‘কালান্তর’: রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সত্তা অবলোকন


এটি প্রায় তর্কাতীত যে রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার প্রধান সাহিত্যিক। সাহিত্যের সমান্তরালে রাজনীতি, সমাজ, স্বদেশ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিশ্ব-পরিসর: সর্বোপরি মানবচিন্তা, কিছুই তার ভাবনার অগম্য ছিল না। রবীন্দ্রনাথের বিপুল রচনাসম্ভারের স্তরে স্তরে সঞ্চিত রয়েছে সেই সর্বগামী ভাবনার ছাপ ও ছায়া। যার সম্মুখে দাঁড়িয়ে একালেও আমরা বিস্মিত হই; তার ভাবনা বিশ্বের ব্যাপকতায় ক্ষেত্রবিশেষে অবাক মানি। প্রবন্ধ সংকলন ‘কালান্তর’ রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়সের রচনা। প্রাণবান-কিংবদন্তি, শতায়ু অরবিন্দ পোদ্দার জানাচ্ছেন: ‘দুঃখে মর্মবেদনায় ক্রোধে দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতায় যৌক্তিক পারম্পর্যে নিবিষ্ট এমন প্রবন্ধ পাঠের অভিজ্ঞতা সুদুর্লভ।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত; দীর্ঘ ২৩ বছরের রবীন্দ্রচিন্তার বিচিত্র বীজশস্য সঞ্চিত রয়েছে এখানে।

‘কালান্তর’-এর প্রবন্ধগুলোর বক্তব্য, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতির নিরিখে ব্যাখ্যার প্রয়াস দেখিয়েছেন তিনি। তবে সব প্রসঙ্গকে অতিক্রম করে তার রাজনৈতিক চিন্তা ও ভাবধারাই এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা সম্পর্কে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূল্যায়ন এ প্রসঙ্গে উল্লেখের অবকাশ রয়েছে: ‘সমাজসেবাকে তিনি রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখেননি।’ তার দীর্ঘ জীবন হতেও প্রত্যক্ষ করা যায়, সমাজ ও মানুষই ছিল রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের মৌলস্থল, ভাবনা-ভূখণ্ড। এ কারণে তার রাজনৈতিক চিন্তাও ছিল সার্বিক অর্থে সমাজসংশ্লিষ্ট। ‘কালান্তর’ এ প্রবণতারই অভিজ্ঞান, স্মারকশাস্ত্র। অর্ধশতাব্দী কাল-পরিসরে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তার রূপান্তর ঘটেছে একাধিকবার।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ও স্বদেশী আন্দোলনে তিনি প্রতিবাদের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর মঞ্চ ও স্লোগানে ভারাতুর পরিসর থেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। তবে রবীন্দ্রনাথের জীবনে রাজনীতি-চর্চার এক নিরন্তর প্রবাহ আমৃত্যু জারি ছিল। সেই বৌদ্ধিক চর্চা-কর্ষিত শস্য কখনো ভারতবর্ষের রাজনীতির মূলস্রোতকে প্রভাবিত করেছে। আবার কখনো যোগান দিয়েছে নৈতিক সমর্থন, রসদের। স্বদেশী-আন্দোলন কালপর্ব থেকেই রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সত্তার দুটি প্রধান প্রান্ত অবলোকন করা যায়: একটি আত্মশক্তির উদ্বোধন, অন্যটি স্বদেশী সমাজ নির্মাণের কাঙ্ক্ষা। আত্মশক্তির উদ্বোধনকে দেখা যেতে পারে তার সামগ্রিক দর্শনের বীজমন্ত্ররূপে। অন্যদিকে স্বদেশী সমাজ নির্মাণের নিরন্তর কাঙ্ক্ষা ছিল সেই দর্শনকে অবলম্বন করে কাঠামো পাওয়া রাজনৈতিক ধারণা, চিন্তাসার।

২.

