জার আমলে লেখক সমাজ


রাশিয়ার ইতিহাসের অন্যতম কালপর্ব রোমানভ রাজবংশের শাসন। ১৬১৩ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এ বংশের সদস্যরাই ছিলেন রুশ সাম্রাজ্যের সম্রাট বা জার। জারদের শাসন নিয়ে বিপুল সমালোচনা থাকলেও এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে মহৎ রুশ সাহিত্য বলতে দুনিয়াতে আজ যা প্রশংসিত, তার পুরোটাই রচিত হয়েছে এ রোমানভদের শাসনামলে। রোমানভ পুরুষরা মুখ্যত ছিলেন যোদ্ধা, সামরিক ব্যক্তিত্ব। তবে সাহিত্য, স্থাপত্য, সংগীত, চিত্রশিল্প, থিয়েটার নিয়েও তাদের আগ্রহ ছিল সব সময়ই।

 

সন্দেহ নেই জারশাসিত রাশিয়া স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অধীন ছিল। যেকোনো রাজশাসনেই যা স্বাভাবিক। তাই জার কিংবা ক্ষমতাবানদের সঙ্গে বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক গুরুত্ব বহন করে। শাসকরা কবি গ্রাভিলা ডারঝাভিন, নিকোলাই কারামজিন ও ভাসিলি জুকোভস্কির কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন, যদিও তাদের অনেক কথাই জারদের অস্বস্তিতে ফেলত।

জার প্রথম নিকোলাস প্রখ্যাত রুশ সাহিত্যিক আলেকজান্ডার পুশকিনকে ‘রাশিয়ার সবচেয়ে প্রাজ্ঞ’ মানুষ বলে বিবেচনা করতেন। শোনা যায় ভূমিদাসদের মুক্তি দিতে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ইভান তুর্গেনেভের আ স্পোর্টসম্যান’স স্কেচেস থেকে। তৃতীয় আলেকজান্ডার দস্তয়ভস্কির উপন্যাস পড়েছেন আগ্রহ নিয়ে। প্রথম নিকোলাসের শাসনামলে (১৮২৫-১৮৫৫) তৈরি হয়েছিল মতাদর্শিক স্লোগান—অর্থোডক্সি, অটোক্রেসি অ্যান্ড ন্যাশনালিটি। এ স্লোগান বহু বছর রুশ সাম্রাজ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। সলোমন ভলকভ রোমানভ রিচেস: রাশিয়ান রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস আন্ডার দ্য জার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রাশিয়ার শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাস তার পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া সাংস্কৃতিক নীতির আধুনিকায়ন করতে পারেননি, এ বিষয় হয় তার অনিচ্ছা ছিল নয়তো তিনি এ কাজে সক্ষম ছিলেন না। আমি বিশ্বাস করি তার এ অক্ষমতাই ছিল রুশ একনায়কতন্ত্রের পতনের মৌলিক কারণ।’

বড় রুশ সাহিত্যিকদের মধ্যে শেষ মোনার্কিস্ট ছিলেন ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি। রোমানভদের প্রতি তার সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠার ইতিহাস বেশ জটিল এবং নাটকীয়ও বটে। একটি সমাজতান্ত্রিক গ্রুপ পেট্রাশেভস্কিতে যুক্ত থাকার কারণে ১৮৪৯ সালে অন্য সদস্যদের সঙ্গে গ্রেফতার হন তিনি। এ গ্রেফতারের নির্দেশনা দিয়েছিলেন স্বয়ং জার প্রথম নিকোলাস। পেট্রাশেভস্কি সার্কেল বিষয়ে তদন্ত পর্যবেক্ষণও করেন জার এবং এর ২১ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, যার মধ্যে দস্তয়েভস্কিও ছিলেন। পরের ইতিহাস সবারই জানা। গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য লাইনে দাঁড় করানো হয় সবাইকে। গুলিতে নিজের মৃত্যুর জন্য বরফের ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন দস্তয়েভস্কি, মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা এ ১০ মিনিট চিরতরে বদলে দিয়েছিল তাকে। সে আরেক ইতিহাস। হঠাৎই খবর আসে জার তাদের মৃত্যুদণ্ড রদ করেছেন এবং পরিবর্তে সাইবেরিয়ায় নির্বসান দণ্ড দেয়া হয়েছে। সাইবেরিয়ার নির্বাসনে দস্তয়েভস্কি অর্থোডক্স ফান্ডামেন্টালিস্ট হয়ে ওঠেন—এখন তিনি সমাজতন্ত্রী থেকে রাজতন্ত্রী।

১৮৫৫ সালে জার হওয়ার পর দ্বিতীয় আলেকজান্ডার প্রথম যে কাজটি করেন তা হলো রাজনৈতিক অপরাধীদের ক্ষমা প্রদান। ডিসেম্বরিস্ট ও পেট্রাশেভস্কি সার্কেলের রাজবিরোধীরা ক্ষমা পেয়ে যান। মুক্তি পেয়ে ১৮৫৯ সালে দস্তয়েভস্কি সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে আসেন। আবারো তার সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়, সাইবেরিয়ায় কাটানো জীবন নিয়ে প্রকাশিত হয় হাউজ অব দ্য ডেড।

ক্ষমা করে দেয়ার জন্য দস্তয়েভস্কি দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন। ১৮৬৬ সালে যখন দিমিত্রি কারাকোজভ জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে হত্যার চেষ্টা করেন, তখন সে খবর পেয়ে চমকে গিয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি। সব শুনে তিনি ছুটে যান কবি মায়কোভের কাছে, কাঁপা গলায় চিত্কার করে ওঠেন, ‘তারা জারকে গুলি করেছে!’

প্রিন্স মেশচারস্কি ছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গের দ্য সিটিজেন-এর একজন প্রকাশক এবং উদরবাদীদের কঠোর সমালোচক। ১৮৭৩ সালে তিনি দস্তয়েভস্কিকে দ্য সিটিজেনের সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ করেন। প্রিন্স মেশচারস্কির স্মৃতিচারণে পাওয়া যায় দস্তয়েভস্কির ‘হূদয়ে রুশ জারের প্রতি অনুগত্য রয়েছে, আমি এমন আন্তরিক ও মনোযোগী রক্ষণশীল আর কখনো দেখিনি। তার রক্ষণশীলতায় তিনি একজন সংযমী সাধুর মতো কঠোর এবং নবীন দীক্ষিতের মতো উগ্র।’

জারকে হত্যার জন্য হামলার খবরটি যখন দস্তয়েভস্কি পেয়েছিলেন, তখন তিন তার বিখ্যাত উপন্যাস ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট লিখছেন। প্রিন্স মেশচারস্কি দাবি করেছেন দস্তয়েভস্কি বিপ্লবীদের ঘৃণা করতেন এবং তা স্পষ্ট হয়েছে তার দ্য ডেমনস উপন্যাসে। দস্তয়েভস্কির মনে এ উপন্যাসের ভাবনার সূত্রপাত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে ঘটা একটি ঘটনায়—উগ্র বিপ্লবী সের্গেই নেচায়েভ বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে তাদেরই এক কমরেডকে হত্যা করে।

 

গ্র্যান্ড ডিউক কনস্ট্যান্টিন রোমানভ (১৮৫৮-১৯১৫) ছিলেন বেশ প্রশংসিত কবি। তিনি দস্তয়েভস্কির উপন্যাস দিয়ে দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। কনস্ট্যান্টিন রাশিয়ার মিলিটারি স্কুলের জেনারেল ইন্সপেক্টর ও ইম্পেরিয়াল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের সভাপতি ছিলেন। ১৮৭৮ সালের ২১ মার্চ দস্তয়েভস্কি উইন্টার প্যালেসে গ্র্যান্ড ডিউক ও তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজনে যোগ দিয়েছিলেন। এখানে কনস্ট্যান্টিন রোমানভ উপস্থিত ছিলেন। নিজের ডায়েরিতে কনস্ট্যান্টিন সেদিনকার স্মৃতিচারণ করে লেখেন, ‘তার (দস্তয়েভস্কি) চেহারা রোগে ভোগা, মুখে পাতলা, লম্বা দাড়ি। ফ্যাকাশে মুখে বিষাদ ও ভাবনামগ্ন ছাপ। তিনি কথা বলেন খুব চমত্কারভাবে, মনে হয় যেন লিখে রাখা কোনো রচনা থেকে পড়ছেন।’

ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি মারা যান ১৮৮১ সালের ২৮ জানুয়ারি। তার মৃত্যুর পর রোমানভ পরিবারের প্রতিক্রিয়া মনোযোগের দাবি রাখে। এ প্রসঙ্গে একটি চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়া জরুরি—তিনি কনস্ট্যান্টিন পোবদোনস্তসেভ। ১৮৮০ সালে তিনি রাশিয়ার ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রধান নিযুক্ত হন। তিনি তত্কালীন জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের ঘনিষ্ট উপদেষ্টা ছিলেন। পরবর্তী সময় তিনি তৃতীয় আলেকজান্ডার ও দ্বিতীয় নিকোলাসেরও উপদেষ্টা ছিলেন। পোবদোনস্তসেভ পড়াশোনা করেছিলেন আইন নিয়ে, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে তার আগ্রহ ছিল। তবে তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে কঠোর রক্ষণশীল মতাদর্শের—‘অর্থোডক্সি, অটোক্রেসি অ্যান্ড ন্যাশনালিটি’ মতবাদের অনুসরণকারী। তার সম্পর্কে বলা হতো যে তিনি ছিলেন বরফের মতো, যার কারণে বিদ্যমান যেকোনো কিছু পচে যায় না কিন্তু আবার নতুন কিছু জন্মায়ও না।

কনস্ট্যান্টিন পোবদোনস্তসেভ গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় আদর্শকে সময়ের সবচেয়ে বড় ‘মিথ্যা’ বলে বিবেচনা করতেন। তিনি পত্রপত্রিকাকে পছন্দ করতেন না এবং এগুলোকে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের প্রভাবক হিসেবে নিন্দা করতেন। তিনি মনে করতেন নতুন নতুন সাক্ষর হওয়া রুশ জনগণ হাতে বইয়ের বদলে পত্রিকা তুলে নিয়েছে, যা দেশের জন্য ‘ভয়ানক বিপর্যয়’ বয়ে এনেছে, জনগণ উদরতাবাদীদের প্রপাগান্ডায় সহজেই বিপথগামী হচ্ছে। দস্তয়েভস্কি পোবদোনস্তসেভকে সহমতাদর্শী এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিবেচনা করতেন। আর পোবদোনস্তসেভ মনে করতেন দস্তয়েভস্কি হচ্ছেন রক্ষণশীল দর্শনের লণ্ঠন।

দস্তয়েভস্কির মৃত্যুর খবর পেয়ে পোবদোনস্তসেভ তার এক আত্মীয়কে লেখেন, ‘তিনি ছিলেন এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার প্রয়াণে আমি বেদনার্ত। তার মৃত্যু রাশিয়ার জন্যও এক বিরাট ক্ষতি। লেখকদের মধ্য সম্ভবত কেবল তিনিই বিশ্বাস, জাতীয়তা ও স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার নীতি আন্তরিকভাবে প্রচার করেছেন।’ পোবদোনস্তসেভ ভবিষ্যৎ জার তৃতীয় আলেকজান্ডারকে বলেন জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে অনুরোধ করতে যেন তিনি দস্তয়েভস্কির পরিবারকে কিছু সাহায্য করেন, কারণ ‘তিনি ছিলেন গরিব এবং বই ছাড়া আর কিছুই রেখে যাননি।’ পোবদোনস্তসেভর বার্তা পেয়ে তত্ক্ষণাৎ জবাব দেন তৃতীয় আলেকজান্ডার—‘দস্তয়েভস্কির মৃত্যুতে আমি খুব, খুবই বেদনার্ত। এটা বিরাট ক্ষতি। এবং তার জায়গা পূরণ হওয়ার মতো নয়।’ পোবদোনস্তসেভ সক্রিয়তায় দস্তয়েভস্কির শেষ কৃত্য আয়োজনের ব্যবস্থা করে রাষ্ট্র। পোবদোনস্তসেভর নির্দেশে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় অর্থোডক্স আলেকজান্ডার নেভস্কি মনস্ট্রি তাদের অভিজাত সমাধিক্ষেত্রে দস্তয়েভস্কিকে সমাহিত করার অনুমতি দেয়, যেখানে রোমানভদের প্রিয় লেখক কারামজিন ও জুকোভস্কি সমাধিস্থ হয়েছিলেন। সাবেক রাষ্ট্রীয় সাজাপ্রাপ্ত বন্দি এবং যিনি কখনো কোনো রাষ্ট্রীয় পদে ছিলেন না, সে রকম একজন মানুষের জন্য এ রাষ্ট্রীয় সম্মান তখনো ছিল অভূতপূর্ব। শেষ কৃত্যের পুরো খরচ দেয়া হয়েছিল রাজকোষ থেকে।

দস্তয়েভস্কির সদ্য বিধবা স্ত্রী অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি পান, যেখানে বলা হয় রুশ সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য সম্রাট তার পরিবারের জন্য বার্ষিক ২ হাজার রুবল পেনসনের ব্যবস্থা করেছেন। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার এটাও জানান যে যদি লেখকের স্ত্রী চান তাহলে তার সন্তানদের শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবে।

দস্তয়েভস্কির মৃত্যুর মাসখানের পরেই ১ মার্চ রাজতন্ত্র বিরোধী এক উগ্র বিপ্লবীর ছোড়া বোমায় নিহত হন জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। এ ঘটনার পর দস্তয়েভস্কির স্ত্রী বলেছিলেন, যদি তিনি ২৮ জানুয়ারি মারা না যেতেন, তাহলে ১ মার্চের এ ভয়াবহ ঘটনার খবর শুনে তার মৃত্যু হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

 

শানজিদ অর্ণব: লেখক ও সাংবাদিক


শর্টলিংকঃ