পিঁপড়ার ধর্ম – আমাদের সাম্প্রদায়িকতার লেভেল



আজ ছোটবেলার একটা গল্প দিয়ে শুরু করি,তখন আমার বয়স বড়জোর পাঁচ কি ছয়।বাড়ির সামনের খোলা উঠনে একদিন খেলছি হঠাৎ পিঁপড়ায় বসাল কামড়।কামড় খেয়ে আমার খেলা গেল ভেস্তে আর সেই রাগে শুরু করলাম পিঁপড়া মারা।বড় পিঁপড়া-ছোট পিঁপড়া,লাল পিঁপড়া-কালো পিঁপড়া যে পিঁপড়াই চোখের সামনে পড়ে তার খেল খতম।

এর মধ্যে আমার দেখেশোনার জন্য যে আপা (অনেকটা বেবি সিটার টাইপের,কেয়ারটেকার আরকি।আম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত আমি থাকতাম দাদির কাছে আর সেই আপা আমার দেখাশোনা করতেন এবং আমাকে খুব ভালবাসতেন…এখনও বাসেন)ছিলেন সে এসে হাজির,ততক্ষণে আমি একটা কালো পিঁপড়াকে প্রায় মেরে এনেছি।

আপা চিৎকার করে বলে উঠে হায় হায়!!! করো কি করো কি “কালো পিঁপড়া”কে মারতে হয়না,কালো পিঁপড়া মারলে পাপ হয় আল্লাহ্‌ গুনাহ দেন।আমি জানতে চাইলাম কেন কালো পিঁপড়া মারা যাবে না আর কেনই বা কালো পিঁপড়া মারলে আল্লাহ্‌ গুনাহ দিবেন।আপা বলেন কালো পিঁপড়া গুলো হল মুসলমান পিঁপড়া,কারণ তারা কামড় দেয়না।আরও বলেন লাল পিঁপড়া গুলো হল হিন্দু পিঁপড়া কারণ তারা কামড় দেয়।

কালো পিঁপড়া মারা এজন্য গুনাহের কাজ আর লাল পিঁপড়া মারা সোয়াবের।সেদিনই আমি প্রথম জানতে পারি পিঁপড়ারও ধর্ম আছে, পিঁপড়াদের মধ্যেও হিন্দু মুসলিম আছে।ছোট্ট এই গল্পটা আমার জীবনের মনে থাকা ছোটবেলার গল্প গুলোর মধ্যে অন্যতম।

এই ছোট্ট গল্পটা আমার ছোট্ট মনে এতোটাই প্রভাব ফেলেছিল যে আজও কোথাও কালো পিঁপড়া চোখে পড়লেই “ওই যে মুসলমান পিঁপড়া” আর লাল পিঁপড়া দেখলেই“ওই যে হিন্দু পিঁপড়া” নিজের অজান্তেই নিজেকে মনে করিয়ে দেই প্রতিবার।

পিঁপড়াদের মধ্যে কেন শুধু হিন্দু মুসলমান থাকবে খ্রিষ্টান পিঁপড়া কেন থাকবেনা(আমি ছোটবেলায় শুধুমাত্র এই তিন ধর্মের কথাই জানতাম), মুসলমান পিঁপড়ারা কিভাবে নামাজ পড়ে তাদের মসজিদ কেমন,বেহেশতে আমাদের সাথে কালো পিঁপড়ারাও থাকবে কিনা এমন নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকতো।

ছোটবেলার সেসব প্রশ্নের উত্তর সেই আপা সহ আমার আব্বু আম্মু কিংবা অন্যান্ন আত্মীয়রা কেউই কোনদিন দিতে পারেনি।উত্তর এখন ঠিকি পেয়ে গেছি।আজ বুঝি ছোটবেলার সেই হিন্দু মুসলমান পিঁপড়া গল্পের মাধ্যমে কি ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতার বীজ আমার ছোট্ট মননে নিজের অজান্তেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন সেই আপা।

হয়ত একই ধারাবাহিক পদ্ধতিতে আপার মধ্যেও এমন ধারণা ঢুকিয়ে ছিল তার আশেপাশের কেউ।এই গল্প হয়ত ছোটবেলায় অনেকেই শুনেছেন এখন বিশ্বাস করেননা যে পিঁপড়ার ধর্ম থাকতে পারে কিন্তু গল্পের কুপ্রভাব থেকে আমরা কি আসলেই বের হতে পরেছি?।

