বঞ্চিত উত্তরাধিকারী খ্যাতিমান কবি


শেকসপিয়ারের আমলে ব্রিটেনের রাজা কে ছিলেন? প্রধান সেনাপতি কে ছিলেন? সবচেয়ে ধনী কে ছিলেন? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর কে ছিলেন? কোনটি ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার? এসব প্রশ্নের জবাব নিয়ে গবেষকদের কিঞ্চিৎ আগ্রহ থাকতে পারে, তবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে এসব নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় তথ্য। কিন্তু শেকসপিয়ার কে ছিলেন, এ প্রশ্নের জবাব তার মৃত্যুর ৪০০ বছর পরও কেবল ইংল্যান্ডে নয় সারা পৃথিবীতে বিপুলসংখ্যক মানুষ জানে। কারণ শেকসপিয়ারের সৃষ্টিশীলতা। নিজের কাল ডিঙিয়ে তিনি কালোত্তীর্ণ হয়েছেন। তার সৃষ্টি নতুন যুগেও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। কিন্তু অন্যরা গুরুত্বপূর্ণ কেবল তাদের কালের প্রেক্ষাপটে। কে রাজা ছিলেন, কে ছিলেন সেনাপতি বা সবচেয়ে ধনী—পরের প্রজন্মের কাছে এসব তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু সৃষ্টিশীল মানুষের অবদান যখন নিজের কাল অতিক্রম করে যায় নবযুগের মানুষই তাকে টিকিয়ে রাখে।

পৃথিবীর অন্যতম বিত্তশালী বাগদাদি ইহুদি পরিবারের অনেকেই পৃথিবীর উন্নয়ন ও গতিশীলতায় অবদান রেখেছেন; সাসুন পরিবার যুগপৎ প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারাই ভারতের মুম্বাইকে উজ্জীবিত করেছেন, বন্দর স্থাপন করেছেন। সাংহাইয়ের মতো সর্বাধুনিক নগরের গোড়াপত্তন করেছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয় উত্তরাধিকার বঞ্চিত সাসুন পরিবারের সন্তান সিগফ্রিড লরেইন সাসুনের নাম।

সিগফ্রিড সাসুন নামেই তিনি খ্যাত—প্রথম মহাযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সৈনিক।

রণাঙ্গনভীতু বুদ্ধিজীবীদের মতো ভুয়া সৈনিক নন। সিগফ্রিড তার সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ওয়ার পোয়েট। তিনি প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ের প্রধান যুদ্ধবিরোধী কণ্ঠস্বর।

সিগফ্রিডের দাদা ডেভিড সাসুন ধনকুবের, বাবা আলফ্রেড এজরা সাসুন গোত্রীয় ও ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করে ইংরেজ ক্যাথলিক পরিবারের মেয়ে থেরেসাকে বিয়ে করার কারণে উত্তরাধিকার বঞ্চিত হন। থেরেসা নিজে চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর—তার পরিবার প্রকৌশল-দক্ষতা ও বিলেতের বিভিন্ন জায়গায় ভাস্কর্য স্থাপনের জন্য খ্যাতিমান। তার পরিবারে জার্মান সংশ্লেষ নেই। তবু জার্মান সুরস্রষ্টা রিচার্ড বাগনারের ভক্ত থেরেসা ছেলের জন্য জার্মান নাম সিগফ্রিড বেছে নেন।

