মোগল সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী নারীরা


মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসের গভীরে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে সাম্রাজ্যের প্রায় সব ক’জন সম্রাটের ওপর কোনো না কোনো নারীর প্রভাব ছিল। পৃথিবীর যেকোনো রাজবংশ বা রাজনীতির সঙ্গেই নারীর যোগ দেখা যায়—কখনো স্পষ্ট, কখনো নেপথ্যে। মোগল ইতিহাসে নূর জাহান ও জাহানারা বেগম পরিচিতি পেয়েছেন তাদের জ্ঞান, প্রতিভা, দূরদর্শিতার জন্য। আনারকলির কাহিনীতে অতিরিক্ত রঙ মেশানো হলেও তিনি পরিচিত। আকবরের দুধ-মা মাহাম আঙ্গার নামও অনেকে জানেন। কিন্তু মোগল শাসনের প্রতিষ্ঠাতা যে বাবুর, তার জীবনেও যে দুজন নারীর বড় প্রভাব ছিল, সে কথা ইতিহাসের জনপ্রিয় স্রোতে ততটা আলোচিত নয়।

বাবুরের পিতা উমর শেখ মির্জা ছিলেন তৈমুরের চতুর্থ অধস্তন পুরুষ। তৈমুর এক বিস্তীর্ণ ভূমি অধিকার করলেও সেখানে তিনি শাসন ব্যবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হননি। ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন, তৈমুরের সে যোগ্যতা ছিল না। আর কেউ বলেন, তৈমুরের সেদিকে আগ্রহ ছিল না। সে যা-ই হোক না কেন, তৈমুরের এ অজ্ঞতা বা উদাসীনতার কারণেই তার বিজিত ভূমি পরবর্তী সময়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আর সে ভূমির একেকটি খণ্ডাংশ দখল করে ‘রাজ্য’ স্থাপন করে তারই আত্মীয়, বংশধররা।

উমর শেখ মির্জা ছিলেন ফারগানার শাসনকর্তা। ছোট্ট একটা পাহাড়ি রাজ্য ফারগানা। অনেকটা সময়ই বরফে ঢাকা থাকে। তৈমুরের মতো না হলেও উমর শেখ উচ্চাভিলাষী ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন কিছুটা অলস। বাবুর নিজেই তার রোজনামচায় সে কথা লিখেছেন। পিতার সমালোচনা করলেও তিনি সেই রোজনামচাতেই প্রশংসা করেছেন তার নানি আসিয়া দৌলত বেগমের। কেননা বাবুরের ‘বাদশাহ্ বাবুর’ হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান চেঙ্গিসের বংশধর আসিয়া দৌলতের (আইসান/এসান দৌলত নাম বেশি পরিচিত)।

পিতার মৃত্যুর পর বাবুরকে রক্ষা করেছিলেন তার এই মাতামহী। ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে উমর শেখ মির্জার যখন মৃত্যু হয়, বাবুরের বয়স তখন কেবল ১১। ছোট রাজ্য হলেও ফারগানার সিংহাসনে বসার লোভ ছিল অনেকের। কিংবা নিজে না বসলেও অন্য কাউকে বসিয়ে নিজের ফায়দা আদায় করার চিন্তাও কম লোকে করেনি। নাবালক বাবুর যেন পিতার উত্তরাধিকারে বঞ্চিত হন, উমর শেখের সত্কারের আগেই সেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সে সময় থেকেই আসিয়া দৌলত বেগম বাবুরকে নানা পরামর্শ দিতে শুরু করেন।

কবুতরের চবুতরা ভেঙে উমর শেখের মৃত্যু হয়। এ দুর্ঘটনা মূলত আকসি কেল্লায় ঘটেছিল। বাবুর তখন ছিলেন আন্দিজানে। আন্দিজান ফারগানার একটি জেলা। সাধারণত শাসনকর্তা, সুলতান বা রাজার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী অনেক সময়েই আক্রমণের সম্মুখীন হয়। আর বাবুর যেহেতু ১১ বছরের নাবালক, তার ক্ষেত্রে এ আশঙ্কা খুবই বেশি ছিল। তাই বাবুরের জন্য আসিয়া দৌলতের প্রথম পরামর্শ ছিল বাবুর যেন দ্রুত কোনো বিশ্বস্ত অমাত্যের সাহায্য নিয়ে আত্মগোপন করেন।

