পেঁয়াজ কারসাজিতে ৬০ জনের সিন্ডিকেট


ইউএনভি ডেস্ক:

কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দু’দিনে ভোক্তার পকেট থেকে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে পেঁয়াজ আমদানিকারকদের ৬০ জনের সিন্ডিকেট। চট্টগ্রাম, বেনাপোল, হিলি, সোনামসজিদ, ভোমরা ও টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানীকৃত পেঁয়াজ মজুদ রেখে তারা দাম বাড়িয়েছেন। কমিশন এজেন্টকেও বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন এসব আমদানিকারক।

বর্তমানে দেশে মজুদ থাকা পেঁয়াজের বেশির ভাগই আছে তাদের গুদামে। ৬০ জনের এই সিন্ডিকেটে ভোমরা স্থলবন্দরের ২১ জন, সোনামসজিদ স্থলবন্দরের ২০ ও হিলি স্থলবন্দরের ১২ আমদানিকারক রয়েছেন। গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য নিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। হোতাদের এভাবে চাপে রাখায় কিছুটা কমতির দিকে আছে পেঁয়াজের দাম। খাতুনগঞ্জে এক দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি দামও কমেছে প্রায় ১০ টাকা।

৬০ জনের এই সিন্ডিকেটে আছে যারা : ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে গত তিন মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ পেঁয়াজ এনেছে ২১ আমদানিকারক। তারা হলো- মেসার্স সাহা অ্যান্ড কোম্পানি, সুন্দরবন এন্টারপ্রাইজ, দীপা এন্টারপ্রাইজ, মা বাণিজ্যালয়, নাঈম এন্টারপ্রাইজ, জিসান এন্টারপ্রাইজ, নিশি এন্টারপ্রাইজ, ঘোষ এজেন্সি, আর ডি এন্টারপ্রাইজ, সোহা এন্টারপ্রাইজ, রিয়াজ এন্টারপ্রাইজ, সাইফুল এন্টারপ্রাইজ, শামীন এন্টারপ্রাইজ, ব্রাদার্স ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ব্রাদার্স ইমপেক্স, সুপ্তি এন্টারপ্রাইজ, সাহা বন্দর, রহমান ইমপেক্স, ফিরোজ এন্টারপ্রাইজ, বাবা লোকনাথ এন্টারপ্রাইজ ও মরিয়ম এন্টারপ্রাইজ।

সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে গত তিন মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ পেঁয়াজ এনেছে ২০ আমদানিকারক। তারা হলো- মেসার্স রিজু রিতু এন্টারপ্রাইজ, আরএম এগ্রো, বি এইচ ট্রেডিং অ্যান্ড কোম্পানি, টাটা ট্রেডার্স, আলী রাইস মিল, গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজ, ইয়াছিন ইন্টারন্যাশনাল, নূর এন্টারপ্রাইজ, এসএম এক্সিম, মেজবাহ এন্টারপ্রাইজ, বিসমিল্লাহ ডাল মিল, রুবেল ট্রেডার্স, আলী এন্টারপ্রাইজ, খাদিজা এন্টারপ্রাইজ, নিহা বাণিজ্যালয়, সাজ্জাদ এন্টারপ্রাইজ, ফুল মোহাম্মদ ট্রেডার্স, রাইসা এন্টারপ্রাইজ, কেপি ইন্টারন্যাশনাল ও টিএম এন্টারপ্রাইজ।

হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গত তিন মাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ পেঁয়াজ এনেছেন ১২ আমদানিকারক। তারা হলো- মেসার্স খান ট্রেডার্স, সততা বাণিজ্যালয়, টুম্পা ইন্টারন্যাশনাল, দ্রুব ফারিয়া ট্রেডার্স, সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজ, এস কে রাইস মিল, এম আর ট্রেডার্স, ইউনাইটেড রাইস মিল, জগদিশ চন্দ্র রায়, সালাহ ট্রেডার্স, এনপি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স রায়হান ট্রেডার্স। এ ছাড়া বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সিদ্ধার্থ এন্টারপ্রাইজ, আল্লার দান ফুড এজেন্সি, সোনালী ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, হামিদ এন্টারপ্রাইজ এবং চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মেসার্স উষা ট্রেডিং, এএমআর ট্রেডিং সর্বোচ্চ পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করেছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। বিকল্প দেশ থেকেও পেঁয়াজ আমদানির অনেক অনুমতিপত্র খোলা হয়েছে। দাম নিয়ে যারা কারসাজি করবে, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে খোঁজখবর রাখছে।’