পৃথিবীর অন্যতম ধনী পরিবারের বঞ্চিত সদস্য সিগফ্রিড সাসুন ৮ সেপ্টেম্বর ১৮৮৬ কেন্ট শহরের ম্যাটফিল্ডে জন্মগ্রহণ করেন। চার বছর যখন তার বয়স বাবা মায়ের তালাক হয়ে যায়। তিন সন্তান থেকে যায় মায়ের কাছে। সপ্তাহান্তে আলফ্রেড যখন সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, থেরেসা সাবেক স্বামীর মুখোমুখি হতেন না। নিজেকে ড্রইং রুমে আটকে রাখতেন। সম্পত্তির উত্তরাধিকার বঞ্চিত পিতার সন্তান হওয়ায় বেঁচে থাকার তেমন অবলম্বন সিগফ্রিডের ছিল না। কিন্তু আগ্রহ ছিল, কবিতা ও ক্রিকেটে। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘ডেফোডিল মার্ডারার’ নামের কাব্যগ্রন্থ। প্রথম মহাযুদ্ধ এসে যায়। তিনি যুদ্ধে যোগ দিতে সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখালেন এবং থার্ড ব্যাটালিয়নে কমিশন লাভ করলেন। যুদ্ধে যোগ দিন তার ছোট ভাই হ্যামো। গ্যালিপোলি আক্রমণের সময় তিনি নিহত হন। যোদ্ধা ও কবি রুপার্ট ব্রুকের সঙ্গে সাক্ষাতের কয়েক দিনের মধ্যে ব্রুকও নিহত হন। যুদ্ধে আরো নিহত হন উইলফ্রিড ওয়েনের মতো প্রতিশ্রুতিশীল কবি। সিগফ্রিড রণাঙ্গনেই পরিচিত হলেন রবার্ট গ্রেভসের সঙ্গে।

অসীম সাহসী সিগফ্রিড পশ্চিম রণাঙ্গনে একক উদ্যোগে হিন্ডেনবার্গ লাইনের জার্মান ট্রেঞ্চ অধিকার করেন। গ্রেনেড চার্জ করে ৬০ জন জার্মান সৈন্যের দলটিকে তছনছ করে দেয়া হয়। জার্মান ট্রেঞ্চে বসে তিনি কবিতা পাঠ করেন।

সাধারণ সৈনিকদের অত্যন্ত প্রিয় এ অফিসার অবিরাম জার্মান গোলাবর্ষণের মধ্যে টানা দেড় ঘণ্টা একই সঙ্গে আক্রমণ চালিয়েছে এবং নিহত ও জখম হওয়া ব্রিটিশ সৈন্যদের কাঁধে করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে এসেছেন। তাকে ১৯১৬ সালে মিলিটারি ক্রস প্রদান করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে সর্বোচ্চ সামরিক পদক ভিক্টোরিয়া ক্রস প্রদানের জন্য সুপারিশ করা হয়।

১৯১৭ সালে তার সুহূদ ডেভিড টমাস রণাঙ্গনে মৃত্যুবরণ করলে তিনি যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন। এর আগে ১৯১৬ সালে অসুস্থ হয়ে অক্সফোর্ডের সোমারভিল কলেজ রূপান্তরিত হাসপাতালে ভর্তি হলেন এবং সুস্থ হওয়ার পর রণাঙ্গনে ফিরে যেতে অস্বীকার করলেন। তিনি তার কমান্ডিং অফিসারকে লিখলেন ‘ফিনিশড উইথ দ্য ওয়ার: এ সোলজার্স ডিক্লারেশন’—এ চিঠির কপি ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন স্থানে। তিনি লিখলেন, ‘প্রতিরক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য আমি যে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম তা পরিণত হয়েছে আগ্রাসন ও বিজয় দেখানোর যুদ্ধে।’ তার চিঠি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পড়ে শোনালেন একজন সহমর্মী সদস্য। সিগফ্রিড শান্তিবাদী বাট্রান্ড রাসেল ও লেডি অটোলিন মোরেলকে সমর্থন করে চিঠি লিখলেন।

এদিকে জঙ্গি মানসিকতার ব্রিটিশ আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট আয়ান ম্যাকপার্সন সিদ্ধান্ত দিলেন সিগফ্রিড মানসিকভাবে অসুস্থ এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন এবং তিনি নিওরাস্থানিয়া (বোমার শেলের অভিঘাত) রোগে আক্রান্ত হয়েছেন—এ ঘোষণা দিয়ে তাকে এডিনবরাতে ক্রেইগ লকহার্ট ওয়ার হসপিটালে ভর্তি করে দেয়া হলো।

