ইউএনভি ডেস্ক:
বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকায় অর্ধশত বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে পটকা তৈরির অবৈধ কারখানা। ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে আনা বিস্ফোরক (বারুদ) দিয়ে পটকা তৈরি করা হয় প্রশাসনের নাকের ডগায়। পটকা তৈরির পর শহরের চুরপট্টি মার্কেটে দোকানিদের কাছে পাইকারি দরে বিক্রি করা হয়। দুই ঈদ, দুর্গাপূজাসহ বিভিন্ন উৎসব ঘিরে এই মার্কেটে ব্যবসা থাকে জমজমাট। লেনদেন হয় কোটি টাকার।
গত রোববার রাত ৯টার দিকে মালতিনগর এলাকার মোল্লাপাড়ায় খড়ি ব্যবসায়ী রেজাউল করিম ও রাশেদুল ইসলামের বাড়িতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর অবৈধ এই কারবার নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন। বিস্ফোরণে বাড়িতে থাকা তিন কিশোরীসহ চার নারী আহত হয়েছেন। তারা চিকিৎসাধীন। অনেকে বলছেন, এই কারবার এলাকার সবার জন্য বিপজ্জনক হলেও পুলিশ কখনও তাদের বাধা দিয়েছে এমনটি জানা নেই।
মালতিনগরের এমএস ক্লাব মাঠ, মোল্লাপাড়া ও ভাটকান্দি এলাকায় ঘরে ঘরে নারীরা পটকা তৈরির কাজ করেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, এমএস ক্লাব মাঠ এলাকার ওয়াজেদ আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম, নাসির হোসেন ও মো. বসির পটকা কারখানাগুলো পরিচালনা করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তাদের স্বল্প পরিসরে বিস্ফোরক (বারুদ) আমদানি সাপেক্ষে পটকা তৈরির লাইসেন্স দেওয়া থাকলেও নিয়মনীতি মানেন না তারা।
অভিযোগ উঠেছে, পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে ঘরে ঘরে কারখানা গড়ে তুলেছেন তিন সহোদর ভাই। ১৯৮৯ সালে পটকা তৈরির সময় বারুদের বিস্ফোরণে তাদের বাবা ওয়াজেদ আলী, মা নেবুর জান ও ৩ বছর বয়সী এক বোন নিহত হন। ২০২০ সালে এমএস ক্লাব মাঠ এলাকায় পটকা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে নিজ বাড়িতে শচীন নামের এক যুবক নিহত হন। এর পরও টনক নড়েনি জেলা প্রশাসন বা পুলিশের।
ভারত থেকে চোরাইপথে যেভাবে আসে বারুদ
উত্তরাঞ্চলের তিন সীমান্ত জয়পুরহাটের হিলি, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা ও লালমনিরহাটের বুড়িমারী দিয়ে প্রতিদিনই ভারত থেকে বারুদ আনা হয়। একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গোয়েন্দা শাখা সূত্রে জানা গেছে, এই তিন সীমান্ত দিয়ে আনা বারুদ প্রতিদিন অর্ধশত নারী-পুরুষ বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন। তারা বাজারের ব্যাগে করে নানা কৌশলে বিস্ফোরক বহন করেন।
বসতবাড়িতে যেভাবে তৈরি হয় পটকা
পটকার মূল উৎপাদক তিন ভাই রফিকুল, নাসির ও বসির এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। তাদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি পটকা তৈরির সরঞ্জাম বারুদ, সুতা, আঠা ও ফয়েল প্যাকেট এবং শক্ত বিশেষ এক রকম কাগজ পৌঁছে দেওয়া হয়। বাড়িতে বসে নারীরা প্রতি হাজার পটকা তৈরির জন্য ১০০ টাকা পারিশ্রমিক পান। প্রথমে কাগজে বারুদ ভরে সুতা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পর আঠা দিয়ে ফয়েল প্যাকেটে মুড়িয়ে তৈরি হয় পটকা। নিম্নবিত্ত পরিবারের নারীরা এ কাজে জড়িয়ে পড়েছেন।
