তবু ‘বালিশ মজিদ’ই বানাবে রাসিক’র দীর্ঘতম ফ্লাইওভার


নিজস্ব প্রতিবেদক: 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নির্মাণাধীন ভবন ধসের ঘটনা আলোচিত হয়। রাজশাহী ওয়াসা ভবন নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। তারও আগে রূপপুরের বালিশকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়ে বিতর্কিত হয় তারা দেশজুড়ে। তারপরেও রাজশাহী মহানগরীর দীর্ঘতম ফ্লাইওভার নির্মাণকাজে সেই মজিদ অ্যান্ড সন্স কন্সট্রাকশনের ওপরই আস্থা রেখেছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক)।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন

এছাড়া আরও দুটি বড় প্রকল্পসহ মোট সিটি করপোরেশনের ১৫৭ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পেয়েছে বিতর্কিত এই প্রতিষ্ঠান।অভিযোগ রয়েছে, রাজশাহীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মজিদ সন্স প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে সরকারি দলের এক প্রভাবশালী নেতার আগ্রহের কারণে। রাবি, রুয়েট, ওয়াসা ও রাসিক- সবখানেই প্রতিটি কাজ বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানটিকে দিতে ওই কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। এ প্রকল্পে ১০৭ ধরনের কাজ করা হবে। এর মধ্যে ছিলো নগরীতে পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ।

সেবছরই ফ্লাইওভারগুলোর নকশা প্রণয়ন ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। ২০২২ সালে এর নকশা চূড়ান্ত করা হলে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে গত বছর রাজশাহী মহানগরীর বর্নালী মোড়, বন্ধগেট ও বিলিসিমলা রেলক্রসিং এলাকার প্রায় ১ কিলোমিটার ২৫৫ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ পায় মজিদ সন্স কন্সট্রাকশন। সম্প্রতি ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্র জানায়, ৫টি ফ্লাইওভারের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ এই ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনকে দেয়ার ব্যাপারে শুরু থেকেই দরপত্র প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের ওপর চাপ ছিলো। প্রভাবশালী একটি মহলের বিশেষ আগ্রহেই এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট ও ওয়াসায় বিভিন্ন কাজ পায় এই মজিদ সন্স কন্সট্রাকশন।

এর ধারাবাহিকতায় রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একটি ফ্লাইওভার ছাড়াও ৪১ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শালবাগান কাঁচা বাজার ও ৩৬ দশমিক ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভদ্রা মার্কেট নির্মাণের কাজও দেয়া হয় মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনকে।

২০১৯ সালে বালিশকাণ্ড দিয়ে প্রথম আলোচনায় আসে মজিদ সন্স। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবাসিক ভবনে আসবাবপত্র সরবরাহে অস্বাভাবিক দাম ধরে দুর্নীতি ও কেনাকাটায় অনিয়ম করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। সেখানে একটি বালিশের পেছনে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা ব্যয় দেখানোর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া এ ঘটনা ‘বালিশ দুর্নীতি’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

২০১৯ সালের মে মাসে এই আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের নথি প্রকাশ করা হয়। তখন গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনস্থ পাবনা পূর্ত শাখার কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত পণ্য ক্রয়মূল্যের নথিতে উল্লিখিত ব্যয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেই কেনাকাটার তালিকায় থাকা পণ্যগুলোর দাম বেশি পাওয়া যায়। ওই বছরের ডিসেম্বরে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৩ জনকে দুর্নীতির জন্য গ্রেপ্তার করে।
বাংলাদেশে একটি বালিশের বাজার মূল্য ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি বালিশের মূল্য দেখানো হয় বাজার মূল্যের প্রায় ২০ গুণ। আবাসন প্রকল্পের অধীনে নির্মিত ফ্ল্যাটে বালিশ তোলার খরচ হিসেবে দেখানো হয় ৯৩১ টাকা। খাট কেনার মূল্য ৪৩ হাজার ৩৫৭ দেখানো হয়েছে। প্রতিটি ডাইনিং টেবিল সেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৪ টাকা।

এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনের নির্মাণাধীন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান হলের ছাদের অংশ ধসে পড়ে। এই অংশটি ছিল ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এবং ৬৯ ফুট প্রশস্ত। জটিল এই কাজে স্পেশাল কোয়ালিটির শাটারিং দরকার হলেও তা দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কনক্রিটের জমাট বাঁধতে সময় লাগে। কলাম ও বিম ঢালাইয়ের পর সেই সময়টাও দেওয়া হয়নি। ঢালাই শক্ত হওয়ার আগেই নতুন করে ঢালাই দেওয়া শুরু হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এই গাফিলতি তখন দেশজুড়ে আলোচিত হয়।

এতোকিছুর পরেও রাজশাহী সিটি করপোরেশন কীভাবে সেই প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখছে, জানতে চাইলে রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর ইসলাম বলেন, সরকার তো তাদের কালোতালিকাভুক্ত করেনি। তাই আমাদের কিছুই করার নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন হলের ছাদ ধসের ঘটনার পর আমরা তাদের ব্যাপারে বেশ সতর্ক। কাজের ক্ষেত্রে তাদের সিমেন্ট ও রডের মান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রকৌশলী সার্বক্ষণিক তাদের কাজ তদারকি করছে।

এদিকে রোববার দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিদ সন্স কন্সট্রাকশনের নির্মাণাধীন ভবনে ধসের ঘটনায় ঠিকাদারি কাজের নথিপত্র অনুসন্ধানে ক্যাম্পাসে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সময় তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারসহ ভবন নির্মাণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখতে চান। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকেও করা হয় জিজ্ঞাসাবাদ।

দুদকের রাজশাহী জেলার উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ভবন ধসের ঘটনায় দুদকের জেলার একটি টিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করছে। ওই টিমের সাথে ভবন নির্মাণের প্রকৌশলীও রয়েছে। দুদকের উপ-পরিচালক আরো জানান, ভবনটির কারিগরি ত্রুটি চিহ্নিত করতে সিভিল বিভাগের প্রকৌশলীদের সঙ্গে রাখা হয়েছে। তদন্ত শেষে কাউকে অভিযুক্ত পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আরও পড়তে পারেন রূপপুর বালিশকাণ্ডের হোতা মাজিদ এবার রাবির ভবনে


শর্টলিংকঃ