মোগল রাজনীতির দুই সন্ধিক্ষণে গুলবদনের তৎপরতা


রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী যিনি

মোগল দরবারের রাজ্য ও রাজনীতির ইতিহাসে গুলবদন বেগমের (১৫২৩-১৬০৩) অবস্থান আদতে কী ছিল, সে সম্পর্কে আলোচনা খুব একটা সুলভ নয়। বরং তার নাম বেশি উঠে আসে নিজের বৈমাত্রেয় ভাই সম্রাট হুমায়ুনের ওপর লেখা বই ‘হুমায়ুন-নামা’-র সূত্রে।

সর্বোপরি, জনমানসে তার বিদূষী ইতিহাস-রচয়িতার পরিচয়টিই অধিকতর জনপ্রিয় নানা কারণে। কিন্তু মোগল সাম্রাজ্যের অন্দরমহলের রাজনীতিতেও গুলবদনের ভূমিকা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মোটেও ন্যূনতম ছিল না। উল্লেখ্য, সেই ভূমিকার কথা প্রচ্ছন্নরূপে ‘হুমায়ুন-নামা’-তেও লিপিবদ্ধ—যদিও তা নিয়ে কথাবার্তা হয় কম। কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রসঙ্গটিও ব্যাপকভাবে আলোচনা হওয়ার যোগ্য। এ নিবন্ধে তেমন দুটি নমুনাই উপস্থাপিত।

ভ্রাতৃবধূ নির্বাচনের নেপথ্যে যখন সমঝোতার কৌশল

গুলবদনের কিশোরীবেলার কথাই ধরা যাক। বাবরের মৃত্যুর পর গুলবদন তার ভাইদের সিংহাসন নিয়ে লড়াই দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও মোগল দরবারে বাবার উত্তরসূরি হিসেবে তিনি যে হুমায়ুনকেই দেখতে পছন্দ করবেন, সেই মনোভাব লুকিয়ে রাখতে চাননি। কারণ তার ভাইদের মধ্যে তিনি হুমায়ুনকেই সবচেয়ে বিবেচক, দক্ষ যোদ্ধা ও যোগ্য শাসক বলে গণ্য করতেন।

পারিবারিক পরিমণ্ডলে তার প্রথম সফল পদক্ষেপ সম্ভবত সখী হামিদা বানু বেগমের সঙ্গে অগ্রজ হুমায়ুনের বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করা। তখন হুমায়ুনের ঘোর দুঃসময়—আফগান আক্রমণের মুখে তাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, তখন সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার দূরে থাক এমনকি প্রাণধারণ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। কিন্তু তখনো তিনি হাবুডুবু খাচ্ছেন হামিদা বানুর প্রেমে। ওদিকে ধারণা করা হয়, হামিদা বানু ওই সময়েই হুমায়ুনের ছোট ভাই মির্জা হিন্দালের প্রতি মৃদু ভালোলাগায় আচ্ছন্ন।

কিন্তু নিজের থেকে পাঁচ বছরের ছোট এই সখীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে বিয়েটা যাতে হয়, সেজন্য গুলবদন জোর তৎপরতা আরম্ভ করলেন। এক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখ করতেই হয়, হিন্দাল ছিলেন গুলবদনের আপন বড় ভাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি বৈমাত্রেয় ভাই হুমায়ুনের সঙ্গে হামিদা বানুর পরিণয় ঘটাতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিলেন। কেন এমনটি হলো, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

যাহোক, গুলবদন পরে তার মা—দিলদার বেগমকে কাজে লাগালেন হামিদা বানুর মন গলাতে। দিলদার বেগম গুলবদনের পরামর্শে হামিদা বানুকে সরাসরি এ প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি একজন সম্রাটের চেয়ে শ্রেয়তর আর কাকে বিয়ে করবে? তেমন কি কেউ এখানে আছে?’ এ অমোঘ প্রশ্নের উত্তর দোদুল্যমনা কিশোরীকে মনস্থির করতে সাহায্য করল, গুলবদনের তৎপরতা পেল সাফল্য। ধারণা করতে পারি, হামিদা-হুমায়ুনের পরিণয় ঘটাতে গুলবদনের এ উদ্যোগ বড় ভাইয়ের হূদয়ের আকুলতাকে পরিণয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া বা বাল্যসখীকে ভবিষ্যতের রাজসম্রাজ্ঞীরূপে প্রতিষ্ঠিত করবার উদ্দেশ্যে ছিল না।