বাবুর যখন আন্দিজান থেকে নিজেকে রক্ষা করে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছতে সক্ষম হন এবং ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দের জুনে পিতার মৃত্যুর কিছুদিন পর ফারগানার সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন মূলত বাবুর সিংহাসনে ছিলেন উমর শেখের উত্তরাধিকারী হিসেবে আলংকারিক শাসনকর্তা। বাবুরের পক্ষে সিদ্ধান্তগুলো নিতেন আসিয়া দৌলত বেগম। তার পরামর্শেই বাবুর সিংহাসনে আরোহণ করে প্রধান প্রধান অমাত্যকে বদলি করেন। প্রায় কাউকেই তিনি পদচ্যুত করেননি, বরং যার কাছ থেকে ক্ষতির আশঙ্কা ছিল তাকে দূরে প্রেরণ করেছেন। এখানেই আসিয়া দৌলতের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে, কেননা পদচ্যুত করলে বাবুরের প্রতি সরাসরি আক্রমণ করা তাদের জন্য সহজ হতো। পাশাপাশি এখান থেকে আরেকটি বিষয় বোঝা যায়, আসিয়া দৌলত ভালো করেই জানতেন, বাবুরের জন্য কে ক্ষতিকর আর কে বন্ধুভাবাপন্ন। অর্থাৎ তিনি ফারগানার রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন।

বাবুর নিজেই তার রোজনামচায় তার মাতামহী আসিয়া দৌলত সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং সেই প্রশংসার মধ্যেই বাবুরের কৃতজ্ঞতা বোঝা যায়। বাবুর লিখেছেন, ‘খুব কম নারীই আমার মাতামহীর মতো উপদেশ দেয়া বা পরিস্থিতি বিচার করার সামর্থ্য রাখেন।’

মূলত বাবুর যখন ১২ বছর বয়সে ফারগানার সিংহাসনে আরোহণ করেন, সে সময়ে তার রাজনীতি বা সমরনীতি সম্পর্কে ধারণা ছিল সামান্যই। দ্বিতীয়ত, পিতৃহীন এ নাবালক সম্রাটের নানা সময়েই দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হতো, যে সক্ষমতা তার ছিল না। আসিয়া দৌলত ঠিক এ কাজটিই বাবুরের হয়ে করে দিতেন। যেমন সিংহাসন আরোহণের কিছুদিনের মাঝেই হাসান-ই-ইয়াকুব নামে এক অমাত্য বাবুরের বদলে বাবুরের সৎ ভাই জাহাঙ্গীর মির্জাকে ফারগানার সিংহাসনে বসানোর জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেন এবং স্বাভাবিকভাবেই আরো অমাত্য তার সঙ্গে যোগ দেন। এদের মধ্যে বাকির বেগ, সুলতান মোহম্মদ দুলাদি অন্যতম।

বিশ্বাসঘাতক যেমন ছিল, বিশ্বস্ত মানুষও ছিল। বাবুরের অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তার পিতার দুধ-ভাই ওয়াজির খান। উমর শেখের মৃত্যুর পর থেকে নানা সময়ে তিনি বাবুরের রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন। ওয়াজির খান নিজে আসিয়া দৌলতের রাজনৈতিক চিন্তা, ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করতেন। হাসান-ই-ইয়াকুবের ষড়যন্ত্র জানামাত্রই আসিয়া দৌলত একটি সেনাদল প্রেরণ করে তাদের কয়েদ করার ব্যবস্থা করে। অকুস্থলে গিয়ে ইয়াকুবের সমর্থকদের পাওয়া গেলেও ইয়াকুবকে পাওয়া যায়নি। ইয়াকুব পালিয়ে গিয়ে সুলতান মাহমুদ মির্জার সাহায্য প্রার্থনা করবেন, এমন চিন্তা ছিল তার। কিন্তু হাসান-ই-ইয়াকুব সে চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নতুন পরিকল্পনা নেন যে আকসি দুর্গ আক্রমণ ও দখল করে সেখানেই তিনি শিবির তৈরি করবেন।

এখানেও আসিয়া দৌলত সব খবর সংগ্রহ করেন। উমর শেখের আমলের অমাত্য খাজা কাজী, কাসিম কিলিচের সহায়তায় আসিয়া দৌলত দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ শত্রুকে হত্যা করতে সক্ষম হন। পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়নে আসিয়া দৌলত অসাধারণ সূক্ষ্মতা এবং সময়ের সদ্ব্যবহার করতেন। বাবুর লিখেছেন, ‘কৌশল ও কার্যপদ্ধতি ঠিক করায় তার জুড়ি মেলা ভার। আসিয়া দৌলত বুদ্ধিমতী ও চমত্কার সংগঠক ছিলেন।’

আসিয়া দৌলতের এ প্রজ্ঞা মূলত গড়ে উঠেছিল তার পারিবারিক আবহ থেকে। আসিয়া দৌলত চেঙ্গিস খানের সরাসরি বংশধর। চেঙ্গিসের বংশের নারীরা অসম সাহসী হতেন। চেঙ্গিসের ইতিহাস পড়লে তার মেয়েদের সম্পর্কে জানা যায়। চেঙ্গিসের দ্বিতীয় পুত্র চাগাতাইয়ের বংশধর আসিয়া দৌলতের বিয়ে হয় ইউনুস খানের সঙ্গে। প্রাথমিক জীবনেই আসিয়া দৌলত রাজনৈতিক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক সূত্র তাকে একজন গায়িকা, চিত্রশিল্পী হিসেবেও বর্ণনা করে। এমন আসিয়া দৌলতের কন্যা কুতলুঘ নিগারও যে দৃঢ় চরিত্রের হবেন তাতে আর সন্দেহ কি?

