জুলাই থেকে বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদের হার


ইউএনভি ডেস্ক:

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে অচিরেই বেঁধে দেওয়া সুদহার ৯-৬-এর ক্যাপ সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসবে ব্যাংক খাত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঋণে সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়নি। তবে ব্যাংকগুলোর বাড়তি সুদ নেওয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ‘রেফারেন্স রেট’ নির্ধারণের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। প্রতি মাসে যা ট্রেজারি বিল ও বন্ডের ৬ মাসের গড় সুদহার বিবেচনায় ঠিক করে দেওয়া হবে। আগামী মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত এ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক। গত রবিবার (২ এপ্রিল) ব্যাংকার্স সভায় এ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার নির্ধারণের এ করিডোর পদ্ধতিকে ‘স্মার্ট’ (শর্ট টার্ম মুভিং অ্যাভারেজ) নামে নামকরণ করছে। তিনি বলেন, ‘আগামী মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, আগামী ১ জুলাই থেকে তা বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি বলেন, ‘যদি দেখা যায়, গড় সুদহার ১ শতাংশ বা নিম্নমুখী হয়েছে, বা এমন একটি পর্যায়ে রয়েছে—যা বাজারমুখী না, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার বুঝে সুদহার নির্ধারণ করে রেফারেন্স রেট জানিয়ে দেবে।’

নতুন এ পদ্ধতি চালু হলে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার ওঠানামার কারণে প্রতি মাসে গ্রাহকের ঋণের সুদহারে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনার কথা বলছেন ব্যাংকাররা এর আগে গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ বিজনেস সামিটে এজন্য ফিলিপিন্সের আদলে সুদহারের ‘করিডোর’ প্রথা চালুর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। দেশে বাজারভিত্তিক ‘রেফারেন্স রেট’ চালুর বিষয়টি তখন সামনে আসে, যেটির ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ ও বিনিয়োগের সুদহার ঠিক করবে।

প্রসঙ্গত, ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে অর্থ দিতে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সম্প্রতি ভোক্তাঋণের আওতায় বিতরণ করা গাড়ি ও ব্যক্তিগত ঋণে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেওয়া যাবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে লিখিতভাবে কোনও নির্দেশনা না দেওয়ায় বেশিরভাগ ব্যাংক তা কার্যকর করেনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী জুলাই থেকে বন্ডের গড় সুদহারের সঙ্গে ব্যাংক রেট যোগ করে নতুন পদ্ধতির সুদহার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন হবে। এতে সুদহার বাড়বে। এ রকম অবস্থায় আগে থেকেই আমানত সংগ্রহে জোর দিয়েছে অনেক ব্যাংক। কিছু ব্যাংক এরই মধ্যে ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে। ঋণের সুদহারও ঊর্ধ্বমুখী। যদিও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ঋণের সুদহারে সীমা বহাল রাখার দাবি জানানো হচ্ছে।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সুদহার নির্ধারণ হবে ৬ মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে। ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩ শতাংশ পর্যন্ত যোগ করা যাবে। বর্তমানে ৬ মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ৬.৯৯ শতাংশ। ফলে এখনকার হিসাবে ঋণের সুদ হতে পারে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। এই পদ্ধতির নাম রাখা হয়েছে শর্ট টার্ম মুভিং অ্যাভারেজ বা স্মার্ট। তবে এটাও এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা। তারা বলছেন, সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে এটা। কিন্তু তাতেও আমানতকারীরা তেমন লাভবান হবেন না। বড় ঋণগ্রহীতারাই লাভবান হবেন।

অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে মন্দের ভালো বলছেন ব্যাংকাররা। এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নূরুল আমিন বলেন, ‘ট্রেজারি বিলের সুদহারের ওপর ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ শতকরা ৩ ভাগ সুদ নিতে পারবে। এটাও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। ফলে এটাকে ওপেন মার্কেট বলা না গেলেও এটা মন্দের ভালো।’ তিনি মনে করেন, হঠাৎ করেই মার্কেট ওপেন করে দিলে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। যা ডলারের ক্ষেত্রে হয়েছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদ্ধতিতে করতে চায়, এর মাধ্যমে মার্কেট ম্যাচিওরড হলে পরে ওপেন করা যাবে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তে খুব বেশি লাভ হবে না। কেবল যারা বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী তারাই লাভবান হবেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা লাভবান হবেন না। কারণ, ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে ব্যাংক ১০ শতাংশ সুদ নিলে আমানতকারীকে দেবে ৬ শতাংশ। আর এখন মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশ। এতে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে তেমন আগ্রহী হবে না।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এখন কাঠামো তৈরির কাজ করছেন।

এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সুদের হারের বিষয়ে এটিই হবে প্রথম আন্তর্জাতিক মানের একটি নীতি।সরকারের ৫টি বন্ড রয়েছে বাজারে। এ সবের মাধ্যমে সরকার ঋণ নেয়। এগুলো হচ্ছে ২, ৫, ১০ ও ২০ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সরকার ট্রেজারি বন্ড।

এর মধ্যে ২ বছর মেয়াদির ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, ৫ বছর মেয়াদির ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ, ১০ বছর মেয়াদির ১২ দশমিক ১২ শতাংশ, ১৫ বছর মেয়াদির ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

এ সব বন্ডের গড় সুদের হার দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। কয়েক মাস আগে এ সব বন্ডের গড় সুদের হার ছিল সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে। সরকারের ঋণের চাহিদা বাড়ায় বন্ডের সুদের হারও বাড়ছে। ওই গড় সুদের হারের সঙ্গে ব্যাংকভেদে ৩ থেকে ৫ শতাংশ যোগ করে ঋণ দিতে হবে।

এ হিসাবে ঋণের সুদের হার দাঁড়াচ্ছে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ, যা বর্তমানে বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ সুদের হারের চেয়ে ৩ থেকে ৫ শতাংশ বেশি। কোনও কোনও ব্যাংক বর্তমানে সাড়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশ সুদেও ঋণ দিচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, ঋণের সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। এতে বেসরকারি খাত হুমকির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, ‘এমনিতেই গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।’

জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া আছে। আইএমএফ ঋণসীমা আগামী জুনের মধ্যে প্রত্যাহার করার শর্ত দিয়েছে।

এদিকে নতুন সিদ্ধান্তের ফলে আমানতের সুদের হারও বাড়বে। বর্তমানে গড়ে আমানতের সুদের হার ৪ থেকে ৬ শতাংশ। কোনও কোনও ব্যাংক ১০ থেকে ১২ শতাংশ সুদে স্থায়ী আমানত নিচ্ছে। ওইসব ব্যাংকে ঋণের সুদের হারও বেশি।

জানা গেছে, ব্যাংক খাতে আমানত বাড়তে শুরু করেছে। ব্যাংক থেকে আগে তুলে নেওয়া টাকা আবারও ব্যাংকে জমা হচ্ছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, অধিকাংশ ব্যাংকেরই আমানত ফিরতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বরে ব্যাংক ব্যবস্থায় আমানত বেড়েছে ২ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। এর আগের মাসে নভেম্বরে ব্যাংক আমানত ছিল ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। অবশ্য অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে আমানত কমেছিল ৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। গত অক্টোবরে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯০ হাজার ৪৩ কোটি টাকা।


শর্টলিংকঃ