মানুষের কল্যাণই ধ্যানজ্ঞান


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দর্শন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছেন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রায় ছয় বছর প্রবাসে থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৮১ সালে বর্ষণমুখর এক অপরাহ্ণে তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেদিন মানুষ তাঁকে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে স্বাগত জানায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য সাংবিধানিকভাবে দায়মুক্তির আদেশসহ যে অভিশপ্ত সময় শুরু; শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তার বিরুদ্ধে আলোর পথযাত্রা সূচিত হয়। আমরা যখন শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা জানাচ্ছিলাম, তখন সেই বর্ষণমুখর অপরাহ্ণে সমবেত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, আমি ঢাকা এসেছি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের জন্য নয়; ফিরে এসেছি আপনাদের স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত করার জন্য এবং গণতন্ত্রের পথে পরিচালনার জন্য।

সেদিন যা বলেছিলেন, পর্যায়ক্রমে আমরা দেখলাম সে কাজটিই তিনি করে চলেছেন। ১৯৮১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি, বিরোধীদলীয় নেতা, জাতীয় সংসদের নেতা এবং সরকারপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাধারণ মানুষ হিসেবে লক্ষ্য করি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন, সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা– এসব বিষয় শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে দেশে আবার ফিরে আসে।

আজকে আমরা দেশে উন্নয়নের কথা বলি, অবকাঠামো ও অনেক মেগা প্রকল্পের কথাও বলা যায়। এগুলো মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। সেই সঙ্গে এই দেশে অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ– অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু আমাদের যে নীতি দিয়ে গেছেন, সেই লক্ষ্যেও তিনি এগিয়ে চলেছেন।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। জনপ্রিয়তার কারণে এত দীর্ঘ সময় তিনি সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর জন্যই আজ আমরা স্বপ্নের সোনার বাংলার পথে এগিয়ে চলেছি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, পৃথিবীকে আমরা শান্তির দুনিয়া হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্ন ও ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেগুলোই বাস্তবায়ন করছেন।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশন যোগ দিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ভাষায়, ‘আজ আপনাদের সবার কাছে, বিশ্বনেতাদের কাছে আমার আবেদন– যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করুন এবং আমাদের জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী শান্তি, মানবজাতির কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করুন।’ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের সরকারপ্রধান বিশ্বনেতাদের কাছে যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন। এভাবে আমরা দেখতে পাই, তিনি শুধু বাংলাদেশের নেতা নন; বরং বিশ্বনেতা হয়ে উঠছেন।

২০১৮ সালে টাইম ম্যাগাজিন বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী মানুষের তালিকা করেছিল। সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাম ছিল সমুজ্জ্বল। কারণ তাঁর কাজ ও কথা স্বতন্ত্র এবং তা দিয়ে তিনি বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছেছেন। আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তিনি ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের মানুষ ঠিকানাবিহীন থাকবে না। অর্থাৎ গৃহহীন মানুষকে ঘর দিতে হবে, তাকে একটি ঠিকানা দিতে হবে। সেই লক্ষ্যে তিনি আশ্রয়হীন অনেক মানুষকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছেন।

ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতিচারণ রয়েছে। বিশেষ করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। যেখানে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও নারীশিক্ষার প্রতি অনুরাগের প্রমাণ পাই। ২০০৯ সালে জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল কংগ্রেসে আমরা নোবেল বিজয়ী রসায়নবিদ অধ্যাপক ইয়ান টি লিকে আমন্ত্রণ জানাই। কংগ্রেস শেষ করে তিনি যেদিন চলে যাবেন, সেদিন সকালে হঠাৎ করে আমাকে বলেন, আমি যে দেশে যাই, সে দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং শিক্ষা বিষয়ে আলোচনা করি। সে সুযোগ পাওয়া যাবে কিনা। আমি বললাম, চেষ্টা করে দেখি। সেদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের শিডিউল ছিল। তারপরও প্রধানমন্ত্রী সকালে আমাদের সময় দিলেন। আমরা একসঙ্গে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এরপর আমরা যখন ফিরছিলাম, গাড়িতে বসে ইয়ান টি লি আমাকে বললেন, ‘তোমরা খুবই ভাগ্যবান। কারণ এমন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছো, যিনি শিক্ষার খুঁটিনাটি সব বিষয় জানেন এবং শিক্ষার গভীরে চিন্তাভাবনা করেন।’ শিক্ষার বিস্তারিত পরিসংখ্যান দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বলছিলেন, তা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর।

নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী জাগরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। নারীরা আজ বাংলাদেশে সর্বত্র অংশগ্রহণ করছে। তিনি নারীদের কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, একটি ঘটনা তার প্রমাণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত কাজের চূড়ান্ত অনুমোদন একনেক সভায় দেওয়া হয়। এক একনেক সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুবিধা দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে আমাদের আর্থিক বরাদ্দ এবং একটি নির্দেশনা দেন। তিনি বলেছিলেন, যখনই আপনি ছাত্রদের জন্য কোনো আবাসিক হলের প্রস্তাব নিয়ে আসবেন, একই সঙ্গে ছাত্রীদের আবাসিক হলের প্রস্তাবও উল্লেখ করবেন। যাতে একই প্রকল্পে উভয়ের আবাসনের ব্যবস্থা হয়। আজকে নারীশিক্ষা ও নারীর উন্নয়নের গোড়ায় রয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা একজন শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী। প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। কারণ, তিনি তরুণ প্রজন্মের শিক্ষা অর্জন, তাদের কর্মোপযোগী করা এবং তাদের সত্যিকার অর্থে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে চান। তা ছাড়া তিনি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাতেও গুরুত্ব দিয়েছেন। গ্রামের স্কুলে এখন ছেলের চেয়ে মেয়ের সংখ্যা বেশি। নারীশিক্ষায় তিনি সবসময় জোর দিয়েছেন। এমনকি সম্প্রতি জাতিসংঘের অধিবেশনে তিনি বলেছেন, জাতিসংঘের মহাসচিব পদে কেন এখনও নারী আসেনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে এসেছেন। একই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাঠ্যক্রমের সর্বত্র যুক্ত করেছেন। গণমানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার চিন্তাচেতনা, তাঁর কর্মদক্ষতা, দেশপ্রেম ও মূল্যবোধ– এ সার্বিক বিষয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি পঙ্‌ক্তি আমার স্মরণে আসে। শেখ হাসিনার জন্মদিনে তা উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করছি। ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।’

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক: প্রাক্তন উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


শর্টলিংকঃ