পিপিপি’র ঠিকাদার ’লাপাত্তা’, নতুন করে কাজ পেলো মজিদ সন্স


নিজস্ব প্রতিবেদক:

দীর্ঘ প্রায় একযুগ আগে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে শালবাগান ও ভদ্রা বাজারে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছিলো রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক)। এই দীর্ঘ সময় ধরে দুটি কাজের একটিও সম্পন্ন করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। বিস্ময়করভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি রাসিক। শুধুমাত্র আগের চুক্তি বাতিল দেখিয়ে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করে তারা। দুটি কাজই পেয়েছে বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স অ্যান্ড কন্সট্রাকশন। অবশ্য এবার আর পিপিপির ভিত্তিতে নয়, নিজেদের অর্থায়নেই শালবাগান ও ভদ্রায় কিচেন মার্কেট দুটির কাজ করবে রাসিক।

পিপিপি’র ঠিকাদার ’লাপাত্তা’, নতুন করে কাজ পেলো মজিদ সন্স

রাসিক প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর নগরীজুড়ে বেশ কয়েকটি প্রকল্প পিপিপি’র ভিত্তিতে করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর অংশ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে পুরাতন সিটি ভবন ভেঙে সেখানে বহুতল সিটি সেন্টার, নগর ভবন সংলগ্ন এলাকায় স্বপ্নচূড়া ও দারুচিনি প্লাজার নির্মাণকাজ করার জন্য পিপিপি’র ভিত্তিতে চুক্তি হয়। সিটি সেন্টারের কাজ পায় মেয়র লিটনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামূল হকের মালিকানাধীন এনা প্রোপার্টিজ। বাকি দুটির কাজ পায় শাসুজ্জামান জেভি।

২০১১ সালে একটি ক্লিনিক ও আরও ৭টি বহুতল মার্কেট পিপিপি’র ভিত্তিতে নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাসিক। এগুলোর মধ্যে ছিলো শালবাগান ও ভদ্রায় বহুতল কিচেন মার্কেট। রাসিকের পক্ষ থেকে পিপিপির ভিত্তিতে এসব মার্কেট নির্মাণে আগ্রহীদের কাছ থেকে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) আহ্বান করা হলে দুটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করে। কাজ দুটি তারাই পায়। সে অনুযায়ী, শালবাগানে ৪৭ দশমিক ৫৯ কাঠা জমির উপরে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ তলা শালবন মার্কেট নির্মাণ করার কাজ পায় মেসার্স কবির হোসেন। আর ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভদ্রায় মার্কেট নির্মাণের কাজ পায় শামসুজ্জামান-জেভি। এর মধ্যে ভদ্রায় মার্কেট নির্মাণের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হরেও শালবাগানে কোনো কাজই শুরু হয়নি।

২০১১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ৮টি বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর প্রতিটিতেই এই দুই মার্কেট নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তব ও আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা ও অগ্রগতি শূন্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এই দুটি কাজের কোনো উল্লেখও নেই। বরং এগুলোকে নতুন করে গৃহীত আলাদা প্রকল্প হিসেবে দেখানো হয়েছে। পরের অর্থবছরে এই দুটি কাজের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।

রাকিস প্রকৌশল শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সিটি কর্পেোরেশনের পিপিপির ভিত্তিতে নেয়া প্রকল্পের একটিরও বাস্তব সুফল অর্জিত হয়নি। সিটি সেন্টারসহ প্রথম তিনটি প্রকল্প পুরোপুরি শেষ করতে দশ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে। পরের ধাপে নেয়া পিপিপির বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজেই শুরু করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। ওই প্রকৌশলী দাবি করেন, পিপিপি’র ভিত্তিতে গৃহীত সবগুলো কাজ পান তৎকালীন মেয়রের ঘনিষ্ঠজনেরা। ফলে শত ব্যর্থতায়ও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। ২০১৩ সালে নতুন মেয়র নির্বাচিত হয়ে প্রথমদিকে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিলেও পরবর্তীতে তিনি পুলিশ হত্যামামলায় কারাবন্দি হন।