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পরপর দেশে পেঁয়াজের দাম হুহু করে বাড়ার কোনো কারণ ছিল না। কারা এর পেছনে কলকাঠি নাড়িয়েছে, তা সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে। সাধারণ মানুষেরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। আতঙ্ক থেকে অতিরিক্ত পেঁয়াজ না কিনলে এমনিতেই পেঁয়াজের দাম কমবে। গত দুই দিন দাম বাড়লেও বৃহস্পতিবার খাতুনগঞ্জে আগের তুলনায় দাম কিছুটা কমেছে। এটি আরও কমবে বলে আশা করছি আমরা।’

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওমর ফারুক বলেন, কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ জন্য স্থলবন্দরগুলোতে আলাদা মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। আগের চেয়ে বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে।

সোনামসজিদ দিয়ে আমদানি করা পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি বেশি : গত জুন থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে এক লাখ সাড়ে ৭৩ হাজার টন পেঁয়াজ। এসব পেঁয়াজে সব রকমের শুল্ক্ক দিয়ে কেজিপ্রতি দাম পড়ে মাত্র ২৭ টাকা ৪৫ পয়সা। অথচ পাইকারি মোকামে মঙ্গল ও বুধবার পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। মজুদ রেখে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করা হয়েছে সোনামসজিদ দিয়ে আমদানি হওয়া পেঁয়াজে।

এককভাবে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজও এসেছে সোনামসজিদ দিয়ে। ৭৪ হাজার ৭৪০ টন পেঁয়াজ এসেছে এই পয়েন্ট দিয়ে। হিলি দিয়ে এসেছে ৫৬ হাজার ৬১৩ টন পেঁয়াজ। বেনাপোল দিয়ে আসে ১৪ হাজার ৬৫৮ টন। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এসেছে এক হাজার ৮২৪ টন। টেকনাফ দিয়ে আসে ১৩৭ টন পেঁয়াজ। আমদানীকৃত এসব পেঁয়াজের বড় অংশ এখনও আছে দেশের বিভিন্ন মোকামে।

বারবার পার পেয়ে যায় কারসাজির হোতারা : আগে পেঁয়াজ কারসাজিতে যাদের নাম এসেছিল তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গত এক বছরে কারসাজির সঙ্গে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট ও অনেকের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় খোদ প্রশাসন।

১৫ জনের সেই সিন্ডিকেটে ছিল খাতুনগঞ্জের মেসার্স আজমীর ভান্ডার, সৌরভ এন্টারপ্রাইজ, হোসেন ব্রাদার্স ও আল্লার স্টোর, কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কাদের, টেকনাফের আমদানিকারক সজীব, জহির, সাদ্দাম এবং পেঁয়াজ বিক্রেতা মম (মগ), গফুর, মিন্টু, খালেক ও টিপু, পেঁয়াজের দালাল শফি এবং কক্সবাজারের টেকনাফের কে কে পাড়ার মেসার্স আলীফ এন্টারপ্রাইজ। সিন্ডিকেটের তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

নিয়ন্ত্রণে খাতুুনগঞ্জের বাজার, কমছে দামও : টানা দু’দিন দাম বাড়লেও বৃহস্পতিবার খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম কমেছে ৫ থেকে ১০ টাকা। আগের তুলনায় কম ছিল ক্রেতাও। গত মঙ্গল ও বুধবার আতঙ্ক থেকে বাড়তি পেঁয়াজ কিনতে খাতুনগঞ্জে ভিড় জমায় অনেকে। এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে পকেট কেটেছে কমিশন এজেন্টরা। আমদানিকারকদের নির্দেশে বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে থাকে তারাও।

গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে আবার অভিযান শুরু হওয়ায় এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে পেঁয়াজের বাজার। খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, দুই দিনের তুলনায় বৃহস্পতিবার কেজিতে প্রায় ১০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে পেঁয়াজ। আগের তুলনায় বাজারে কমেছে ক্রেতার সংখ্যাও।


শর্টলিংকঃ