আমরা আজও বিশ্বাস করি হিন্দু পিঁপড়া কামড় দেই অর্থাৎ হিন্দুরা খারাপ আর মুসলমান পিঁপড়া কামড় দেয়না অর্থাৎ মুসলমানরা ভালো।আমারা ব্যাক্তি জীবনে,সামাজিক জীবনে অথবা রাষ্ট্রীয় জীবনে বহু ক্ষতির স্বিকার হই মুসলমান ভাইদের দ্বারা তখন গালিগালাজ করি এমনকি মারামারিও করি কিন্তু কাউকে মুসলমান বলে দোষারোপ করিনা।

কিন্তু যখনই সেই ক্ষতি কোন হিন্দুর দ্বারা হয় তখন প্রথম কথাটি আমরা যেটি বলি তা হল-“মালাউন তো এজন্যই এমন” “শালা মালাউনের বাচ্চা ভালো হবে কিভাবে” “আসলে মালাউনদের জাতই খারাপ” এধরণের কথাবার্তা।মুসলমান কোন ব্যাক্তি কোন খারাপ কাজ করলে আমরাতো “সুন্নির বাচ্চা” বলে গালি দেইনা তবে হিন্দুদের বেলায় “মালাউনের বাচ্চা” গালি কেন?।

ক্ষেত্র বিশেষে আমি অনেক প্রগতিশীল,অসাম্প্রদায়িক,মানবতাবাদী এমনকি সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিদের মুখে এই “মালাউনের বাচ্চা” “সুন্নির বাচ্চা” গালি শুনেছি।কেন আমরা বারবার কোন অপরাধীর কর্ম পরিচয় ছাপিয়ে তার ধর্ম পরিচয় কে বড় করে তুলি।

কেন আমরা ভুলে যায় একজন অপরাধীর একমাত্র পরিচয় সে অপরাধী…চোরের পরিচয় চোর,লুটেরার পরিচয় লুটেরা,খুনির পরিচয় খুনি,ধর্ষকের পরিচয় সে ধর্ষণকারী।সে কোন অপকর্ম করেছে,তার সাথে আর কারা কারা জড়িত আছে,সে কোন মহলের ছত্রছায়ায় অপকর্ম করছে কিনা,তার অপকর্মের কোন সুষ্ঠু বিচার হবে কিনা এসব না ভেবে আমরা কেন সে কোন ধর্মের কোন সম্প্রদায়ের এসব নিয়ে মেতে উঠি।

কেন আমরা তার এবং কেবলমাত্র তারই অপকর্মের জন্য অপরাধী ব্যাক্তির সমগ্র ধর্মীয় সম্প্রদায়কে আক্রমণ করতে থাকি। নিশ্চয় আক্রমন মানে কেবলই শারীরিক ভাবে আক্রান্ত করা নয়।কথার দ্বারা,সামাজিক মাধ্যমে পোষ্টের দ্বারা অথবা অন্যভাবেও এমন আক্রমণ হতে পারে।

আমরা এসব করি কারণ আমরা মুখে ধর্মনিরপেক্ষতা আর অসাম্প্রদায়িকতার যত কথাই বলিনা কেন ভেতর থেকে আমরা এখনো পুরোপুরি তেমনটা হয়ে উঠতে পারিনি।তাইতো আমাদের বিপরীত ধর্মের কেউ কোন খারাপ কিছু করলেই আমরা তাদের ধর্ম পরিচয় তুলে সাম্প্রদায়িক কথবার্তা বলতে থাকি এবং তার অপরাধ ভুলে গিয়ে তার গোটা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পিণ্ডি চটকাতে নেমে পড়ি।

এ ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সকল সম্প্রদায়ের চরিত্র এক এবং অভিন্ন,যদিও রিলিজিয়াস মাইনরিটি হওয়ায় আমাদের সমাজে হিন্দুদের উপর এমন আক্রমণটা বেশি।

প্রিয়া সাহা নালিশ কাণ্ডটি নিয়ে সম্প্রতি গোটা হিন্দু সম্প্রদায়কে ঘিরে আক্রমণ শুরু হয়েছে যেমনটি দেখেছিলাম সিনহা সাহেবের মোড়লীর সময়।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বদৌলতে আমরা যেন গণতন্ত্রের নতুন এক স্বাদ পেয়েছি।

অনেকে হয়ত এও মনে করেন আজ শুধু ফেসবুক চালু আছে বলেই আমাদের দেশে গণতন্ত্র এখনো টিকে আছে।গণতন্ত্রের ক-খ-গ না জানলেও দেশে কিছু ঘটলেই ফেসবুকে তার নিন্দা জানাতে হবে,একে ওকে গালিগালাজ করতে হবে,নিজের একটি মহান বিশ্লেষণী ত্বত্ত পোষ্ট আকারে শেয়ার করতে হবে এসব বিষয় গুলো তারা ঠিকই  জানেন এবং নিয়মিত ভাবেই মানেন।

