নিজস্ব প্রতিবেদক:
নাটোরের সিংড়ায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অপহরণ করে পিটিয়ে আহত করার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় এখনও পুলিশ গ্রেফতার করতে করতে পারেনি লুৎফুল হাবিব রুবেলকে। তিনি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক ও সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক।
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি শেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
গত ১৫ এপ্রিল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী দেলোয়ার হোসেনকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে মারধরের অভিযোগ ওঠে রুবেলের বিরুদ্ধে। দেলোয়ার এখনও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।
ওই ঘটনায় বৃহস্পতিবার রুবেলকে নির্বাচন কমিশনে তলব করা হয়। পরদিন শুক্রবার উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকেও তাকে কারণ দর্শাতে করা হয়। নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজনদেরও প্রার্থী হতে দল থেকে নিষেধ করা হলে প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক রুবেলের প্রসঙ্গও আসে।
শুক্রবার হাসপাতালে গিয়ে দেলোয়ারকে দেখে এসে দুঃখ প্রকাশ করেন সিংড়ার এমপি পলক। পরে রুবেলকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। রুবেল ভিডিওবার্তায় সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে অনুগত এক স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের হাতে মনোনয়ন প্রত্যাহারের চিঠি নির্বাচন কমিশনে দাখিল করেন।
এদিকে অপহরণ ও হামলার শিকার চেয়ারম্যান প্রার্থী দেলোয়ারের ভাই মজিবর রহমান বাদী হয়ে নাটোর সদর থানায় যে মামলাটি দায়ের করেন, সেটির তদন্তে নেমে পুলিশ অপহরণে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো চ-৫৬-৫৩৯৫) ও একটি ব্যক্তিগত গাড়ি উদ্ধার করে। অপহরণের সময় ধারণকৃত সিসি ফুটেজে এই দুটো গাড়িই দেখা যায়। অপহরণে মাইক্রোবাস ব্যবহৃত হয় আর প্রাইভেট কারটি সেটিকে অনুসরন করেন। এ ঘটনায় আটকও করা হয় দুজনকে। তারা সবাই প্রতিমন্ত্রীর শ্যালকের খাস লোক বলে পরিচিত। উদ্ধারকৃত মাইক্রোবাস থেকে পলকের শ্যালকের লিফলেট ও পোস্টার ছাড়াও বিপুল পরিমাণ দেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
নাটোরের পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম দাবি করেন, আটক মাইক্রোবাসের মালিকানা কার নামে, তা জানতে বিআরটিএতে চিঠি দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে জবাব এলেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে প্রতিমন্ত্রীর শ্যালকের একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, অপহরণে ব্যবহৃত মাইক্রোবাসটির মালিক পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবিব রুবেল স্বয়ং। গাড়ির সঙ্গে এর কাগজপত্র যা রয়েছে, তা বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। এরপরেও পুলিশ এখনও রুবেলকে গ্রেফতার করেনি।
যদিও এ ঘটনায় গ্রেপ্তার যুবলীগ নেতা সুমন আহমেদ মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) সন্ধ্যায় নাটোরের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী লুৎফুল হাবীবের পক্ষ নিয়েই তারা দেলোয়ার হোসেনকে অপহরণ ও মারধর করেছেন।
নাটোরের পুলিশ সুপার দাবি করেন, তারা কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছেন তারা।
প্রতিমন্ত্রীর ভূমিকা কী?
অল্প বয়সে সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী হয়ে যাওয়া জুনাইদ আহমেদ পলক তার শ্যালকের এই বেপরোয়া কাণ্ডের পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে আহত দেলোয়ারকে দেখে যান। সেখানে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমাও চান। পরবর্তীতে তিনি তার শ্যালককে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোরও নির্দেশ দেন।
নাটোরের একাধিক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অপহরণের বিষয়টি মিডিয়ায় আসার পর দলের হাইকমান্ডের চাপের মুখে পলক এসব কাজ করেছেন। যদিও শ্যালক রুবেলের উত্থান ও ক্ষমতার দাপট সবই প্রতিমন্ত্রীর হাত ধরেই হয়েছে।
একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবরে বলা হয়, এই উপজেলা নির্বাচনে নিজের শ্যালককে একক প্রার্থী করতে প্রতিমন্ত্রী তার ঢাকার বাসায় সবাইকে ডেকে বৈঠক করেন। চেয়ারম্যান হতে নির্বাচনী মাঠে নেমেছিলেন উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি কামরান হাসান কামরুল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম ভোলা, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ও কলম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য দেলোয়ার হোসেন- এ চার প্রার্থীও। কিন্তু নিজের শ্যালককে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতাতে বাকি প্রার্থীদের নির্বাচন না করার নির্দেশ দেন প্রতিমন্ত্রী পলক। সেজন্য একজনকে পুকুর উপহার দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে বেঁকে বসেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দেলোয়ার হোসেন। প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় গত ১৫ এপ্রিল সোমবার তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে মারধর করা হয় বলে ওই পত্রিকাটি জানিয়েছে।
নির্বাচনী মাঠে চার প্রতিদ্বন্দ্বী থাকায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হওয়া নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক রুবেল। সংকট মোকাবিলায় প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে গত ২৯ মার্চ তার ঢাকার বাসায় সমঝোতা বৈঠক হয়। সেখানে ছিলেন বৈঠকে জাহেদুল ইসলাম ভোলাসহ সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস, আরিফুল ইসলাম, মাওলানা রুহুল আমিন ও পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবীব রুবেল। সেখানে লুৎফুল হাবীবকে একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। সে সময় একক প্রার্থী হিসেবে শ্যালককে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন পলক। সে ধারাবাহিকতায় এলাকায় ফিরে নির্বাচন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন প্রার্থী জাহেদুল ইসলাম ভোলা। হুমকির স্বরে প্রতিমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের কথা অপর তিন প্রার্থীকে জানালেও নির্বাচন থেকে দুজন সরে যান বলে জানিয়েছে দেশের একটি জাতীয় দৈনিক। ওই বৈঠকের একটি ছবিও প্রকাশ করেছে দৈনিক পত্রিকাটি।