ঠেলাঠেলি করে চলছে ৭ লাখ টাকার ভাড়া বাস


নিজস্ব প্রতিবেদক :

রোববার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা। রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে হঠাৎ থেমে যায় দেশসেরা রাজশাহী কলেজের ছাত্রীদের বহনকারী একটি বাস। প্রায় ১০ মিনিট ধরে বাসটি ইঞ্জিন সচল করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন চালক। একপর্যায়ে বাস থেকে নেমে পেছন দিক থেকে বাসটি ঠেলতে শুরু করেন ছাত্রীরা। যা দেখে আশেপাশের মানুষ হাস্যরসাত্মক মন্তব্য শুরু করেন। বিব্রত হলেও ছাত্রীরা কোনো দিকে খেয়াল না করে সাজোরে বাস ঠেলে সচল করার চেষ্টায় মগ্ন।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বানেশ্বর বাজারে রাজশাহী কলেজের একটি বাস ঠেলে সচল করার চেষ্টা করছেন ছাত্রীরা।  ছবি: আবু সাঈদ

এগিয়ে গিয়ে ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করে জানা গেল, শুধু সেদিন নয়, তাদের নিত্যদিনের ঘটনা এটি। প্রায়ই বাস বন্ধ হয়ে পড়ে থাকে রাস্তার মাঝে। যা ঠেলে স্টার্ট করতে হয় শিক্ষার্থীদের। কখনও তাতে কাজ হয়, আবার কখনও ভাড়া দিয়ে কলেজে বা বাড়িতে পৌঁছাতে হয়। অথচ এই বাসটির ভাড়াবাবদ কলেজ কর্তৃপক্ষ বাৎসারিক ৭ লাখ টাকা খরচ করে।

বাংলা বিভাগের এক ছাত্রী জানান, তিনি বানেশ্বর বাজার থেকে প্রতিদিন বাসে কলেজ ক্যাম্পাসে যাওয়া আসা করেন। তার সঙ্গে বানেশ্বর বাজার থেকে অন্তত আরও শতাধিক ছাত্রী কলেজ বাসের নিয়মিত যাত্রী। গাদাগাদি করে বাসে যাতায়াত করতে হয়। মাঝে-মধ্যেই ইঞ্জিন অকেজো হয়ে রাস্তার মাঝে বিকল হয়ে যায় বাস। তখন দ্রুত ক্লাসে বা পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

 তার পাশে থাকা সুমাইয়া, রুম্পা, রিমি জানান, শুধু এ রুটে নয়, অন্য রুট গুলোতে যেসব বাস যায়; সেগুলোরও একই দশা। তাদের বন্ধুরাও এভাবে বাস ঠেলে সচল করার অভিজ্ঞতা তাদেরকে জানিয়েছেন।

তারা বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের দুর্ভোগের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়না। এর আগে তারা কয়েকবার আন্দোলন করেছেন। অধ্যক্ষকে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাদের।

৫২ সিটের বাসে শুধু বানেশ্বর বাজার স্ট্যান্ড থেকেই উঠতে দেখা যায় অন্তত ৩০/৩৫ জন ছাত্রীকে।  ছবি: আবু সাঈদ

কলেজ বাসের একজন চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কলেজের শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার কাজে যে বাসগুলো চলাচল করছে, তা নিয়মিত সার্ভিসিং করানো হয় না। কলেজ কর্তৃপক্ষও নজর দেয় না, মালিকপক্ষও না। ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাসগুলো চালানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি কয়েকবার মালিকপক্ষকে জানালেও কোনো সাড়া মেলেনি। ফলে প্রায়ই রাস্তার মাঝে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে বাস। কোনোমতে সার্ভিসিং করে ফের চালানো হয়।’ এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো সময়ে বড় ধরণের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন ওই চালক।

জানা যায়, ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর পবা উপজেলার কাটাখালী এলাকায় রাজশাহী জুটস মিলের সামনে রাজশাহী কলেজ বাস দুর্ঘটনায় তিন ছাত্রী নিহত হয়। আহত হয় আরও ১৭ জন শিক্ষার্থী।

প্রথম দফা ঠেলে একটু চলার পর বাস চলা বন্ধ হয়ে গেলে নেমে কখনও কখনও দ্বিতীয় দফায়ও ঠেলতে ছাত্রীদের। ছবি: আবু সাঈদ

এঘটনার পর থেকে শিক্ষার্থীরা নতুন বাসের দাবিতে আন্দোলনে নামে। তারা মানববন্ধন, স্বাক্ষর ও স্মারকলিপি দিয়ে নতুন বাস পরিবহণে যুক্ত করার দাবি জানায়। সেসময় কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে দ্রুত বাস দেওয়ার আশ্বাস দেয়। তবে সেই দাবি এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহী কলেজে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। এর মধ্যে কলেজ হোস্টেল ও আশেপাশে ছাত্রবাসে প্রায় হাজার শিক্ষার্থী বসবাস করেন। বাকি ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর যাতায়াতের জন্য কলেজের পরিবহণের ওপর নির্ভরশীল।

কলেজটির ১৫টি বাসের বাসের মধ্যে দুটি কলেজের নিজস্ব বাস। আর ১৩টি কলেজ কর্তৃপক্ষ ভাড়ায় চালায়। এই ১৩টি বাসের ভাড়া হিসেবে প্রতিটি বাসের জন্য বছরে প্রায় ৭ লাখ টাকা দিতে হয়।অথচ বাসে যাতায়াতের সময় শিক্ষার্থীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

হররোজ ঠেলে সচল করতে হয় যে বাসটি। সামনে দাঁড়িয়ে বাসের হেলপার। ছবি: আবু সাঈদ

ভাড়ায় চালিত বাসগুলোতে ৫২টি করে আসন রয়েছে। সেখানে প্রত্যেকটি বাসে ৮০/৮৫ জন শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে চলাফেরা করতে হয়। কলেজের ১৪টি বাস ৫টি রুটে চলাচল করে।

রুটগুলো হলো- তালাইমারী, কাজলা, বিনোদপুর, চৌদ্দপাই, হরিয়ান, বেলপুকুর ও বানেশ্বর। অন্যদিকে শালবাগান এলাকা হয়ে নওদাপাড়া ও কোর্ট কাশিয়াডাঙ্গা রুটে চলাচল করে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক মহা. হবিবুর রহমানের সঙ্গে গত রোববার থেকে বুধবার পর্যন্ত কয়েকদফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ব্যস্ততার কথা জানিয়ে মোবাইলে কোনো মন্তব্য করেন নি। পরে দেখা করে কথা বলতে চাইলেও সময় দেননি অধ্যক্ষ।


শর্টলিংকঃ