আটক রেজাউলের স্বীকারোক্তিতে এসেছে রফিকুলের নাম
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রোববার রাতে বিস্ফোরণের পর আটক রেজাউল স্বীকার করেছেন তিনি, তাঁর মা রেজিয়া ও স্ত্রী রেবেকা ইসলাম পটকা তৈরিতে জড়িত। রেজাউল জিজ্ঞাসাবাদে রফিকুলের পরামর্শে পটকা তৈরির কথা জানিয়েছেন।
এদিকে এমএস ক্লাব মাঠের সঙ্গে রফিকুলদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় দরজায় তালা ঝুলছে। তাঁর প্রয়াত বড় ভাইয়ের স্ত্রী আয়েশা বেগম বলেন, ‘তাদের লাইসেন্স থাকায় ঈদে ও পূজায় পটকা তৈরি করা হয়। রোববার রাতে বিস্ফোরণের পর থেকে রফিকুলসহ তিন ভাই বাড়িতে নেই। সেখানে কীভাবে কী হয়েছে, আমরা জানি না। মামলা হলে টাকা-পয়সা দিয়ে সব ম্যানেজ করা যাবে। ইচ্ছা করে তো কিছু ঘটানো হয়নি।’
এলাকার বাসিন্দা মুদি ব্যবসায়ী দুলাল মুন্সী বলেন, বিস্ফোরণের পর থেকে সহোদর তিনজনকে এলাকায় দেখিনি। শুধু জানি, তারা বাড়ি বাড়ি মালপত্র দিয়ে পটকা তৈরি করিয়ে নেন। পুলিশ কখনও তাদের বাধা দিয়েছে এমনটি জানা নেই।
সাকিব আল হাসান নামে একজন বলেন, মোল্লাপাড়ায় অন্তত ২০ বাড়িতে পটকা তৈরি হয়। বিস্ফোরণের পর সব বাড়ি থেকে পটকা তৈরির সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি এলাকার সবার জন্য বিপজ্জনক।
বাড়িতে গিয়ে রফিকুলের দেখা পাওয়া না গেলেও কথা হয় মোবাইল ফোনে। তিনি নজরুলকে দিয়ে পটকা বানানোর কথা স্বীকার করে বলেন, ‘ঈদের সময় বানানোর জন্য তাদের কিছু সামগ্রী দেওয়া হয়েছিল। হয়তো সেই সময়ের বেঁচে যাওয়া কিছু সামগ্রী তাঁর বাড়িতে ছিল। তবে বারুদের বিস্ফোরণে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়। নিম্নবিত্ত নারীরা যাতে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারেন, এ জন্য তাদের কাজ দেওয়া হয়। কারও ক্ষতি তো কেউ চাই না। বারুদ কীভাবে ক্রয় করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে চীন থেকে বারুদ আমদানি করা হতো। এখন ভারত থেকে আসা পটকা ভেঙে সেগুলোর বারুদ দিয়ে দেশীয় পটকা বানানো হয়।
বগুড়া পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সিপার আল বখতিয়ার বলেন, আবাসিক এলাকায় প্রকাশ্যে পটকার এমন কারবার হলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কয়েকবার এগুলো বন্ধের চেষ্টা করেছিলাম। তবে বারবার কারবারের ধরন পাল্টানোয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।
কর্মকর্তারা যা বলেন
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরাফত ইসলাম বলেন, পুলিশের মাসোহারা নেওয়া বা আগে থেকে পটকার কারখানাগুলোর বিষয়ে জানা থাকার অভিযোগ সঠিক নয়। স্থানীয় কেউ কখনও এসব বিষয়ে অবগত করেননি। তবে কারও বিরুদ্ধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, পটকা উৎপাদনের অনুমোদন কাউকে দেওয়া থাকলেও আবাসিক এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ নেই। নজরদারির কোনো কমতি ছিল কিনা খতিয়ে দেখা হবে। এসব অবৈধ পটকার কারখানা বা উৎপাদন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে