ছাদের শাকসবজি বেচে ফারহানার মাসে আয় ৩০ হাজার


পাঁচ শতাংশ জমিতে ফারহানা ইয়াসমিন পপি ও সৈয়দ আকরাম হোসেন দম্পতির দোতলা বাড়ি। তাদের পুরো বাড়িটাই একটি বাগান। দোতলায় বসবাস করেন। বাড়ির প্রবেশমুখ থেকে চারপাশের কোনও জায়গা খালি রাখেননি। সামনের অংশের বাঁ পাশে এক শতকের মতো জায়গার চারদিকে গাঁথুনি দিয়ে জলাশয় তৈরি করেছেন। সেখানে করছেন মাছ চাষ। মূল রাস্তা থেকে বাড়িতে ঢুকতেই সরু হয়েছে পথ। কারণ দুই পাশে সবুজের সমারোহ। নানা ধরনের ফল-ফুল, শাকসবজি ও আখগাছ লাগিয়েছেন। নিচতলায় চাষ করেছেন পুঁইশাক আর বেগুন। বাড়ির চারপাশের সবুজায়ন পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় গেলে দেখা মিলবে ছাদবাগান। সেখানে ঔষধি, ফল-ফুল ও শোভাবর্ধনকারী নানা ধরনের গাছ রয়েছে। পুরো বাগান দেখার পর যে কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কোন গাছটি নেই এই দম্পতির বাড়ির ছাদে।

ফারহানা-আকরাম দম্পতির বাড়িটি সদরের রামনগর ইউনিয়নের মোবারককাঠি গ্রামে। যশোর বাস টার্মিনাল থেকে মুড়লি যেতে বটতলা মোড় থেকে একটি সড়ক কাজীপুরের দিকে গেছে। সড়কের পাশেই তাদের বাড়ি। যার নাম দিয়েছেন ‘সুখের নীড়’। বারান্দায় থরে থরে সাজানো ফুলের টব। ১৬৫০ বর্গফুটের ছাদ আর বাড়ির চারপাশ মিলিয়ে তিন শতাধিক গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ বছর বয়সী বট-বনসাই উল্লেখযোগ্য।

গাছগুলোকে সন্তানের মতো ভালোবাসি উল্লেখ করে ফারহানা ইয়াসমিন পপি বলেন, ‘কোথাও বেড়াতে গেলে থাকতে পারি না, অস্বস্তি লাগে। ছাদে গেলেই বুঝি, কোন গাছের কী লাগবে। কোন গাছে পানি দিতে হবে, কোন গাছে সার। ওদের সঙ্গে কথা হয় আমার প্রতিদিন। যখন কোনও কারণে মন খারাপ হয়, ছাদে গিয়ে তাদের সঙ্গে সময় কাটাই। সে গভীর রাত হোক কিংবা দিন।’

ছোটবেলা থেকেই বাগান করার শখ ছিল জানিয়ে ফারহানা বলেন, ‘কিন্তু ভাড়া বাসায় বাগান করা সম্ভব হয়নি। পরে যশোর শহরের বকচর এলাকায় আড়াই শতক জমিতে একতলা বাড়ি করি। ২০১২ সালে বাড়ির ছাদে প্রথম একটা লেবু গাছের চারা দিয়ে ছাদবাগান শুরু করি। তখন ছাদবাগানটি ছিল ৯৫০ বর্গফুটের। সেখানে ফল-ফুল, শাকসবজি ও ঔষধি গাছ ছিল। দুই বছরের মধ্যে পুরো ছাদকে বাগানে রূপান্তর করে ফেলি। ওই ছাদবাগানের জন্য ২০১৮ সালের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পাই। ২০২০ সালে যশোরের শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার পেয়েছি। এছাড়া আরও কিছু পুরস্কার পেয়েছি। পরে ওই বাড়িটি বিক্রি করে মোবারককাঠি গ্রামে বাড়ি বানাই। ২০২১ সালে এই বাড়িতে এসে ১৬৫০ বর্গফুটের ছাদবাগান তৈরি করি।’

ফারহানার এই বাড়িটি এখন পরিপূর্ণ বাগান। পুরো ছাদে সারিবদ্ধভাবে টবে চাষ করা হচ্ছে নানা ফলজ, ঔষধি, ফুল ও শাকসবজি। বাগানে রয়েছে অ্যালোভেরা, নিম, শিউলি, উলটকম্বল, অশোক, নাগেশ্বরী, মেহেদি, পানকর্পূর, পুদিনা, তুলসি, তেজপাতা, আদা, রসুন, ঘেটকোল, পাঁচমিশালি মসলা ও চুইঝালসহ নানা ঔষধি গাছ। আছে গোলাপ, জুঁই, বেলি, জবা, টগর, বাগানবিলাস, রঙ্গন, আলমন্ডা, মাধবীলতা, পর্তুলিকা, অপরাজিতা, কাঁঠালিচাঁপা, কাঠগোলাপ ও হাসনাহেনা প্রভৃতি। ছাদবাগানে আরও আছে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, আমড়া, অ্যাভোকাডো, বেল, কতবেল, নারিকেল, মালটা, কমলা, সফেদা, ড্রাগন, ব্ল্যাকবেরি, ডুমুর, ভুট্টা, ত্বীনফল, আতা, তেঁতুল, লেবু, রামভুটান, বাতাবি লেবু ও কলাসহ দেশি-বিদেশি নানা ফল গাছ।