‘কালান্তর’ শব্দটি নিঃসন্দেহে দ্যোতনাবহুল এবং অর্থপূর্ণ, প্রবন্ধটিও এ অর্থের অনুগামী। কালের বিবর্তন ভারতবর্ষ ও বিশ্বের সমাজ-রাজনৈতিক পরিসরে যে পরিবর্তনগুলো নিয়ে এসেছিল, রবীন্দ্রনাথ তার সংবেদনশীল মানসিকতায়, ধীশক্তিতে এখানে সেটি প্রত্যক্ষ করেছেন। শাণিয়ে নিয়েছেন আপন চিন্তালোক। ভারতবর্ষীয় জনজীবনের যে আদি স্থিরতা ও জড়তা; তিনি তুলে ধরেছেন—মধ্যযুগে মুসলমানদের আগমন সেখানে কোনো প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়নি, ব্যর্থ হয়েছে নাড়া দিতে। এ আগমনের কোনো আধুনিক বা সৃষ্টিশীল প্রান্তও রবীন্দ্রনাথ অবলোকন করেননি। ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে তার অকপট স্বীকারোক্তি: ‘বাহির থেকে মুসলমান হিন্দুস্তানে এসে স্থায়ী বাসা বেঁধেছে কিন্তু আমাদের দৃষ্টিকে বাহিরের দিকে প্রসারিত করেনি। তারা ঘরে এসে ঘর দখল করে বসল, বন্ধ করে দিল বাহিরের দিকে দরজা।’ রবীন্দ্রচিন্তায় এ বদ্ধ অর্গলই ছিল বাহিরের পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে ভারতবর্ষের মানুষের প্রধানতম অন্তরায়। মধ্যযুগের জনমণ্ডলীর যাপনিক সীমাবদ্ধতার দিকে দৃষ্টি দিলে রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার অবকাশ নেই। আবার এ স্থিরতা যে কেবল ভারতবর্ষের বান্তবতা, এটি জ্ঞান করাও খানিকটা খণ্ডচিন্তা। কারণ মধ্যযুগের জনমণ্ডলীর যাপনিক সীমাবদ্ধতার এ নিরালোক পৃথিবীর আরো বহুপ্রান্তেই প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল; পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের পূর্বাবধি।

উনিশ শতকে বাংলার কথিত রেনেসাঁসের কনিষ্ঠ সন্তানরূপে ভারতবর্ষে ইংরেজদের আগমনের মতো রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের উচ্ছ্বাস ছিল। যেমন ছিল তার অগ্রপথিকদের। তিনি এটিকে বিবেচনা করেছিলেন এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে। তার একটি বিখ্যাত কথা রয়েছে: ‘মানুষ জোড়ে স্থান, চিত্ত জোড়ে মনকে’। ইংরেজরা এখানকার মানুষের এতটাই নিকটবর্তী হয়েছিল যে রবীন্দ্রনাথ তাদের গণ্য করেছেন, এখানে পাশ্চাত্যের চিত্তদূতরূপে। যারা ঘটিয়েছিল যথার্থ মানস-সংযোগ। এ প্রসঙ্গে তার উচ্ছ্বসিত অভিব্যক্তি: “য়ুরোপীয় চিত্তের জঙ্গমশক্তি আমাদের স্থাবর মনের উপর আঘাত করল, যেমন দূর আকাশ থেকে আঘাত করে বৃষ্টিধারা মাটির ’পরে; ভূমিতলের নিশ্চেষ্ট অন্তরের মধ্যে প্রবেশ ক’রে প্রাণের চেষ্টা সঞ্চার করে দেয়, সেই চেষ্টা বিচিত্ররূপে অঙ্কুরিত বিকশিত হতে থাকে।” এমনকি রবীন্দ্রনাথের জন্মেরও কয়েক বছর আগে কার্ল মার্কস তার ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ প্রবন্ধে এ পরিবর্তনকে মান্যতা প্রদান করেছেন এভাবে: ‘ইংলন্ডই ভারতীয় সমাজের সমগ্র কাঠামোটাই ভেঙে দিয়েছে, পুনর্গঠনের কোনো লক্ষণ এখনো অদৃশ্য। … ব্রিটিশ-শাসিত হিন্দুস্তান তার সব অতীত ঐতিহ্য তার সমগ্র অতীত ইতিহাস থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছে।’ এখানে পাশ্চাত্যের এ অভিঘাতকে অস্বীকারের পথ আমাদের সামনে যথার্থই অনুপস্থিত।

