পাহাড়ের পাঠাগার ছড়াচ্ছে আলো


ইউএনভিও ডেস্ক:

খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুর। পাহাড়ের পথে পথে চলতে গিয়ে হঠাৎ আটকে গেল চোখ। রাস্তার পাশে একতলা ছিমছাম ভবন। সামনে সাঁটানো সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা– ‘কক্‌বরক লাইব্রেরি ও ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ’। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার নাম ‘কক্‌বরক’। এই জনগোষ্ঠীর ছাত্র সংগঠনের নামের আগে কেন লাইব্রেরি লেখা– এটা জানার কৌতূহল তৈরি হলো। গাড়ি থেকে নেমে ওই লাইব্রেরির দিকে যাত্রা। কক্ষে ঢুকতেই দেখা গেল, আলমারিতে থরে থরে সাজানো দেশি-বিদেশি বই। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ থেকে শুরু করে পাহাড়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে বেশ কিছু বইয়ের ঠাঁই হয়েছে সেখানে।

ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের সভাপতি নয়ন ত্রিপুরার সঙ্গে দেখা। লাইব্রেরিমুখী শিক্ষা কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করার সংকল্প তাঁর হৃদয়জুড়ে। তিনি বললেন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের ছাত্র সংগঠনের ৪৯টি কমিটি রয়েছে। এর মাধ্যমে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা করা হয়। পাশাপাশি বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে নানামুখী কার্যক্রম নেওয়া হয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তিনশর বেশি বই রয়েছে। চট্টগ্রামের অফিসেও লাইব্রেরি আছে।

এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকেন অনেকে। বই পড়ার অভ্যাস হারিয়ে ফেলছে তরুণ প্রজন্ম। এ সময়েও পার্বত্যাঞ্চলে ত্রিপুরা, মারমাসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ছোট ছোট লাইব্রেরির মাধ্যমে আলো ছড়াচ্ছে।

ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ১০ হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে তাদের। প্রান্তিক পর্যায়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম বছরজুড়ে নানা উদ্যোগ নিয়ে থাকে। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে সোচ্চার তারা। প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা ঘুরে ঘুরে তারা মা-বাবাকে বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করছেন।

পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ছাত্র সংগঠন কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার আয়োজন করে থাকে। কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন তারা। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে ত্রিপুরা, মারমাসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে বই দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদও বই পেয়েছে। এ ছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে কম্পিউটার সরবরাহ করা হয়। কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনেকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ দেশে-বিদেশে ভালো চাকরিও পাচ্ছেন।

মারমা উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মংনু মারমা বলেন, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক অনুদানের পাশাপাশি শিক্ষায়তনে ভর্তি কার্যক্রমেও অনেককে সহযোগিতা করা হয়। ছাত্রছাত্রীদের ভালোমন্দ দেখভাল করে বাংলাদেশ-মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল। পানখাইয়াপাড়ায় এ সংগঠনের একটি লাইব্রেরি আছে।
বাংলাদেশ-মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের খাগড়াছড়ি শাখার সভাপতি ওয়াপাইং মারমা বলেন, সামর্থ্যের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। সামর্থ্য বাড়লে লাইব্রেরিমুখী শিক্ষা কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন ত্রিপুরা স্টুডেন্টস সোসাইটির সভাপতি নয়ন ত্রিপুরা। তিনি বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দুই বছর পরপর সংগঠনের কেন্দ্রীয় সম্মেলন হয়। ৩১ বছরে পা রাখছে আমাদের ছাত্র সংগঠন। এই জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নেওয়াই অন্যতম লক্ষ্য। অনেকে এরই মধ্যে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কেউ কেউ পররাষ্ট্র, পুলিশসহ বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করছেন।

পার্বত্যাঞ্চলের এক ‘আদর্শ গ্রাম’ বান্দরবানের মুনলাইপাড়া। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মিশেলে ছবির মতো এক জনপদ। এ গ্রামের গল্পটা অন্যরকম। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে সুন্দর গোছানো ‘মুনলাই সেন্টার ও পাঠাগার’। মুনলাই সেন্টারে মাঝেমধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বম জনগোষ্ঠী। তাদের নাচ-গানে বিমোহিত হন পর্যটক। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষার হারও অনেক বেশি। সার্বিক বিষয় দেখভালের জন্য আছে একটি পাড়া কমিটি। পাড়াপ্রধানকে বলা হয়, ‘কারবারি’।

পার্বত্যাঞ্চল ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড়ে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সরকারি পর্যায়েও নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির আগে পার্বত্য এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ১ হাজার ২৫২টি, শান্তিচুক্তির পর আরও ৮শ ১২টি বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয় বর্তমানে পার্বত্য এলাকায় মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৬৪টি। শান্তিচুক্তির আগে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ১৯৬টি। শান্তিচুক্তির পর আরও ৪০৪টি তৈরি করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালের আগে কলেজ ছিল ২৫টি। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১-তে। শান্তিচুক্তির পর তিনটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি মেডিকেল কলেজ করা হয়েছে।

পার্বত্যাঞ্চলে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় শিশু বিকাশ, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাসহ নানা কর্মসূচি রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে তিন-ছয় বছর বয়সী কোমলমতি শিশুকে হাতে-কলমে পাঠদান করা হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা গ্রামে পাড়াকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিশুকে হাতে-কলমে নৃত্য, ছড়াগান, অভিনয় এবং লেখাজোখার অক্ষর, শব্দ ও সংখ্যার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে ছোট্ট শিশুরা।

২০২১ সালে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এবং যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে একটি সমীক্ষা করে। সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, কুড়িগ্রাম দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা। সেখানকার ৫৪ শতাংশ মানুষই হতদরিদ্র। এর পরের স্থানে বান্দরবান, এর ৫০ শতাংশ হতদরিদ্র। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা জেলার শীর্ষে রয়েছে রাঙামাটি। উপজেলার হিসাবে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জনপদ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম। এ ছাড়া লামা, থানচি, খাগড়াছড়ির সদর উপজেলা, পানছড়ি, মানিকছড়িও দরিদ্র উপজেলার তালিকায় রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষায় পিছিয়ে থেকে দরিদ্রতা জয় করা প্রায় অসম্ভব। তাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পার্বত্যাঞ্চলের শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

 


শর্টলিংকঃ