ও ইউরোপীয় সৈন্য অনেক সময় দয়া ও মহত্ব দেখায় যা এ দেশীয় সিপাইদের কাছে কখনো আশা করা যায় না।’ এ সুযোগে একটি প্রশ্ন রাখাই যায়। কোম্পানি যখন ভারতবর্ষের দখল নিচ্ছিল তখন এ দেশীয়রা তাদের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছিল। কোম্পানির হয়ে তারা নিজ দেশ দখল করে তুলে দিয়েছিল ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে। ১৮৫৭তে কোম্পানি ভারতীয় সেনাদের ওপর দমন অভিযান শুরু করলে অনেক সেনানায়ক আফসোসও করেছেন যে তারা কোম্পানিকে পুরো ভারত দখল করে দিলেন, অথচ তারা তাদের ধর্ম নাশ করতে চাইছে।

পলাশীর ইতিহাসে বাঙালির ভিলেন ক্লাইভ বলেছিলেন, বঙালিরা ‘বিলাসী, অজ্ঞ ও কাপুরুষ’। ল্যুক স্ক্র্যাফটন লিখেছেন, ‘আনুগত্য ও দেশপ্রেম বাঙালির অজানা। অথচ এ দুটি গুণই মানুষের যা কিছু মহৎ এবং শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। বাঙালিরা অনুগত থাকে ততক্ষণ যতক্ষণ তাদের মনে ভয় থাকে; ভয়ের সঙ্গে আনুগত্যও উবে যায়। টাকা এখানে শক্তির উৎস, কারণ সৈন্যরা টাকা ছাড়া আর কোনো বন্ধন স্বীকার করে না। সুতরাং যার যত টাকা সে তত শক্তিশালী।’ আনুগত্য ও দেশপ্রেমে যে অভাব ছিল তা বোধহয় পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের পরিণতি থেকে মেনে নেয়া যায়।

প্রাক-পলাশী বাংলা গ্রন্থে সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘এ রকম সর্বাত্মক নৈতিক অবক্ষয় অলক্ষ্যে পলাশী যুদ্ধের পটভূমিকা রচনা করেছিল। ষড়যন্ত্র, বিশৃঙ্খলা ও আনুগত্যের অভাবে সৈন্যবাহিনী দুর্বল; সৈন্যাধ্যক্ষরা ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য দেশ এবং নবাব বংশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত। শাসকশ্রেণীর মধ্যে চরিত্র, ব্যক্তিত্ব ও সততার অভাব। ব্যক্তিস্বার্থ ও আত্মোন্নতির জন্য এ সামাজিক গোষ্ঠী সর্বদাই সচেষ্ট। সাধারণ মানুষ রাজনীতি ও রাজনৈতিক ভাগ্য সম্পর্কে নিস্পৃহ। এরূপ মানসিক ও নৈতিক অবস্থায় একটাই সম্ভাব্য ফল, তার নাম পলাশী।’ সীয়র-উল-মুতাক্ষারীন-এর ইংরেজি অনুবাদক হাজি মুস্তাফা জানিয়েছিলেন, তখন ভারতজুড়ে বাঙালিদের বেশি দুর্নাম ছিল, তাদের বেশ ঝামেলাবাজ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

পলাশীর আগে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সামাজিক জীবন বলতে মূলত ছিল গ্রাম্য জীবনযাপন। শহরে থাকতেন মূলত নবাব, ওমরাহ, জমিদাররা। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এদের জাঁকজমক ছিল দিল্লির অভিজাতদের অনুকরণে।

সাধারণ মানুষের জীবিকা ছিল মূলত কৃষিনির্ভর, পণ্য উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন। মানুষের জীবন ছিল সরল ও অনাড়ম্বর। ঝুঁকি নিয়ে নতুন কিছুর সন্ধান, জীবনে পরিবর্তন সাধারণ বাঙালির স্বভাবে ছিল না। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে আরেকটি বিষয়ও স্পষ্ট হয় বঙালির মন ও শরীর তখনো যন্ত্রশিল্পে কাজ করার উপযোগী হয়ে ওঠেনি। একঘেয়ে শ্রমঘন কাজ তাদের পছন্দ ছিল না।

বলাই বাহুল্য, সেকালে বাঙালি মাছে-ভাতে বাঙালিই ছিল। আধুনিক ফার্মিং না থাকায় মাংসের উৎপাদন নিশ্চয়ই কম ছিল। আর মাংস তাদের খুব একটা পছন্দও ছিল না। অন্তত সমকালীন বিবরণীতে সে রকমটাই উল্লেখ আছে। অন্যদিকে নদী-জলাশয়ে মাছের অভাব ছিল না। গম কিংবা যবে বাঙালির রুচি ছিল না। তারা রুটি খেত না। মোটাদাগে বাঙালি খেত ভাত, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, ফল, দুধ, ঘি, সরিষার তেল, দই ও মিষ্টি। সঙ্গে লবণ আর মরিচও বঙালির প্রিয় ছিল। সুজন রায় ভাণ্ডারী ১৬৯৫ সালের রচনা খুলাসাত-উত-তাওয়ারিখে সেকালের বাঙালির প্রিয় কিন্তু অদ্ভুত রকম এক খাবারের বর্ণনা দিয়েছেন। ‘বেগুন, উদ্ভিজ্জ, শাক-সবজি এবং লেবু একসঙ্গে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা জলে ডুবিয়ে রেখে পরদিন লবণ দিয়ে খাওয়া হতো।’ এ খাবার নাকি তখন বাঙালির বেশ প্রিয় ছিল।

শিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দুদের ছিল পাঠশালা আর মুসলমানদের জন্য মক্তব। উচ্চশিক্ষার জন্য মুসলিম মৌলবীরা প্রতিষ্ঠা করতেন মাদ্রাসা আর হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা চতুষ্পাঠী। পাঠশালা ও চতুষ্পাঠীর মধ্যে একটা বড় পার্থক্য ছিল। পাঠশালা যেকোনো বর্ণের হিন্দু প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন, কিন্তু চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার অধিকার ছিল কেবল ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের।

পোশাকের ক্ষেত্রেও বাঙালি সাদাসিধে। পোশাকের বিলাস করার মতো কোনো অবস্থা সাধারণের ছিল না। তাদের জন্য লজ্জা নিবারণই ছিল বস্ত্রের একমাত্র উপযোগিতা। দরবারের অভিজাত ধনীরা অবশ্য জাঁকালো পোশাক পরতেন। সাধারণ মানুষের মধ্য অবশ্য পাগড়ির প্রচলন ছিল। নারীদের নির্বিশেষ পোশাক ছিল শাড়ি। অভিজাতরা বাদে সাধারণ নারীদের মধ্যে পর্দা প্রথা বা ঘোমটার তেমন প্রচলন ছিল না। জুতা কিংবা মোজা ছিল একেবারে বিলাসিতা। ধনীরাই কেবল জুতা পরত। অবশ্য বাংলা বণিকদের ধনদৌলতের কমতি ছিল না। তাদের পোশাক-আশাকে বিদেশীরাও নাকি বিস্মিত হতো। সপ্তদশ শতাব্দীতে সোনার থালাবাটির সংখ্যা দিয়ে ধনীদের সম্পদের পরিমাণ ধারণা করা হতো।

দৈনন্দিন জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পানের। নিত্যদিনে কিংবা উৎসবে পানের ব্যবহার ছিল। পানের ছিল সামাজিক তাত্পর্য। গোলাম হোসেন খানের উদ্ধৃতি দিয়ে সুবোধকুমার জানিয়েছেন, সেকালে বাংলায় পান দেয়া ও নেয়ার ২০ রকমের সামাজিক তাত্পর্য ছিল। পানের একটি বিড়ি মেহমানকে দেয়া মানে তাকে সম্মান দেখানো, দুটো দিলে বোঝা যাবে পক্ষপাতিত্ব। আস্ত পানদানি অতিথিকে দিলে সেটা হবে শ্রদ্ধা জানানো। আর অতিথির সামনে পানদানি রাখলে সেটা হতো তাকে সমান বলে স্বীকৃতি দেয়া।

মদ, আফিম, তাড়ি, ভাং ছিল বাঙালির সাধারণ প্রচলিত নেশা। গরিব মানুষ উৎসবে দেশী তাল ও খেজুরের রসে তৈরি তাড়ি পান করত। মদ, আফিম ছিল উচ্চবিত্তদের পানীয়। এসব পান সমাজে বড় অপরাধ হিসেবে দেখা হতো না।

অবসরে খেলাধুলা বলতে ছিল হাডুডু, ডাণ্ডাগুলি, ঘুড়ি ওড়ানো, নৌকা বাইচ, তাস, দাবা, পাশা ও জুয়া খেলা। সেকালে রাধাকৃষ্ণ নন্দী ও তার পুত্র কৃষ্ণকান্ত নন্দী, মীরজাফরের পুত্র মীরন ঘুড়ি ওড়ানোতে বিখ্যাত ছিলেন। ঘুড়ি ওড়াতে দক্ষরা খলিফা নামে স্বীকৃত হতেন।

অবসরের বিনোদনে ছিল কথকতা, যাত্রা, পল্লীগীতির আসর। আলিবর্দি খান গল্প শুনতে পছন্দ করতেন। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল যাত্রা করে অভিনীত হয়েছিল। আলাওলের পদ্মাবতী গ্রামে জমায়েতের সামনে গীত হতো।

বাঙালি হিন্দু সমাজে সেকালে জাতিভেদ প্রথা ছিল প্রবল শক্তিশালী। ব্রাহ্মণরা নীচু জাতির কারো হাত থেকে পানিও নিতেন না। প্রত্যেক জাতের পেশা বা বৃত্তি ছিল নির্দিষ্ট। অবশ্য ইংরেজদের প্রভাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এসব কৌলিক বৃত্তির রীতি শিথিল হতে শুরু করে।

 

তথ্যসূত্র: প্রাক-পলাশী বাংলা

সুবোধকুমার মুখোপাধ্যায়


শর্টলিংকঃ