বস্তুত, ওই বিরুদ্ধ সময়ে এ একটি বিয়ে মোগল বংশের সুরক্ষা ও হুমায়ুনের সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে বলেই গুলবদন হামিদা-হুমায়ুনের পরিণয় ঘটাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। কেমন সেই সহায়তা? আদতে, হামিদা বানু ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের—আর হুমায়ুন-গুলবদনরা সুন্নি। ওই বিরুদ্ধ সময়ে কোনো অভিজাত শিয়া নারীকে বিয়ে করলে হুমায়ুন তার বিরোধী শিয়া গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রশমন করা এবং কাছে টানার একটা অছিলা পাবেন—বুদ্ধিমতী গুলবদন এমনটাই ভেবেছিলেন।

হয়তো সর্বাংশে না হলেও যুদ্ধ-তৎপরতার কূটনীতিতে খানিক হলেও শিয়াদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এ বিয়ে হুমায়ুনকে সহায়তা করেছিল—এটাও প্রকৃতপক্ষে গুলবদনের দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয়বাহী।

একটি সম্ভাব্য সংঘাতের অম্লমধুর সমাপ্তি

ভাই হুমায়ুনের ঔরসে বাল্যসখী হামিদা বানু বেগমের গর্ভে জন্ম গুলবদনের যে ভ্রাতুষ্পুত্র আকবরের, সেই জগত্খ্যাত আকবরও তার এ বিদূষী ফুফুকে মর্যাদা দিতে ও প্রয়োজনে তার পরামর্শ নিতে দ্বিধা করেননি। বস্তুত, গুলবদনের জগৎ পুরোটাই ছিল তার মোগল দরবারের অন্দরমহল ও পরিপার্শ্বের রাজনীতিকে ঘিরে। এ কারণে তার সতের বছর বয়সে বিয়ে করা স্বামী খিজির খাজা খানকে এ সময়ের দৃশ্যপটে খুব একটা দেখা যায় না।

আকবরের বয়স যখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, তখন যুবরাজ সেলিমের অকস্মাৎ বিদ্রোহ প্রশমন করতেও আশি বছরের প্রবীণা গুলবদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। দুই ভাই মুরাদ ও দানিয়েলের মৃত্যুর পর যুবরাজ সেলিম বা ভবিষ্যতের সম্রাট জাহাঙ্গীর তখন অনেকটাই বেপরোয়া। এর মাঝেই তিনি এলাহাবাদে গিয়ে নিজেকে রীতিমতো সম্রাটের মেজাজে উদ্ভট কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছিলেন—নিজেকে মোগল সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে নিজেই ঘোষণা দেয়া, নিজের নামে মুদ্রা বাজারে ছাড়া, জুমার নামাজের শান্ত পরিবেশে খুতবার সময় আকবরকে ভুয়া সম্রাট ও নিজেকে আসল সম্রাট বলে হইহল্লা করা ইত্যাদি। পাশাপাশি আফিম ও সুরার নেশায় মেতে থাকা তো আছেই। এর মাঝে আকবর তার প্রিয় সভাসদ আবুল ফজলকে দাক্ষিণাত্য থেকে এলাহাবাদে পাঠালেন, সেলিমকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করার আশায়।

কিন্তু পথেই সেলিমের হুকুম মোতাবেক তার লোকজন নির্মমভাবে আবুল ফজলের শিরচ্ছেদ করে ও মাথাটা এলাহাবাদে পাঠিয়ে দেয়। এমন খারাপ খবর পেয়ে আকবর রেগেমেগে আগুন হয়ে সেলিমকে চূড়ান্তভাবে সিংহাসনের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেই গিয়েছিলেন, এমনকি সৈন্যদল পাঠিয়ে পুত্রকেই খতম করবেন এমন ভাবনাও ছিল।

ঠিক এ মুহূর্তেই দৃশ্যপটে প্রবেশ ঘটল গুলবদনের। পিতা চরম ক্রোধান্বিত এ কথা জেনে সেলিম আগ্রায় ফিরে আসছিলেন। কিন্তু আকবর তার এ বেয়াড়া পুত্রকে দেখা দিতে চাইছিলেন না। এমন সময় গুলবদন হামিদা বানুকে সঙ্গে নিয়ে আকবরের সঙ্গে দেখা করলেন। ফুফু গুলবদন ভাইপো আকবরকে বোঝালেন, যত খারাপ কাজই করে থাকুক না কেন সেলিম—তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মোগল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী নির্বাচন করাটা ভুল হবে। বরঞ্চ একটা সমঝোতার দিকে যাওয়াই ভালো। আর শাসন করার জন্য হলেও সেলিমকে রাজদরবারে ঢুকতে দিতে তো হবে শেষমেশ।