স্বদেশী সমাজ নির্মাণে প্রয়াসী রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসে এক সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের স্বরূপ অন্বেষণ করেছিলেন। যে ভারতবর্ষের জনমণ্ডলী হবে উন্নত জীবন চেতনার অধিকারী। যেখানে থাকবে না জাতপাতের বিভেদ, বর্ণের বৈষম্য, সামাজিক সংস্কার ও সাম্প্রদায়িক হানাহানি। রবীন্দ্রনাথের উত্তরকালের ভাবনাতেও প্রত্যক্ষ করা যায়, এজন্য পাশ্চাত্য আদর্শকে গ্রহণ করতেও দ্বিধা ছিল না তার। আবার পাশ্চাত্যেই যখন এ প্রত্যাশিত আদর্শ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে উঠল, রবীন্দ্রনাথ সে ক্ষয়ের সমালোচনাতেও মুখর হলেন। তিনি গভীর উদ্বেগে প্রত্যক্ষ করলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তরকালে রাজনৈতিক প্রতিবেশে, পাশ্চাত্যের সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কাল পরিক্রমায় বিনষ্ট হয়েছে। লুপ্ত হয়েছে তাদের মানবিকতার মহান আদর্শ, তার স্থান অধিকার করেছে পাশবিকতা। এটি প্রত্যক্ষ করে কেবল উদ্বিগ্ন নয়, রবীন্দ্রনাথ কিঞ্চিৎ আহতও হয়েছিলেন বটে, তার সোচ্চার: ‘আজ তার লজ্জা গেছে ভেঙে; একদা ইংরেজের সংস্রবে আমরা যে য়ুরোপকে জানতুম, কুিসতের সম্বন্ধে তার একটা সঙ্কোচ ছিল, আজ সে লজ্জা দিচ্ছে সেই সঙ্কোচকেই।’ কেবল অন্যান্য দেশ প্রসঙ্গেই নয়, ভারতবর্ষের প্রতি পাশ্চাত্যের এ পাশবিক শক্তির নির্দয় আচরণকে উপস্থাপন করতেও কুণ্ঠিত হননি তিনি।

‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘ইংরেজ রাজা না হইলে সনাতন ধর্মের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা নাই। ইংরেজ রাজ্যে প্রজা সুখী হইবে, নিষ্কণ্টকে ধর্মাচরণ করিবে।’ প্রথম জীবনে ইংরেজ শাসনের প্রতি রবীন্দ্রনাথেরও মোহ ছিল; পরে তিনি এ মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছিলেন। ‘কালান্তর’-এর প্রবন্ধগুলোয় প্রত্যক্ষ করা যায়, তিনি ইংরেজকেই সব বিষয়ে ত্রাণকর্তা জ্ঞান করেননি। রবীন্দ্রনাথ এখানকার মানুষের স্বভাব স্থিরতা, জড়তা, কুঁড়েমি সম্পর্কে স্বভাবতই জ্ঞাত ছিলেন। সম্ভবত এ কারণেই মানুষের সম্মিলিত শক্তির প্রতি তার আস্থায় খানিকটা ক্ষয় ধরেছিল। ফলে বেনিয়া শাসনের প্রতি ভারতবর্ষের মানুষের রাজনৈতিক প্রতিবাদকে তিনি জ্ঞান করেছিলেন সাময়িক উত্তেজনারূপে। আবার এর বিপরীতে বিচারপ্রার্থী হয়েছিলেন ইংরেজদের দরবারেই: ‘বরঞ্চ মুক্তকণ্ঠে বলতে পারি, তারই দায়িত্ব বড়, তারই আদর্শে তারই অপরাধ সবার চেয়ে নিন্দনীয়।’ এ প্রার্থনার মধ্যে ইংরেজ প্রদত্ত সভ্যতার উত্কর্ষিত প্রকাশ রয়েছে বৈকি! তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের এমন বক্তব্যকে কালিকই বলি আর শিল্পীসুলভই বলি, এটি তার সীমাবদ্ধতা কিংবা ভাবনা-দ্বন্দ্বের প্রকাশ বলে বিবেচনা করতে আমাদের দ্বিধা থাকা অনুচিত।