এরপর দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র হন প্যানেল মেয়র ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিজাম-উল-আজিম। খায়রুজ্জামান লিটনের শ্বশুরপক্ষের আত্মীয় হিসেবে পরিচিত এই দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়রের সময়কালেও পিপিপি প্রকল্পের ব্যর্থ ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০১৮ সালে মেয়র লিটন দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার চার বছরের মধ্যেই সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে শালবাগান ও ভদ্রা বাজার দুটি নির্মাণের জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু হয়।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন’র “রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন” শীর্ষক প্রকল্পের ২০২২-২৩ অর্থ বছরের ক্রয় পরিকল্পনা শিরোনামে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪১১১১০১ কোডের ঝ ও ঞ নম্বরে ভদ্রা ও শালবাগানে দুটি পৃথক তিনতলা বিশিষ্ট মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে পুরোটাই সরকারি অর্থায়নে নির্মাণ করা হবে। রাসিক সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল এই প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের জন্য ইওআই আহ্বান করা হয়। পরামর্শক নিয়োগের পর উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়, যাতে দুটি বাজার নির্মাণেরই কাজ পায় রূপপুর বালিশকাণ্ডে বিতর্কিত ঠিকাদার মজিদ সন্স অ্যান্ড কন্সট্রাকশন।

রাসিক প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে সিটি নির্বাচনে লিটন মেয়র নির্বাচিত হবার পর রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এই বরাদ্দ থেকেই ৪১ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শালবাগান মার্কেট ও ৩৬ দশমিক ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভদ্রা মার্কেট নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে।

সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্ব আইনের ২৪ (২) ধারা অনুসারে, কোনো প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমূলক, প্রতারণামূলক, চক্রান্তমূলক তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত থাকলে ওই প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ী বা সাময়িকভাবে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করার বিধান আছে। তবে এসবের কিছুই করা হয়নি উল্লিখিত দুই প্রতিষ্ঠান শামসুজ্জামান-জেভি ও কবির এন্টারপ্রাইজের ব্যাপারে।

আরও পড়তে পারেন মজিদ সন্সের নির্মাণাধীন হল ধসের ঘটনায় রাবিতে দুদকের অভিযান

জানতে চাইলে রাসিক প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম পিপিপির ভিত্তিতে এই দুই মার্কেট নির্মাণে সংশ্লিস্টদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘এসব তো আমি দায়িত্ব নেয়ার অনেক আগেকার কথা। তবে যতটুকু জানি যে, ওই সময় এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওইসব ঠিকাদারকে পাইনি। তাদের একজন সামান্য কিছু কাজ করলেও অন্যজন কোনো কাজই করেনি। সে কারণে আমরা ওগুলো বাতিল করে দিয়েছি।’

প্রায় এক যুগ পর নতুন দরপত্রে নির্মাণ করতে গিয়ে যে বাড়তি অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তা সরকারের আর্থিক ক্ষতি কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তাহলে কি করবো? যাদের কোনো খোঁজই নেই তাদের খুঁজতে খুঁজতে সময় পার করবো?’

চুক্তির পরেও কাজ সম্পাদন না করে দীর্ঘ সময় ফেলে রাখার কারণে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার কারণ জানতে চাইলে নূর ইসলাম বলেন, ‘এতে তো আমাদের কোনো টাকাপয়সা ছিলো না। ওরা ওদের নিজেদের টাকায় জিনিসটা করবে। জায়গাটা শুধু আমাদের।’ সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন রাসিক প্রধান প্রকৌশলী।

আরও পড়তে পারেন তবু ‘বালিশ মজিদ’ই বানাবে রাসিক’র দীর্ঘতম ফ্লাইওভার


শর্টলিংকঃ