পাক বাহিনীর গুঁড়িয়ে দেয়া সেই শহীদ মিনার দাঁড়ালো সগৌরবে


সুব্রত গাইন, রাবি :

৫২’র ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে ও তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৬৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। দ্বিতীয় ও বর্তমানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি নির্মাণের আগ পর্যন্ত এই শহীদ মিনারটিই ব্যবহার করা হতো। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী বোমা নিক্ষেপ করে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল শহীদ মিনারটি। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫০ বছর শহীদ মিনারটি অযত্ন আর অবহেলায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার অপেক্ষা ছিলো মাত্র।

সংস্কারের পর গৌরব ফিরে পেয়েছে রাবির প্রথম শহীদ মিনার

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে আমতলায় প্রথম শহীদ মিনার ছিল, তা প্রায় ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থীই জানতেনই না। অবশেষে ২০১৮ সালের শেষ দিকে শহীদ মিনারটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয় বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ইতোমধ্যে শহীদ মিনারটির সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। ফলে পাক বাহিনীর গুঁড়িয়ে দেওয়া সেই শহীদ মিনারটি আবার সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকদিন আগেও সেখানে দু’একটি ইটের স্তম্ভ ছিলো। দেখে কারও মনে হবে না, সেটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নির্মিত শহীদ মিনারের অংশ। তবে সংস্কার শুরু হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীরা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছে। তারা কৌতুহলবশত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে ১০ ফুটেরও বেশি দৈর্ঘ্য এবং ছয় ফুটের চেয়ে একটু বেশি প্রস্থজুড়ে জায়গাটি ইট-সিমেন্টে পাকা করা হয়েছে। চারপাশে অ্যালুমিনিয়ামের বেষ্টনি দ্বারা ঘিরে রাখা হয়েছে। সংস্কার করায় এখন শহীদ মিনারটি তার হারানো গৌরবের পাশাপাশি নতুন সৌন্দর্য পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।

জানা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের এক দশক পেরিয়ে গেলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন শহীদ মিনার ছিলো না। আব্দুল হামিদ, আব্দুর রাজ্জাক, বায়েজিদ আহমেদ, আবুল হোসেন, সাইদুর রহমান, একরামুল হক খুদ, নজরুল ইসলামসহ একদল শিক্ষার্থী ১৯৬৭ সালে এ শহীদ মিনারটি নির্মাণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনের আমবাগানে শহীদদের স্মৃতির স্মরণে এটি নির্মাণ করা হয়।

সংস্কারের আগে যেমনভাবে পড়েছিল শহীদ মিনারটি

তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল শহীদ মিনারটি। স্বাধীনতার পরে স্থান বদলে শেরে-ই-বাংলা ফজলুল হক হলের সামনে চার একর জায়গা জুড়ে দ্বিতীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। এটি এখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসেবে স্বীকৃত। পরে নির্মিত শহীদ মিনারটি ২ লাখ ৯ হাজার বর্গফুট বা চার একর ভূমিতে ১২ ফুট উচু ৬ কোণা প্ল্যাটফর্মের উপর ৫৬ ফুট লম্বা। মূল শহীদ মিনারটিতে রয়েছে চারটি সাদা রঙের স্তম্ভ।

মিনারে ওঠার জন্য রয়েছে সিঁড়ি। পেছনেই দুটি ম্যুরালে অঙ্কিত রয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধের নানা চিত্র। শহীদ মিনারের পটভূমিতে আছে বিখ্যাত শিল্পী মুর্তজা বশীরের ৩২১৬ ফুটের বিশাল ম্যুরাল। শিল্পী ফনীন্দ্রনাথ রায়েরও একটি ম্যুরালও আছে এই শহীদ মিনারে। মাতৃভাষা দিবসকে ঘিরে শহীদ মিনারটির রং চুনকামসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা ২৬শে বৈশাখ ১৩৭৯ বঙ্গাব্দে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান দ্বিতীয় শহীদ মিনারটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ২৩ এপ্রিল ১৯৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রী এম. মনসুর আলী এর উদ্বোধন করেন।

বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের দপ্তর সম্পাদক আযম হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ মিনার অনেকদিন অরক্ষিত ছিল। পরিচর্যার অভাব ছিল। বর্তমান প্রশাসন এটা মেরামত এবং পরিস্কার ও পরিচর্যার করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এটা অবশ্যই একটা ইতিবাচক। আমরা বর্তমান শহীদ মিনারে ফুল দেই। কিন্তু প্রথম শহীদ মিনারে ফুল দেই না। প্রথম শহীদ মিনারটি সংস্কার হওয়ায় এখনও এখানেও ফুল দেওয়ার সুযোগ তৈরি হলো।

নির্মাণ কাজ শুরুর পরের দৃশ্য

ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী শিবলী ইসলাম বলেন, ‘আমরা অনেকেই এই শহীদ মিনারের ইতিহাস সম্পর্কে জানি না। দীর্ঘদিন শহীদ মিনারটি সংস্কারহীন থাকায় আমরা সেভাবে নজরও দেইনি। এই শহীদ মিনারটি ইতিহাসের অনেক সাক্ষী হয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শহীদ মিনারটি সংস্কার করেছে। এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘ শহীদদের স্মৃতির স্মরণে গড়া প্রথম শহীদ মিনারটি দীর্ঘদিন ধরে অযত্নে পড়েছিল। আমরা এটা সংস্কার করেছি। আমরা আমাদের ইতিহাসকে চির অম্লাণ করে রাখতে পুরনো শহীদ মিনারটি সংস্কার করি। এটি অবশ্যই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গৌরবের বিষয়। আমরা বর্তমান শহীদ মিনারকে যতটুকু গুরুত্ব দেবো প্রথম শহীদ মিনারকেও সমান গুরুত্ব দেবো।


শর্টলিংকঃ