ইরানি নির্মাতার দণ্ড এবং তুষারাবৃত পথ


২৪ মে ২০২৪। কান চলচ্চিত্র উৎসবের এবারের আসরে প্রতিযোগিতা বিভাগে প্রদর্শিত হবে ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ সিনেমাটি। ২ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটের সিনেমাটি বানিয়েছেন ইরানি নির্মাতা মোহাম্মদ রাসুলফ। ইরানের বিচারব্যবস্থা তুলে ধরা হয়েছে, এমন অভিযোগ এনে দেশটির সরকার সিনেমাটি কান উৎসব থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।

দণ্ডিত নির্মাতা
মোহাম্মদ রাসুলফ ইরানের অন্যতম খ্যাতিমান পরিচালকদের একজন। তাঁর সিনেমা ইরানে প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০১০ সালে তিনি ইরানের আরেক কিংবদন্তি পরিচালক জাফর পানাহির সঙ্গে ছয় বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। পাশাপাশি তাঁর সিনেমা নির্মাণের ওপর ২০ বছরের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী প্রচারণার অভিযোগ আনা হয়। পরে সাজা এক বছর কমিয়ে দেওয়া হয় এবং তিনি জামিনে মুক্তি পান।

২০১১ সালে রাসুলফের ‘গুডবাই’ সিনেমা কান চলচ্চিত্র উৎসবের আঁ সার্তে রিগা বিভাগে প্রতিযোগিতা করে সেরা সিনেমার পুরস্কার অর্জন করে। সিনেমাটি ছিল সেন্সরশিপ নিয়ে তৈরি

২০১৭ সালে টেলুরিড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘আ ম্যান অব ইন্টেগ্রিটি’ প্রদর্শনীর পর রাসুলফ দেশে ফিরে এলে তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। এ সিনেমায়ও ইরানের দুর্নীতি ও অবিচারের গল্প উঠে এসেছে বলে অভিযোগ করা হয়।

এরপর খুব গোপনে মোহাম্মদ রাসুলফ নির্মাণ করেন তাঁর ষষ্ঠ সিনেমা ‘দেয়ার ইজ নো এভিল’। ২০২০ সালে সিনেমাটি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেয় এবং টপ প্রাইজ গোল্ডেন বিয়ার বা স্বর্ণভালুক জেতে। কিন্তু দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় রাসুলফ পুরস্কার গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর পক্ষে মেয়ে বারান রাসুলফ গ্রহণ করেন সেই পুরস্কার। বারান নিজেও অভিনয় করেছেন ‘দেয়ার ইজ নো এভিল’-এ। সিনেমার কাহিনি গড়ে উঠেছে মৃত্যুদণ্ডকে কেন্দ্র করে।

২০২৩ সালে আঁ সার্তে রিগা বিভাগের জুরি সদস্য হিসেবে কানে অংশ নেওয়ার কথা ছিল রাসুলফের। কিন্তু তার আগেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২২ সালের মে মাসে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর আবাদানে নির্মাণাধীন একটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন ধসে পড়ে। এতে প্রায় ৪১ জন নিহত হন এবং আহত হন ৩৭ জন। মোহাম্মদ রাসুলফ এ ঘটনার সমালোচনা করেন। এ অপরাধে ওই বছরের জুলাই মাসে গ্রেপ্তার হন তিনি।

পরে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে সাময়িকভাবে কারাগার থেকে মুক্তি পান। কিন্তু সরকারবিরোধী সব ধরনের প্রচারণা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয় ইরানি কর্তৃপক্ষ।

তুষারাবৃত পথ
ইরান সরকারের চাপের মুখেও মোহাম্মদ রাসুলফ তাঁর ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে প্রত্যাহার করে নেননি। ফলে ইরান সরকার তাঁকে আট বছরের কারাদণ্ড দেয়। সেই সঙ্গে চাবুক মারা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করারও নির্দেশ দেয়।

রাসুলফ কানে ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ সিনেমার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারে উপস্থিত থাকতে পারবেন না, সেটাই সবাই ধরে নিয়েছিলেন। কারণ, দেশত্যাগে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু একজন নির্মাতা তো পথ তৈরি করেন। রাসুলফ পথ তৈরি করেছেন। দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়েই গোপনে দেশত্যাগ করেছেন। তা-ও আবার কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৭তম আসর শুরুর আগের দিন ১৩ মে নিজের ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট দিয়ে নিজেই দেশত্যাগের খবর জানিয়েছেন।

ইনস্টাগ্রামে দেওয়া পোস্টে তুষারাবৃত একটি এলাকার ছবি পোস্ট করেছেন। পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘ ও কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে আমি কিছুদিন আগে ইউরোপে পৌঁছেছি। মাসখানেক আগে আমাকে আমার আইনজীবী জানিয়েছেন, আমার আট বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আপিল আদালত এবং সেটা শিগগিরই বাস্তবায়িত হবে। এটা জেনে রাখুন যে শিগগিরই আমার নতুন একটি সিনেমা রিলিজ হবে এবং এই আট বছরে আমার বিরুদ্ধে নতুন আরেকটি সাজার আদেশ হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমার কাছে খুব বেশি সময় ছিল না। আমার কাছে দুটি সুযোগ ছিল—কারাগার বেছে নেওয়া, নয়তো দেশত্যাগ করা। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি নির্বাসিত জীবন বেছে নিলাম।’

যে তুষারাবৃত পথ পেরিয়ে মোহাম্মদ রাসুলফ ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছেন, বেছে নিয়েছেন নির্বাসিত জীবন, সেই তুষারাবৃত পথই কি কানের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগ থেকে তাঁকে এনে দেবে আরেকটি স্বর্ণমুকুট! ২৫ মে জানা যাবে সে উত্তর।


শর্টলিংকঃ