আকবর ফুফুর কথা ফেলতে পারেননি, উপরন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন ফুফুর কথাতে তার মায়েরও সম্মতির সিলমোহর পাকা। অন্যদিকে সেলিমকে গুলবদন বুঝিয়েছিলেন, বাবার মন গলাতে হলে বিনয়ী আচরণ করতে হবে, দরকার হলে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতেও হবে। যেমন কথা তেমনি কাজ, বিদ্রোহ ও এতসব হঠকারী কাজকর্ম করার পর ছেলে যখন ফের বাবার সঙ্গে মুখোমুখি—প্রথম মুহূর্তেই সোজা গিয়ে পা ধরে মাফ চাওয়ার কাণ্ডটি ঘটেই গেল।

আকবর আবেগে হোক বা গুলবদনের পরামর্শে— শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী ও ক্ষ্যাপা শাহজাদা সেলিমকে মাফ করে দিতে রাজি হলেন। তবে মাফ করলেও সেলিমের আশু সংশোধন প্রয়োজন বলে তিনি মনে করছিলেন। এ ব্যাপারেও শেষমেশ তাকে পরামর্শ নিতে হলো গুলবদনের। গুলবদনের মত অনুযায়ী, সেলিমকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ঘরে কয়েক মাস আটকে রাখার বন্দোবস্ত করা হলো।

যাতে তার মন শান্ত হয় ও আফিম-মদের নেশা থেকে মুক্ত হয়ে ওঠেন। গুলবদনের এ নিদানে সেলিমের চারিত্রিক উন্নতি খানিক ঘটেছিল (তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে হলেও), সন্দেহ নেই। এভাবেই গুলবদনের তৎপরতায় মোগল দরবারে ক্রমেই ঘনিয়ে ওঠা একটি সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তি হয়ে যায়।

ইতিবাচক পরিস্থিতির নির্মাতা

মোগল রাজনীতির এ দুই মুুহূর্তে গুলবদনের তৎপরতা কতটা রাজনীতির অনুষঙ্গে ছিল আর কতটা পারিবারিক ঝামেলা মেটানোর জন্য—তা নিয়ে বিতর্ক অবশ্য কেউ কেউ করতে পারেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায় ওই দুই সময়খণ্ডে গুলবদনের ভূমিকা মোগল সাম্রাজ্যের জন্য স্বস্তির আবহ আনতে বা ইতিবাচক পরিস্থিতি নির্মাণে সহায়তা করেছিল। বৈমাত্রেয় ভাই হওয়া সত্ত্বেও যোগ্যতা অনুযায়ী মোগল সাম্রাজ্যের লাগসই উত্তরসূরি হিসেবে হুমায়ুনের পক্ষে অবস্থান নেয়া ও পরবর্তীকালে হুমায়ুন-হামিদা বানুর বিয়ে দেয়ার নেপথ্যে তার তৎপরতা যে সঠিক ছিল—তা তো ইতিহাসই প্রমাণ করেছে।

হুমায়ুন-হামিদার সন্তান সম্রাট আকবরও তার ফুফু গুলবদনের এ প্রজ্ঞার অনুরাগী ছিলেন। এবং গুলবদনের তৎপরতার কারণেই আকবরকে নিজের সন্তান সেলিমকে হননে শেষমেশ উদ্যত হতে হয়নি। পারস্পরিক উত্তেজনা প্রশমন করে মোগল দরবারে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা ও সেলিমকে যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তৈরি করার নেপথ্যে গুলবদনের এ সূক্ষ্ম তৎপরতা তুলনামূলকভাবে অনালোচিত হলেও অশেষ গুরুত্ববাহী।

মোগল ইতিহাসে তাই গুলবদনের মূল্যায়ন কেবল ‘হুমায়ুন-নামা’-র রচয়িত্রী বা স্রেফ একজন পড়াশোনা-জানা শাহজাদী হিসেবে হোক এমনটা কাঙ্ক্ষিত নয়। এর পাশাপাশি একজন দক্ষ ‘ডিল-মেকার’ বা ‘পিস-মেকার’ হিসেবেও তাকে বিবেচনায় নেয়া জরুরি বৈকি।

সূত্র:

গুলবদন: পোর্ট্রেট অব আ মোগল প্রিন্সেস—রুমার গডেন

ডটার্স অব দ্য সান: এম্পেসেস, কুইনস অ্যান্ড বেগমস অব দ্য মোগল এম্পায়ার—ইরা মুখোটি

মহল: পাওয়ার অ্যান্ড প্যাজেন্ট্রি ইন দ্য মোগল হারেম—সুভদ্রা সেন গুপ্ত

মোগল বিদুষী—ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

মুহিত হাসান: নন-ফিকশন লেখক


শর্টলিংকঃ