৩.

রবীন্দ্রনাথ ভাব-কল্পলোকে যে ভারতবর্ষের চিত্র অঙ্কন করেছিলেন, সেটি রাষ্ট্রপ্রধান নয়; বরং সমাজপ্রধান। এক পত্রে অমিয় চক্রবর্তীকে তিনি লিখেছিলেন: ‘রাষ্ট্র ব্যাপার সমাজের অন্তর্গত। সামাজিক ভিত্তির কথা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রিক ইমারতের কল্পনায় মুগ্ধ হয়ে লাভ নেই।’ এ কারণে সামাজিক জীবনের অসাড়তা, প্রাণহীনতা তাকে পীড়া দিয়েছে বিপুলভাবে, এমনকি ফিরে ফিরে। পুরনো সমাজের রূপান্তর না সংঘটনই তার প্রধান আক্ষেপরূপে প্রতিপন্ন হয়েছে। এ আক্ষেপই বিকশিত হতে দেখা যায় ‘কালান্তর’-এর ‘বিবেচনা অবিবেচনা’, ‘লোকহিত’, ‘ছোটো ও বড়ো’র তুল্য প্রবন্ধগুলোয়। এখানে দেশের সংস্কারাচ্ছন্ন জীবন ও জনমণ্ডলীকে বিদ্রুপ প্রদর্শনের সমান্তরালে, এ জীবনের নাগপাশ মুক্ত হয়ে বাঁচার প্রেরণাও সঞ্চার করেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কিঞ্চিৎ দ্রোহী সত্তাও অবলোকন করা যায়: ‘মানুষকে বলিব, তুমি শক্তিও চালাইয়ো না, বুদ্ধিও চালাইয়ো না, তুমি কেবলমাত্র ঘানি চালাও, এ বিধান কখনই চিরদিন চলিবে না।’ স্বদেশী রাজনীতির ক্ষেত্রে সর্বজনীন চেতনা; স্বদেশহিত ও জনহিতকে এক করে দেখা তার দর্শনের একটি বাস্তববাদী দিক, যা আর কোনো চিন্তকের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায় না। ‘কালান্তর’-এর ‘সমস্যা’, ‘শক্তিপূজা’, ‘হিন্দ-মুসলমান’, ‘বৃহত্তর ভারত’, ‘হিজলি ও চট্টগ্রাম’সহ একাধিক ক্ষুদ্র রচনাতেও বিষয়টি ব্যাখ্যার অবকাশ দেখিয়েছেন তিনি। হিন্দু মুসলমান সমস্যাকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে। চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ বসুর তুল্য দু-একটি নাম ব্রাত্য রাখলে, তার সমকালীন আর কোনো রাজনীতিবিদও বিষয়টির এমন বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন করতে সক্ষম হননি।

