নির্বাচন ঠেকাতে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চায় বিএনপি


ইউএনভি ডেস্ক: 

যেন উৎসবের নগরী। সকাল থেকেই মানুষের ঢল প্রতিটি সড়কে। বাজনার তালে তালে অগ্রসর হচ্ছে মিছিল। জনস্রোতের কেন্দ্র খুলনা সার্কিট হাউস মাঠ– প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাস্থল। আওয়ামী লীগ সভাপতি বিকেলে যখন মঞ্চে উঠলেন, তখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই বিশাল মাঠে। সার্কিট হাউসের চারপাশের সড়কগুলোর একই চিত্র। এই জনসমুদ্রে তিনি বললেন খুলনাসহ দেশের উন্নয়নে গৃহীত ও বাস্তবায়িত নানা কর্মসূচির কথা। এতে উঠল উল্লাসের ঢেউ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোটও চাইলেন তিনি। দুই হাত তুলে সম্মতি জানাল সবাই।

গতকাল সোমবার আওয়ামী লীগ আয়োজিত খুলনা বিভাগীয় জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণ দেন শেখ হাসিনা। বিকেল ৩টা ২৫ মিনিটে মঞ্চে উঠলে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর স্লোগানের মাধ্যমে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়।উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার জন্য আবারও ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই নৌকা স্বাধীনতা দিয়েছে। নৌকায় ভোট দিয়েছেন বলেই উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছেন। এই নৌকাই দেবে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ। বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এই দল দেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচাল করতে চায়। মানুষ খুনই তাদের একমাত্র গুণ। খুনিদের বিষয়ে সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। আপনাদের প্রতি অনুরোধ, কেউ যদি গাড়িতে, মানুষের গায়ে আগুন দিতে চেষ্টা করে; ওই হাত আগুনে পুড়িয়ে দেবেন।

আওয়ামী লীগ সভাপতি উপস্থিত সবার উদ্দেশে বলেন, আপনাদের কাছে ওয়াদা চাই– নৌকায় ভোট দেবেন কিনা বলেন, হাত উঁচিয়ে দেখান। এ সময় সবাই দুই হাত তুলে সাড়া দেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি/ দেবার কিছু নাই/ আছে শুধু ভালোবাসা/ দিয়ে গেলাম তাই।’

বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে জনসভা শুরু হয়। সকাল থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল সার্কিট হাউস মাঠে এসে জড়ো হতে থাকে। তাদের হাতে দলীয় প্রতীক নৌকাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র এবং বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি শোভা পাচ্ছিল। দুপুর ১২টার আগেই মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। মাঠে জায়গা না পেয়ে মানুষ আশপাশের সড়কে দাঁড়িয়ে মাইকে বক্তৃতা শুনেছে।

প্রধানমন্ত্রী ৩৭ মিনিটের ভাষণে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নানা দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্যের হার কমেছে। মাথাপিছু আয়, খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। এক সময় বিদেশ থেকে পুরোনো কাপড় আনা হতো। মানুষ সেই কাপড় পরত। এখন আর পুরোনো কাপড় আনতে হয় না। মানুষ এখন খাদ্য, বস্ত্র, ঘর পাচ্ছে। আশ্রয়ণ প্রকল্প, বীরনিবাস, গুচ্ছগ্রামসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীন মানুষকে ঘর ও জমি দেওয়া হয়েছে। জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনসহ বিভিন্ন কাজ চলছে। সারাদেশে ৫৬২টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।

বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তসহ ১০ কোটি মানুষ এর সুবিধা পাচ্ছে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সুবিধা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এতে বয়সকালে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হবে না।

গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলনের পেছনে কারা আছে, তাদের খুঁজে বের করা দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, শ্রমিকদের কাছে আমার প্রশ্ন– ’৯৬ সালে মজুরি ছিল ৮০০ টাকা; আমরা করেছি ১ হাজার ৬০০ টাকা। দ্বিতীয়বার ৩ হাজার ২০০ টাকা করা হলো। তৃতীয়বার ৮ হাজার ২০০ করা হয়েছে। চতুর্থবার ১২ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে। কোন সরকার এটা করেছে? এটা বেসরকারি খাত। তারপরও মালিকদের বুঝিয়ে আমরা মজুরি বাড়িয়েছি। আমরা সরকারি কর্মচারীদের ভাতা বাড়িয়েছি ৫ শতাংশ; গার্মেন্ট শ্রমিকদের বাড়ানো হয়েছে ৫৬ শতাংশ। তারপরও তাদের আপত্তি।

বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসী সংগঠন মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এরা মানুষের জন্য রাজনীতি করে না। মানুষ খুন বিএনপি-জামায়াতের একমাত্র গুণ। আগামী নির্বাচনের সময় একটা বিষয় সবাইকে নজরে রাখতে হবে; বিএনপি-জামায়াত ২০০৮ সালে মাত্র ৩০টি আসন পেয়েছিল। তারা জানে, তাদের নেতা নেই; মুণ্ডুহীন দল। তাদের এক নেতা পলাতক আসামি, এক নেতা কারাগারের আসামি। যারা আগুন দিয়ে মানুষ মারে, তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছি– যারা আগুন দেয়, তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা দেখেছেন, গত ২৮ অক্টোবর কীভাবে পুলিশকে মাটিতে ফেলে পিটিয়ে হত্যা করেছে। বেহুঁশ হয়ে গেছে, তাও ছাড়েনি। তারপর কুপিয়েছে। ৪৫ জন পুলিশ আহত হয়েছে। সাংবাদিকদের পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ঢুকে আক্রমণ করেছে। কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্স ভেঙেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে। ইসরায়েলিরা হাসপাতালে বোমা হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যা করছে। বিএনপিও অ্যাম্বুলেন্সে হামলা চালিয়েছে। দেখে মনে হয়, বিএনপি ইসরায়েলের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। নেতাকর্মীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এলাকায় এলাকায় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো মানুষের নিরাপত্তা দেবে। আপনারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কাজ করবেন।

শেখ হাসিনা ভাষণের শেষ পর্যায়ে ১৫ আগস্টের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘বিমানবন্দরে সবাই আমাকে বিদায় জানাতে গিয়েছিল। দেশে ফিরে দেখলাম, বনানী কবরস্থানে সারি সারি লাশ। ওই সময় আমার বাবা-মা হত্যার বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল না; মামলা করার অধিকার ছিল না; সেটাও আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। জেনারেল জিয়া-এরশাদ খুনিদের পুরস্কৃত করেছিল। খালেদা জিয়া খুনিদের সংসদে বসিয়েছিল। আজ আমি বাবা-মা সব হারিয়ে আপনাদের কাছে এসেছি। আপনারাই আমার স্বজন। আপনাদের মাঝেই আমি খুঁজে পেতে চাই হারানো স্বজনকে।’ এ সময় মহাসমাবেশের মাঠে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে।

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দেখা ও শোনার সুবিধার জন্য নগরীর ২৮টি পয়েন্টে এলইডি মনিটর স্থাপন করা হয়। মাঠে ঢুকতে না পারা লোকজন মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ শোনে। এ ছাড়া মাইক ছিল জনসভাস্থলের আশপাশে দুই-তিন কিলোমিটারজুড়ে।

খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের সভাপতিত্বে সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোয়ার্টার ফাইনাল শেষ হয়ে গেছে; এখন সেমিফাইনাল। জানুয়ারিতে ফাইনাল খেলা। বেশি তর্জন-গর্জন করতে গিয়ে বিএনপির রাজনীতি শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রাখুন। সকল অপশক্তি আমাদের সামনে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। আক্রমণ করলে পাল্টা আক্রমণ করতে হবে। আমরা দুষ্কৃতকারীদের ক্ষমা করব না।

জনসভায় আরও বক্তব্য দেন কাজী জাফরউল্লাহ, শাজাহান খান, ড. মসিউর রহমান, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, মাহবুবউল-আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এস এম কামাল হোসেন, শেখ হারুনুর রশীদ, শেখ হেলাল উদ্দিন, শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল, শেখ সারহান নাসের তন্ময় প্রমুখ।

উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন

জনসভায় ভাষণ দেওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী মাঠ থেকেই প্রায় ২ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা ২৪টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন এবং ২২৩ কোটি টাকার পাঁচটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

মনোনয়নপ্রত্যাশীদের শোডাউন

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর জনসভা ঘিরে বিশাল শোডাউন করেন খুলনা বিভাগের বিভিন্ন আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। সকাল ১০টার দিকে নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে কয়েক হাজার নেতাকর্মী কমলা রঙের টি-শার্ট পরে মিছিলসহকারে ঢোকে জনসভাস্থলে। এ ছাড়া অনেক সংসদ সদস্য রঙিন ক্যাপ, টি-শার্ট ও হেডব্যান্ড পরিয়ে কর্মী-সমর্থককে নিয়ে আসেন জনসভায়। তবে বর্তমান সংসদ সদস্যদের তুলনায় এ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ছিলেন নতুন করে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।

১০ জোড়া স্পেশাল ট্রেন ও ৬টি ফেরি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে ১০ জোড়া স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এসব ট্রেন নওয়াপাড়া, যশোর, বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গা, কোটচাঁদপুর, আলমডাঙ্গা, মোবারকগঞ্জ ও কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে খুলনায় আসে। এ ছাড়া নেতাকর্মীর পারাপারের সুবিধার্থে রূপসা ঘাটে চালু করা হয় পাঁচটি ফেরি। জেলখানা ঘাটে দুটি ফেরির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও একটি নতুন ফেরি।

 


শর্টলিংকঃ