তাদের ফেসবুকিয় গণতন্ত্র চর্চার আশির্বাদে গণমানুষের ভালোর চেয়ে খারাপই হচ্ছে বেশি।প্রিয়া সাহা অথবা সিনহা সাহেব খারাপ কাজ করেছে তাদের গালি দিবেন ভালো কথা তাদের গোটা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দোষারোপ করবার মানে কি? এসব সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ ধরণের চর্চা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।বিগত বছর গুলোতে ফেসবুকের মাধ্যমে অপপ্রচার এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে হিন্দু এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তোলে।

শুধু তাই নয় সম্প্রতি সময়ে পদ্মাসেতুতে বাচ্চাদের কাটা মাথা লাগবে,ছেলেধরা গুজব এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্থ করার জন্যে রাজাকার সাঈদিকে চাঁদে দেখা যাবার গুজবটিও ফেসবুকের মাধ্যমেই ছড়ানো হয়েছিল যার কিছু ভাগ নিশ্চয় আমাদের দ্বারাও ছড়িয়েছে।

তবে কি ফেসবুক না থাকলে এসব গুজব, অপপ্রচার কিংবা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ মূলক উস্কানি বন্ধ হতো ?তবে কি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরে আসতো?তবে কি বাঙ্গালির যে অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের কথা আমরা শুনে আসি এই বাংলার হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই বাঙ্গালি সবাই ভাইভাই সেই আকাঙ্ক্ষিত বাংলার রূপ আমরা দেখতে পেতাম?।

না তা পেতাম না,কারণ পচাত্তরের ষড়যন্ত্রের ফলে মহান স্বাধীনতার মূল ধারা রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে ছিটকে যাবার পর থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেকে বসা স্বাধীনতা বিরোধীরা অত্যান্ত সুকৌশলে আমাদের মননে মগজে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষ বৃক্ষের বীজ রোপণ করেছে তা সমূলে উপড়িয়ে ফেলতে চাইলেও আসলে সহজে উপড়ানো কঠিন।

এর জন্য চাই মানবিক,বিজ্ঞানভিত্তিক,গবেষণামূলক ও প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন।যে আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার চার মূলভিত্তি সমূহ গণতন্ত্র,ধর্মনিরেপেক্ষতা,জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।কেবল মাত্র স্বাধীনতার মূলভিত্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পূর্নগঠন সম্ভব যদিও এ আন্দোলন প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তবুও তা নিশ্চিত ভাবেই কার্যকরী বলে আমার ধারণা।

তবে বর্তমান সময়ে ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়ানো গুজব, অপপ্রচার কিংবা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ মূলক উস্কানি বন্ধে এ সংক্রান্ত ফেসবুক পোষ্ট আপলোড-শেয়ারিং এ সরকারের বিশেষ নজর অর্থাৎ মডিফিকেশণ,মিনিমাইজ অথবা মার্জিনিং করা উচিৎ বলে আমি মনে করি তবে সেটি কোন ভাবেই যেন কারো ব্যক্তিগত তথ্যকে হুমকির মুখে না ফেলে।

পরিশেষে সকলের কাছে বিনীতভাবে নিবেদন জানাই,আসুন অপরাধী যেই হোক না কেন তার ধর্ম নয় তার কর্মকে ঘৃণা করি।বারবার আমাদের যে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করা হয় আমরা আসলে কিন্তু তেমনটি নই।

আজো আমাদের বাড়ীর বাচ্চাটি খেলার ফাঁকে উঠানে পড়ে গেলে সবার আগে প্রতিবেশী হিন্দু মহিলাটি হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে আসে, আজো ঈদে পুজোয় ধর্ম ভুলে আমরা এক হই কোলাকুলি করি,আজো আমাদের হিন্দু বন্ধুটি আমাদের বাবার জানাজায় নামজ পড়ে,মুসলমান বন্ধুটি “বল হরি হরি বোল” ধ্বনিতে শ্বসান ঘাটে লাশ দাহ করতে যায়,আজো বাঙ্গালির সকল দিবসে আমরা হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃস্টান একসাথে উৎসব করি।এইতো আমাদের শ্বাস্বত চরিত্র,তাহলে কেন আমরা হঠাৎ হঠাৎ এসব ভুলে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত নেশায় মত্ত হয়ে উঠি…কার স্বার্থে?।

চলুন আবার ছোটবেলায় ফিরে যায়,একটি বাগধারা আমরা সকলেই পড়েছি “জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো”।আসুন না সুন্দর বাংলাদেশের জন্য আমরা সবাই মিলে নতুন একটি বাগধারা তৈরী করি-“ধর্ম হোক যারযার তার কর্মই হোক ভালো”।

লেখকঃ তামিম শিরাজী, সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক,বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।


শর্টলিংকঃ