‘আহা, আজি এ বসন্তে…’


নিজস্ব প্রতিবেদক :

‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়।’ হ্যাঁ, বসন্ত এসে গেছে। স্বর্গের কানন সাজাতে পল্লব এখন মঞ্জুরিত। কোকিলের উদাস করা গানের সুরে দু’হাত বাড়িয়ে নব যৌবনে এখন শুধু তাকে গলায় পরার পালা। শিমুলের আঁচল ধরে কবিগুরুও সেই সুখ জাগানিয়া আহ্বান জানিয়ে গেছেন উদোম হাওয়া আর শুভ্র মেঘে। তাইতো পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আজ আগুনঝরা উচ্ছ্বলতা।

মডেল: এসএম মোস্তাক আহমেদ খান বিপিএম, পিপিএম ও তাঁর সহধর্মিনী

বসন্ত এসে গেছে- আজ পহেলা ফাল্গুন, ঋতুরাজের প্রথম দিন। ফুলের উচ্ছ্বাসে হাসছে আকাশ, কাঁপছে বাতাস, দুলছে আম্রমুকুল। অকারণের সুখে অলক্ষ্যে রঙ লাগছে অশোকে-কিংশুকে। মেঠোপথের ধারে কারও জন্য অপেক্ষা না করেই ফুটছে নাম না-জানা অসংখ্য সব ফুলেরা। তরুণ মনে বিহ্বলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে কোকিলের ডাক। সে সুরের আবেগে প্রকৃতিতে বসন্তের রঙ লেগেছে ক’দিন ধরেই- তবে দিনপঞ্জির হিসাবে তার অভিষেক আজকের নতুন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে।

ফুল ফুটেছে। ফুলের মধু খেতে আসছে পাখি। এই ফুল থেকে ওই ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৌমাছি। রুক্ষ গাছ ছেয়ে যাচ্ছে নবপল্লবে। শুকনো পাতারা পড়ে আছে মাটিতে। ফুল ফুটেছে, বুলবুলি এসেছে মধু খেতে। নগরের প্রকৃতিপ্রেমীরাও প্রকৃতির এই নবরূপকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত।

শিমুল গাছের ফুল থেকে মধু খাচ্ছে টিয়া পাখি। ছবিটি রাজশাহী নগরীর শ্রীরাম পুর এলাকা থেকে তোলা।

বাংলাদেশের মানুষের জীবনে ঋতুরাজ বসন্ত নিয়ে আসে প্রেম ও বিদ্রোহের যুগল আবাহন। সে আবাহনে আজ খুলে গেছে দখিনা দুয়ার। তাইতো মানব-মানবীর হৃদয়ের বেদিতে আজ প্রজাপতির রঙিন পাখা, মৌমাছির গুনগুনানি, বৃক্ষ-লতা-গুল্ম, ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে, শাখায় শাখায়, ঘাসে ঘাসে, নদীর কিনারে, কুঞ্জ-বীথিকা আর অরণ্য-পর্বতে নবযৌবনের বান ডেকেছে।

তার অবগাহন রঙিন করবে তরুণ-তরুণীর প্রাণকেও। তাদের প্রাণেও অনুরণিত হবে বাউল করিমের ভাষা, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে’।

বসন্তের প্রথম সকাল।

মেয়েরা আজ সে গন্ধ মাখা খোঁপায় গাঁদা-পলাশসহ নানা রকম ফুলের মালা গুঁজে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরবে, ছেলেরা পাঞ্জাবি-পায়জামা ও ফতুয়ায় শাশ্বত বাঙালির সাজে উৎসবের হাওয়ায় ভেসে বেড়াবেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, টিএসসি প্রাঙ্গণ, পদ্মপাড়সহ নগরীর এখানে-ওখানে। ফোনে, ফেসবুক, গুগল প্লাস ও টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমেও চলছে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়।

তবে শুধু প্রাণের দুরন্ত আবেগ আর প্রেমে নয়, এ ঋতুতে বাংলার মানুষ জেগে ওঠে দ্রোহে-প্রতিবাদে। আগুনরাঙা এই ফাল্গুনে অশোক-পলাশ-শিমুলের রঙ শুধু প্রকৃতিতেই উচ্ছ্বাসের রঙ ছড়ায় না, ছড়ায় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্ত-রঙিন স্মৃতির ওপরও।

বায়ান্নর ৮ ফাল্গুন; তথা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার মিলেমিশে একাকার। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার চেয়ে বাংলার তরুণরা রক্ত ঝরিয়েছে এ ঋতুতে। তাই ফাগুন এলেই আগুন জ্বলে মনে, ফাগুন এলেই কোকিল ডাকে কুঞ্জে। প্রকৃতির সেই রূপতরঙ্গে দুলে উঠে কবিগুরু গেয়ে ওঠেন, ‘ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে।’

রাজশাহীর গাছে গাছে শিমুল ফুল।

পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত উৎসবের রঙে মেতে ওঠে তরুণ হৃদয়, নতুন করে প্রাণ পান প্রবীণেরা। বসন্তে শুধু প্রকৃতিই নয়, হৃদয়ও রাঙা হয়ে ওঠে। বসন্ত তাই অনেকের কাছে ‘প্রেমের ঋতু’। সে ঋতুতে চোখে নেশা লাগে, দিক ভুল হয়; বাসনা বিলাসে বাড়ে আশা, বৃদ্ধি পায় মনের সুপ্ত তিয়াশা। তারই রেশ ধরে শচীন কর্তার মতো তাই সকলের মনে অনুরণিত হয়, ‘শোন গো দখিনা হাওয়া/ প্রেম করেছি আমি’।

প্রেম বিলিয়ে এ ঋতুতে শিমুল-পলাশের ডালে বসে তাকে কাছে টানবে কোকিল, পাপিয়া, ময়না। ফুলের মধু খেতে আসবে পাখি। এই ফুল থেকে ওই ফুলে ঘুরবে মৌমাছি। মাটিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতাদের পাশ কাটিয়ে জাগবে নতুন প্রাণ। নিষ্প্রাণ প্রায় এই কংক্রিটের শহরে ভালোবাসার সে কুহুস্বরে মুখর পরিবেশে মন যেন কোনো উদাসলোকে হারিয়ে যেতে যায়। মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ জানিয়ে দিয়ে যায়, সত্যি সত্যি বসন্ত ঋতুর রাজা।

রাজশাহীর গাছে গাছে শিমুল ফুল।

মোগল সম্রাট আকবর দূর অতীতে ১৫৮৫ সালে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল ‘বসন্ত উৎসব’। এদিকে, পহেলা ফাল্গুনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। রাবির চারুকলায় দিনব্যাপী পিঠা উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া বাংলা বিভাগ, ফোকলোর বিভাগসহ প্রায় সকল বিভাগে পৃথক পৃথকভাবে পহেলা ফাল্গুনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

এদিকে, মহানগরীর পদ্মাপাড়ের বিনোদন স্পটগুলোতেও বসন্ত বরণে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বসন্ত বরণকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি না ঘটে এজন্য সতর্ক রয়েছে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ। এদিন, সন্ধ্যার মধ্যে নগরীর বিনোদন স্পটগুলো ত্যাগ করার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আরএমপি কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার।


শর্টলিংকঃ