রাজশাহীর যে গ্রামে শতভাগ বাল্য বিয়ে!


ইউএনভি ডেস্ক:

রাজশাহীর সীমান্তবর্তী পদ্মার চরের শেষ গ্রামটির নাম এখন চর খানপুর। এর আগে এই গ্রামের নাম ছিল চর খিদিরপুর। পদ্মার প্রবল ভাঙনে খিদিরপুর ধুধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। এই গ্রামের কন্যা শিশুদের বিয়ের চিত্র দেখলে মনে হয় সময়টা উনিশ শতকেই থেমে আছে এখানে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশুদের বিয়ে দেওয়া হয়। ষষ্ঠ শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে পারেনি কোনো মেয়েই। সেই হিসেবে বলা যায়, খানপুর গ্রামটি শতভাগ বাল্য বিয়ের গ্রাম।


জানতে চাইলে খানপুর গ্রামের ইউপি মেম্বার আব্দুল কাদের সারাবাংলাকে বলেন, এখানকার সবাই নিম্নমানের জীবনযাপন করেন। পড়ালেখা নেই, উন্নত জীবনের জন্য কোনো পরিকল্পনা নেই। মাছ ধরা আর সামান্য ফসল আবাদ করে জীবীকা নির্বাহ করতে হয়। কাজেই মেয়েরা একটু বড় হলেই তাকে বিয়ে দিয়ে চিন্তামুক্ত হয় পরিবার।

এক প্রশ্নের জবাবে মেম্বার বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের নজরদারি থাকা দরকার। একজন জনপ্রতিনিধি কতটুকু করতে পারেন। বড়জোর প্রশাসনকে বলতে পারেন। কিন্তু সেই প্রশাসনই যদি না আসেন এই গ্রামে তবে কিভাবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করবেন। বছরে একবার পুলিশ এই গ্রামে আসেন কি না তা জানা নেই। বিজিবির ছোট একটি ক্যাম্প রয়েছে তারা তো সবসময় সীমান্ত পাহারা নিয়েই ব্যস্ত।

আছিয়া নামে এই গ্রামের এক কিশোরী বললো, আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছি। বাবা-মা বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমি চাই শিক্ষিত হয়ে শহরে গিয়ে চাকরি করতে। আমি চাই না অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাক।

আছিয়ারা চার বোন, ছয় ভাই। তিন বোনের চতুর্থ শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় বিয়ে হয়ে গেছে। এক বোন সন্তান জন্ম দিতে রাজশাহী নেওয়ার সময় পদ্মার চরে নৌকা আটকে গেলে মারা যায়। আরও এক বোনের দুই সন্তান জন্মের সময় মারা যায়। এই গ্রামে ভালো স্কুল কলেজ নেই। ডাক্তার নেই। কমিউনিটি ক্লিনিকও নেই। একজন হাতুরে ডাক্তার আছেন। তিনি সব জায়গায় ছুটে গেলেও প্রসূতি সেবা দেওয়ার জন্য সকলকে রাজশাহীতে ছুটতে হয়।

গত ১৪ ডিসেম্বর চর খানপুরে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আরেক কিশোরী আফসানার সাথে। আফসানা জানায়, তারা চার ভাই দুই বোন। বোনের মধ্যে বড় সে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে বসে আছে। পরিবারের সাথে কৃষিকাজ ও পশু লালন পালন করছে সে। এক ভাই রাজশাহী শহরে চায়ের দোকান দিয়েছে। সে রাজশাহীতেই থাকে। পরিবার বলেছে, এক মাসের মধ্যে তাকে বিয়ে দেবে। কিন্তু আফসানা বিয়ে করতে চান না।

আফসানা জানায়, তার চার বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়। তাদের সবার কোলে বাচ্চা রয়েছে। তাদের দেখিয়ে দিয়ে আফসানার বাবা তাকেও বিয়ে দিতে চায়। তবে মায়ের ইচ্ছা আফসানাকে পড়াশোনা করে বড় করার। কিন্তু কোনো উপায় পাচ্ছে না আফসানা।

আফসানার বাবা আব্দুল জলিল সারাবাংলাকে বলেন, বিয়ে না দিয়ে কি করবো বলেন? এখানকার নিয়মটাই এমন। পরিবেশ যদি ভালো হতো, তাহলে ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করাতাম। স্কুল বন্ধ, বিদ্যুৎ নেই, বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই, অর্থ সংস্থানের কোনো ক্ষেত্র নেই, তাহলে কি করার আছে আপনারাই বলেন।

খানপুর ক্যাম্পের কাছে জাহানারা নামে এক নারীর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, পদ্মার ভাঙনের হাত থেকে বাঁচতে এখন পর্যন্ত ৮ বার বাড়ি সরাতে হয়েছে। এখানেও থাকতে পারবো কিনা সন্দেহ রয়েছে।

জানতে চাইলে খানপুর বিজিবি ক্যাম্পের কমান্ডার মানিক দেবনাথ সারাবাংলাকে বলেন, সীমান্ত রক্ষায় আমরা সর্বদা প্রস্তুত থাকি। এর বাইরে আমরা গ্রামবাসীকে নানাভাবে সহযোগিতা করে থাকি। কখনো ওষুধ, কখনো খাদ্য সামগ্রী, আবার কখনো ইঞ্জিনচালিত স্পিডবোটও দিয়ে থাকি। তবে সেটি সব সসয় পারি না। তিনি বলেন, এখানে বাল্য বিয়ে শতভাগ হয়ে থাকে। যেখানে গ্রামের মাটির অস্তিত্ব বিলীনের পথে সেখানে কতটুকু সচেতন করা যায়। তাছাড়া প্রশাসনের অন্যান্য সংস্থাগুলো এখানে কাজ করলে হয়তো কিছুটা প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। সচেতন হওয়ার জন্য রেডিও, টেলিভিশন, স্মার্ট মোবাইল ফোন যার কিছুই নেই এই গ্রামে। সোলার আসায় কেউ কেউ বাটন মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তবে হাতে গোনা কয়েকজন।


শর্টলিংকঃ