আবার ভারতবর্ষে প্রচলিত সামাজিক সমস্যা প্রসঙ্গে বহু চিন্তক রাজনৈতিক পরাধীনতার বিষয়টি উপস্থাপন করলেও রবীন্দ্রনাথ তাদের সঙ্গে নানা প্রশ্নে ভিন্নমত হয়েছেন। তিনি ভাবনা ব্যক্ত করেছেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব নয়: বরং এখানে প্রচলিত সমস্যাগুলোর মূলে লুপ্ত রয়েছে বহুবিধ সামাজিক সংস্কারের আদি জঞ্জাল, যা স্বদেশের অগ্রগামী চরিত্রকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে, বিকশিত হতে দিচ্ছে না ভারতবর্ষের জনমণ্ডলীকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালখণ্ডে ফ্যাসিবাদের বাড়বাড়ন্ত প্রত্যক্ষ করে বয়স্ক ও মানবিক কবি রবীন্দ্রনাথের দ্রোহী ভূমিকা আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। তিনি লিখেছিলেন: ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,/ শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ রমাঁ রলাঁ, আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে তিনিও দণ্ডায়মান হয়েছিলেন বিপন্ন বিশ্বে, মানুষের কাতারে। তারই পূর্বাভাস প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে ‘লড়াইয়ের মূল’ প্রবন্ধে। আহত রবীন্দ্রনাথ এখানে দেখিয়েছেন বিশ্বে বেনিয়াদের রাজত্ব কায়েম হয়েছে: ‘সম্প্রতি পৃথিবীতে বৈশ্যরাজক যুগের পত্তন হইয়াছে। বাণিজ্য আর এখন নিছক বাণিজ্য নহে, সাম্রাজ্যের সঙ্গে একদিন তার গান্ধর্ব বিবাহ ঘটিয়া গেছে। …এক সময়ে জিনিসই ছিল বৈশ্যের সম্পত্তি, এখন মানুষ তার সম্পত্তি হইয়াছে।’ ভাবলে অবাক হতে হয়—আজকের যুগে মানুষের যে পণ্যায়ন আমরা প্রত্যক্ষ করছি, রবীন্দ্রনাথ কত আগে তা চিন্তা করে গেছেন!

৪.

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সত্তার একটি বড় দিক হলো ভাবনার নিরন্তর ভাঙাগড়া। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, অসহযোগ আন্দোলন, বিশ্ব-রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে ভাঙাগড়ায় ক্রিড়নক হিসেবে কাজ করেছে। দেখা যায় ‘কালান্তর’ গ্রন্থে তার রাজনৈতিক সত্তা দ্বিধাদ্বন্দ্বের জাল কাটিয়ে চরম ও প্রকাশ্য পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে, যা স্বঘোষিত জন্ম-রোম্যান্টিক রবীন্দ্রনাথকে ভাবজগৎ থেকে নিষ্ক্রান্ত করে, মানুষের পাশে এনে দাঁড় করিয়েছিল। অশোক সেন লিখেছেন: ‘যত দিন যাচ্ছে কেমন যেন বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের রাজনীতির ভাবনা।’ এ বড় মূল্যবান কথা! যুদ্ধক্লান্ত, নষ্ট রাজনীতির শিকার, অশান্ত পৃথিবী প্রসঙ্গে রবীন্দ্র-সত্তার বিকশিত ও দার্শনিক প্রতিমূর্তি প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল তার অন্তিমপর্বের উল্লেখযোগ্য রচনা ‘সভ্যতার সংকট’-এ। যেখানে বিপন্ন পৃথিবীর দিকে তাকিয়েও আশাবাদী হয়েছিলেন তিনি, উচ্চারণ করেছিলেন: ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ বিপুল-বিস্তৃত ক্ষয়ের মধ্যেও বিপন্ন-ভণ্ডুল পৃথিবীতেও; মানুষের প্রতি এই অনিঃশেষ আস্থা, প্রত্যাশাই ছিল রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সত্তার মৌলশক্তি। আমরা এ রবীন্দ্রনাথকে কেবল বাঙালি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সমাজকর্মী, স্বদেশ চিন্তকের পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে পারি না। কারণ কর্মে ও চিন্তায় তিনি কাঠামো অর্জন করেন সভ্যতার, তাবৎ মানবমণ্ডলীর এক অনিবার্য, মহান প্রতিনিধির।

 

নাজমুল হাসান: লেখক


শর্টলিংকঃ