বাবুরের জন্মদাত্রী কুতলুঘ নিগার ছিলেন ইউনুস খান ও আসিয়া দৌলত দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান। ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে তত্কালীন শাহজাদা উমর শেখের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বাবুরের জন্ম হয় এর আট বছর পর ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে। বাবুরের জীবনে যে দুজন নারী সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখছেন, তাদের একজন আসিয়া দৌলত এবং অন্যজন কুতলুঘ নিগার। যদিও হ্যারল্ড ল্যাম্ব তার ‘বাবুর দ্য টাইগার’ বইয়ে কুতলুঘ নিগারকে খুব সাধারণ করে এঁকেছেন, কিন্তু আসিয়া দৌলতের চরিত্র দেখে কুতলুঘ নিগারকে সাধারণ মনে হয় না। এমনকি বাবুর নিজে লিখেছেন তার ‘গেরিলা জীবনের যুদ্ধে’ তার মা সব সময় তার সঙ্গে ছিলেন।

বাবুরের এ গেরিলা জীবন নিয়ে কিছু না বললে তার জীবন এবং জীবনের সঙ্গে আসিয়া দৌলত ও কুতলুঘ নিগারের গুরুত্ব বোঝা যাবে না। এ লেখার শুরুর দিকেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ফারগানা এবং এর আশপাশের সব ভূমিই তৈমুরের বংশধরেরা শাসন করতেন। মূলত এরা সবাই ছিলেন জ্ঞাতি আত্মীয়। কিন্তু আত্মীয় হলেও সদ্ভাব একদমই ছিল না। যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। একজন দখল করতে চাইত অন্যের রাজ্য। যেহেতু বাবুর ছিলেন নাবালক, হুমকি তার জন্য বেশি ছিল।

উমর শেখের মৃত্যুর পর কুতলুঘ নিগার খানুমই বলা চলে আঁচলের নিচে লুকিয়ে রেখে বাবুরকে বাঁচিয়ে সিংহাসন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ফারগানার সিংহাসন লাভ করার পর মাতা ও মাতামহীর নিরাপত্তা ও পরামর্শের কল্যাণে বাবুর সমরকন্দ পর্যন্ত দখল করেন। কিন্তু এখানেই একটু গোল বেঁধে যায়। ১০০ দিন সমরকন্দ দখলে রাখার পর বাবুর একদিকে হারান সমরকন্দ, অন্যদিকে পিতৃভূমি ফারগানা। এরপর তার দীর্ঘদিনের যাযাবর জীবন। এ সময়েই বাবুর তার হূত রাজ্য উদ্ধারে ‘গেরিলা পদ্ধতিতে’ বেশকিছু যুদ্ধ করেন।

বাবুরের এই যাযাবর জীবন বাবুরকে কখনো হতাশ কখনো সুরাপায়ী করে তুলেছিল। বাবুর নিজেকে এক ভাগ্যাহত যাযাবর সুলতান, রাজ্যহীন রাজা বলে অভিহিত করেছেন। এ সময়ে তাকে সেই হতাশা, মাতাল জীবন থেকে টেনে এনেছেন আসিয়া দৌলত ও কুতলুঘ নিগার। পাশাপাশি বাবুরের শক্তি বৃদ্ধির জন্য এক গোত্রপতির কন্যার সঙ্গে তার বিয়ের আয়োজনও করা হয়।

বাবুরের এই যাযাবর জীবন যেমন দীর্ঘ তেমনি বৈচিত্র্যময়। নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তিনি পৌঁছেছিলেন খাইবারে। সে পর্যন্ত পৌঁছতে তাকে মনোবল জুগিয়েছিলেন তার মাতা কুতলুঘ নিগার আর মাতামহ আসিয়া দৌলত।

 

তথ্যসূত্র:

১. The Baburnama : Zairuddin Muhammad Babur,

Translated by Wheeler M. Thackston, The Modern Library (2020)

২. বাবুর দ্য টাইগার, হ্যারল্ড ল্যাম্ব, অনুবাদ: যায়নুদ্দিন সানী, দিব্য প্রকাশ (২০১৬)

৩. মোগলনামা (প্রথম খণ্ড): মাহমুদুর রহমান, আহমদ পাবলিশিং হাউজ (২০১৯)

 

মাহমুদুর রহমান: লেখক


শর্টলিংকঃ