এছাড়া বিভিন্ন মৌসুম অনুযায়ী শাকসবজি চাষ করেন। নিজেদের খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশীদেরও দেন এবং বিক্রি করেন। চলতি মৌসুমে বাড়ির চারপাশ ও ছাদে বেগুন, টমেটো, শিম, কুমড়া, লাউ, গাজর, মিষ্টি আলু, ধুন্দল, ঢ্যাঁড়স, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শজনে, ক্যাপসিকাম, ঝিঙে, বরবটি, চিচিঙ্গা, ধনেপাতা, লাল শাক, সবুজ শাক, পালং শাক, ডাঁটা, পুঁই শাক, কচু ও শসা চাষ করেছেন। শুধু এসব নয়, ছাদে লাগিয়েছেন শোভাবর্ধনজাতীয় নানা গাছ। যেমন বাঁশ, ক্রিসমাস ট্রি, ঝাউগাছ, বটগাছ, চায়নাবট ও পাকুড় ইত্যাদি।

প্রথমে ছিল শখ, এখন বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছি উল্লেখ করে ফারহানা বলেন, ‘আমার বাগানে যে শাকসবজি ও ফল হয়, তাতে বারো মাস শাকসবজি কিনতে হয় না। ছোট জলাশয়ে কই, শিং, টেংরা ও রুই মাছ চাষ করেছি। মাসে পাঁচ হাজার টাকার মাছ এখান থেকে পাই, ফলে বাইরের থেকে কিছুই কেনা লাগে না।’

ছাদবাগানে কোনও ধরনের রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশক ব্যবহার করেন না এই কৃষি উদ্যোক্তা। প্রতিদিন ফেলে দেওয়া সবজির খোসা থেকে তৈরি করেন জৈব সার। পাশাপাশি কৃষি অফিস থেকে বালাইনাশক পান।ফল-ফুল ও বিভিন্ন গাছের কলম থেকে চারা উৎপাদন করে সরাসরি এবং অনলাইনে বিক্রি করেন ফারহানা। তিনি বলেন, ‘এই খাত থেকে মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় হয়। গাছের পেছনে কোনও খরচ নেই।’

নারীদের নিয়ে ফারহানার দুটি দল রয়েছে। একেকটি দলে ২০ জন করে সদস্য। তাদের মাধ্যমে স্থানীয়দের বাড়ির আঙিনা, পতিত জমিতে ফল-ফুল আর শাকসবজির চারা রোপণ এবং বিতরণ করা হয়। এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাইস্কুল এবং মাদ্রাসার আশপাশে ফলদ বৃক্ষের চারা রোপণ করেছেন। পাশাপাশি রাস্তার পাশের পতিত জমিতেও গাছের চারা লাগিয়েছেন।

আমার স্বপ্ন সবুজ বাংলাদেশ জানিয়ে ফারহানা বলেন, ‘যদি কখনও সুযোগ হয়, সরকার যদি সুযোগ করে দেয়, তাহলে একটা অ্যাগ্রো ফার্ম করার ইচ্ছে আছে। যেখানে নানা ফল-ফুল ও ঔষধি গাছের বাগান থাকবে।’

ফারহানার প্রতিবেশী কলেজছাত্র জুবায়ের হোসেন বলেন, ‘দাদির (ফারহানা) কাছ থেকে গাছের চারা আর সবজির বীজ নিয়ে বাড়ির পাশের পতিত জমিতে চাষাবাদ করেছি। এছাড়া বাড়ির ছোট্ট একটু ছাদে লাগিয়েছি নানা জাতের ফুল গাছ। দুই বছর আগে দাদির কাছ থেকে মালটা, আমড়া, জামরুল ও লিচুর চারা নিয়েছিলাম। সেগুলোর অবস্থা ভালো আছে। এবার শীতে মাশরুম চাষের ইচ্ছে আছে আমার।’

ফারহানার স্বামী পার্টস ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘বাড়ির চারপাশে এবং ছাদে বাগান দেখতেই মন ভালো হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে গাছগুলোর পরিচর্যা করি। ফারহানাকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে যেতেও উদ্বুদ্ধ করি। সবচেয়ে বড় কথা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে। ছাদবাগান থেকে প্রতিদিনের সবজির চাহিদা মিটে যায়।’

একাধিকবার ফারহানার বাড়ির ছাদবাগান পরিদর্শন করেছেন যশোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসান আলী। তিনি বলেন, ‘ফারহানা বৃক্ষপ্রেমিক। তাকে কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আমাদের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বাড়ি গিয়ে তাকে পরামর্শ দেন।’


শর্টলিংকঃ