অনেক বছর ধরে মনে করা হয়েছে সিগফ্রিড তার মিলিটারি ক্রস ফ্রমবি সৈকতে মার্সি নদীতে ছুড়ে ফেলেছেন। ‘পদাতিক সৈন্যের স্মৃতিকথায়’ তিনি লিখেছেন, সামরিক বাহিনীর প্রতি কোনো ঘৃণা থেকে তিনি কাজটি করেননি। সম্ভবত তিনি ক্রসটি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার একমাত্র পুত্র জর্জ সাসুনের মৃত্যুর পর এটি খুঁজে পাওয়া যায়।

যুদ্ধে নিহত কবি উইলফ্রিড ওয়েনের কাছে সিগফ্রিড সাসুন ছিলেন ‘কিটস, ক্রাইস্ট অ্যান্ড এলাইজা’। সিগফ্রিড ১৩ জুলাই ১৯১৮ তিনি মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। অবশ্য জার্মান বাহিনীর হাতে নয়, ব্রিটিশদেরই ভুল গুলি চালনায়। ১২ মার্চ ১৯১৯ ক্যাপ্টেন পদবি নিয়ে তাকে সামরিক চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়।

সিগফ্রিড ১৯১৯ সালে বামপন্থী ডেইলি হেরাল্ডের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯২৮ সালে আমেরিকা যান এবং উপন্যাস রচনায় হাত দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বিংশ শতকের প্রথমার্ধের শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ কবিদের একজন হিসেবে স্বীকৃত হন। তার অনেক কবিতা সুরারোপ করে গানে রূপান্তর করা হয়।

সিগফ্রিড সাসুনের ব্যক্তিজীবন নিয়ে বহুমুখী বিতর্ক প্রচলিত আছে। তিনি সমকামী হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং স্থপতি ও চিত্রশিল্পী উইলিয়াম পার্ক গ্যাব্রিয়েল অ্যাটকিনের সঙ্গে তার সম্পর্ক বহুল আলোচিত বিষয়। এছাড়া জার্মান অভিজাত প্রিন্স ফিলিপ অব হেসে, লেখক বেভারলি নিকোলাস, অভিনেতা গ্লেন কা, আইভর নোভেলো প্রমুখের সঙ্গে তার সমকামী সম্পর্ক ছিল। কিন্তু প্রায় সবাইকে অবাক করে দিয়ে তার চেয়ে বয়স অনেক ছোট তরুণী হেস্টার গ্যাটিকে ১৯৩৩ সালে বিয়ে করেন এবং খ্যাতিমান পুত্র জর্জ সাসুনের জনক হন। জর্জ বিজ্ঞানী, ভাষাতাত্ত্বিক ও লেখক। ১৯৪৫ সালে তাদের বিয়ে ভেঙে যায়। তিনি শেষ দিকে ধর্মকর্মে জড়িয়ে পড়েন।

একসময়ের নিয়মিত ক্রিকেট খেলোয়াড় সিগফ্রিড স্টোমাক ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং ১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ ৮১তম জন্মবার্ষিকীর এক সপ্তাহ আগে মৃত্যুবরণ করেন।

অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তি নয়, কবিতা এই সাসুনকে স্মরণীয় করে রেখেছে। তিনি লিখেছেন, আমি যুদ্ধে সৈনিকদের যাতনা ও ভোগান্তি দেখেছি, সহ্য করেছি, তাদের যাতনা বাড়ানোর কাজে আমি আর অংশ নিতে চাই না —এটা শয়তানি ও অন্যায়। তিনি আরো বলেছেন, আমার ভেতরের বাঘ গোলাপের গন্ধ শুঁকে।

 

 

সিগফ্রিড সাসুনের কবিতা

 

দ্য জেনারেল

গত সপ্তাহে লাইনে যাবার সময়

তার সাথে দেখা করি জেনারেল বললেন,

‘সুপ্রভাত, সুপ্রভাত’।

তিনি যেসব সৈনিকের দিকে হাসিমুখে

তাকিয়ে ছিলেন, তাদের অধিকাংশই

জেনারেলের অদক্ষ শূকরের পাল স্টাফদের

অভিশাপ দিচ্ছি আমরা; ঘোৎ ঘোৎ করে

হ্যারি জ্যাককে বলল, বুড়ো তো আনন্দেই আছে

রাইফেল গোলাবারুদ নিয়ে অ্যারাসে তারাও

নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে

তাদের দুজনের জন্যই আক্রমণ পরিকল্পনা

জেনারেল নিজেই করেছেন!

(বেলজিয়াম ও উত্তর ফ্রান্সে পৌঁছা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত সৈন্যবাহিনীকে জেনারেল স্বাগত জানাচ্ছেন। এটা এক সপ্তাহ আগের ঘটনা। এর মধ্যে অধিকাংশ সৈন্য নিহত আর যারা বেঁচে আছে তারা জেনারেল ও তার অদক্ষ অফিসারদের তাদের অদক্ষতার জন্য অভিশাপ দিচ্ছে। সৈন্যদের একজন হ্যারি অন্য একজন সৈনিক জ্যাককে বলছে, নিজের সৈন্যদের মৃত্যুর দিকে মার্চ করিয়ে কী আশ্চর্য জেনারেল এখনো উত্ফুল্ল। অথচ এই হ্যারি ও জ্যাকও উত্তর ফ্রান্সের অ্যারাস শহরে গিয়ে এ জেনারেলের রণ-পরিকল্পনার খেসারত দিতে গিয়ে নিহত হয়েছে। যুদ্ধ নিয়ে জেনারেলের নিজস্ব হিসাব আর প্রকৃত ক্ষতির মধ্যে কী দুস্তর ব্যবধান)

 

আদিম ইতিহাস

অ্যাডাম, বৃষ্টিতে বাদামি বুড়ো শকুন

বাতাসের ঝাপটা লাগা জলপাই গাছের নিচে কাঁপছে

ধারালো থুতনি আতঙ্কিত ও কৃষকায় হাঁটুতে গুঁজে আছে।

সে গোঙ্গায়, বিড়বিড় করে তার আধার হয়ে আসা

মস্তিষ্কের কাছে,

‘সে ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে জাঁকালো—সে ছিল কেইন।’

‘একটি সিংহ পর্বতে ডেরা বেঁধে ছিল, কেউ তার অবস্থান বোঝেনি’

হরিণীর মতো দ্রুতগামী, সমতলভূমির অশ্ব যেন

বহু আকাঙ্ক্ষার দলিল সাথে ক্ষুধার্ত ও ভয়ংকর।

 

বিষণ্ন মনে সে আবেলের কথা ভাবে, কোমল ও স্বচ্ছ

মুখাবয়বে বিপর্যয় নিয়ে প্রেমিক একজন

আর লালরঙা ফুলের প্রস্ফোটন উজ্জ্বল চুলে জড়ায়

‘লড়াইতে ভীত, খুন কি আরো অসম্মানের ছিল

‘ঈশ্বর সব সময়ই কেইনকে ঘৃণা করেছেন…

অস্থিচর্মসার এক বুনো মানব, যার সুন্দর পুত্ররা মৃত।

(প্রথম মহাযুদ্ধের যাতনাকে কবি বাইবেলের ‘কেইন অ্যান্ড আবেল’ কাহিনীতে তুলে ধরেছেন)

 

সকলেই গাইল গান

অকস্মাৎ সকলেই গানে গানে ফেটে পড়ল

বন্দি পাখি মুক্তি পেয়ে যেমন

উন্মত্তের মতো ডানা ঝাপটে সাদা

ফলবাগান এবং ঘন সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে

উড়তে উড়তে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়

এমনই আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে আছি আমি।

 

হঠাৎ সকলের স্বর চড়ে উঠে

অস্তগামী সূর্যের মতো সুন্দর আসে

আমার অন্তর কান্নায় কেঁপে ওঠে; আতঙ্ক

সরে যায়… হায়, কিন্তু সকলেই যে

একটি পাখি ছিল, গানটা ছিল শব্দহীন, গানটা

কখনো শেষ হবার নয়।

(১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হওয়ার পর সিগফ্রিড সাসুন কবিতাটি লিখেছিলেন)

 

আন্দালিব রাশদী: কথাসাহিত্যিক


শর্টলিংকঃ