‘বঞ্চিত’ কাউন্সিলরদের দক্ষিণে বরাদ্দ ৫০ লাখ, উত্তরে ৩ কোটি


ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেছে। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে এই সময়ের মধ্যে কোনও কাউন্সিলর করপোরেশনের ঠিকাদারি কাজ বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেননি। এতে অনেকটাই ক্ষুব্ধ কাউন্সিলররা। এমতাবস্থায় ‘বঞ্চিত’ কাউন্সিলরদের ক্ষোভ দমাতে দক্ষিণ সিটির প্রত্যেক কাউন্সিলরের অনুকূলে ৫০ লাখ টাকা করে এবং উত্তর সিটিতে তিন কোটি টাকা করে বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। কাউন্সিলরদের হাতে কাজের প্রত্যয়নের সুযোগ রেখে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে টেন্ডারের মাধ্যমে এই টাকা খরচ করা হবে।
জানা যায়, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রত্যেক কাউন্সিলরের কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়। অনেকের ক্ষেত্রে এ খরচ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তাছাড়া দৈনন্দিন ওয়ার্ডের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও তাদের যোগ দিতে হয়। কিন্তু সেই তুলনায় তাদের আয় নেই। ক্ষমতা চর্চার জায়গাও সীমিত। আইনি বাধ্যবধকতা থাকায় তারা সরাসরি করপোরেশনের বিভিন্ন টেন্ডার কাজে অংশ নিতে পারেন না। মেয়রদের পক্ষেও কাউন্সিলরদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। আবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে আসার পর অনেকেই তাদের স্ত্রী বা আত্মীয়-স্বজনদের নামে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করলেও টেন্ডার শিডিউলের শর্তের বেড়াজালে কাজ পান না।
এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন ধরে দুই সিটির কাউন্সিলররা তাদের অনুকূলে উন্নয়ন কাজের বরাদ্দ দেওয়ার দাবি করে আসছিলেন। এভাবে তাদের পাঁচ বছর মেয়াদের প্রায় সাড়ে চার বছর কেটে গেছে। শেষ মুহূর্তে কাউন্সিলরদের দাবিতে সাড়া দিয়েছেন দুই মেয়র। সংস্থা দুটির বোর্ড সভায় এমন দাবি উঠলে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রত্যেক কাউন্সিলরের জন্য ৫০ লাখ টাকা ও উত্তর সিটি তিন কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা যায় আইনি জটিলতা। পরে ভিন্ন মোড়কে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাউন্সিলরদের এ সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সিটি করপোরেশন।

যেভাবে বরাদ্দ হবে টাকা
বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কাউন্সিলররা তাদের ওয়ার্ডের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব করবেন। প্রস্তাব অনুযায়ী মেয়র বরাদ্দ দেবেন। তবে সেই প্রকল্প সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্টে (ই-জিপি) টেন্ডার হবে। টেন্ডারপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজের ওপর কাউন্সিলরদের প্রত্যয়নের সুযোগ থাকবে। সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলর তার দেওয়া প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে মর্মে প্রত্যয়ন দিলে ওই ঠিকাদার তাদের বিল উত্তোলন করতে পারবেন।

এর আগেও দুই সিটির প্রতিটি উন্নয়ন কাজে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরের প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক ছিল। তখন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে কাউন্সিলরদের কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠার পর সেই নিয়ম বাতিল করে সিটি করপোরেশন। ফলে উন্নয়ন কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে কাউন্সিলরদের কমিশন বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। এতে ক্ষুদ্ধ হতে থাকেন তারা। এ নিয়ে কাউন্সিলর ও মেয়রদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। অনেক কাউন্সিলর বোর্ড সভাসহ নগর ভবনে আসাও বন্ধ করে দেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কাউন্সিলর  বলেন, ‘নির্বাচনে যেসব টাকা খরচ হয়েছে সেই টাকা তো তুলতে হবে। কিন্তু কীভাবে? কাউন্সিলরা তো কোনও টেন্ডার কাজে অংশ নিতে পারেন না। প্রতিদিন ওয়ার্ডের নাগরিকদের বিভিন্ন সমস্যায় দান-অনুদান দিতে হয়। অনেকের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কাজ না পাওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে। বিভিন্ন সময় কউন্সিলরদের বোর্ড সভাই তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা আইনগত জটিলতা থাকলেও ভিন্ন কোনও উপয়ে বিশেষ বরাদ্দের জন্য মেয়রের কাছে আবেদন করেছেন।

বোর্ড সভায় অনুমোদন

দুই সিটি সূত্র জানায়, কাউন্সিলরদের দীর্ঘদিনের দাবি আমলে নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর ২৮ তম বোর্ড সভায় তাদের অর্থকমিটির সভায় প্রত্যেক কাউন্সিলরের অনুকূলে তিন কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করে। অপরদিকে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গত ১ সেপ্টেম্বর তাদের ১৯তম বোর্ড সভায় কাউন্সিলরদের অনুকূলে ৫০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
জানতে চাইলে উত্তর সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আছাসার উদ্দিন খান বলেন, ‘আমাদের অর্থ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রত্যেক কাউন্সিলরকে তিন কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়ার কথা। সেটি বাস্তবায়ন হবে সম্পূর্ণ টেন্ডারের মাধ্যমে। আমাদের (কাউন্সিলর) শুধু প্রত্যয়ন দেওয়ার ক্ষমতা আছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু হলেও এক-দেড় কোটি টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।’
এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিব মোস্তফা কামাল মজুমদার বলেন, ‘আমাদের গত বোর্ড সভায় প্রত্যেক কাউন্সিলরের অনুকূলে ৫০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে সেটি হবে সরকারি নিয়ম বা টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে কাউন্সিলর তার ওয়ার্ডের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব করবেন। তার অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হবে। কাজটি কারবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সে ক্ষেত্রে কাউন্সিলর শুধু কাজটি সঠিকভাবে হয়েছে কিনা সেটির প্রত্যয়ন করবেন।’

কমিশন বাণিজ্যের শঙ্কা
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নতুন করে শুধু এই বরাদ্দে কাউন্সিলরদের হাতে প্রত্যয়নের ক্ষমতা তুলে দেওয়ার অর্থই হচ্ছে কমিশন বাণিজ্যের ‘বৈধতা’ দেওয়া। তারা বলছেন, এই বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়েছে কাউন্সিলদের আয়ের জন্য। তা না হলে অন্য কোনও প্রকল্পে তাদের প্রত্যয়নের প্রয়োজন না হলে, কেন এ ধরনের প্রকল্পে প্রত্যয়নের ব্যবস্থা রাখা হলো?
বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছি, ওয়ার্ডভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ রাখার। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। তবে অবশ্যই তাতে সব ধরনের নিয়ম নীতি অনুসরণ করতে হবে। কাউন্সিলরের প্রত্যয়নের নামে যেন কোনও ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য একটি নীতিমালাও করতে হবে।’
এই নগর পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, ‘এই বরাদ্দের উদ্দেশ্য যদি হয় কাউন্সিলরদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া, তাহলে সেটি হবে অনৈতিক ও অবৈধ। যদি সরকারের সব নিয়ম মেনেই বরাদ্দটি বাস্তবায়ন করা হয় সেটি ইতিবাচক হবে।’


শর্টলিংকঃ