বিএনপি সরকারের প্রথম মেয়াদে উলফার অস্ত্রের প্রথম চালান আসে বাংলাদেশে


বিশেষ প্রতিবেদক:

ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম (উলফা) ঢাকায় বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় অস্ত্রের চালান তাদের ডেরায় পোঁছানোর জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করেছিল। এ সময় চট্টগ্রামের একটি জেটিতে  ১০ ট্রাক অস্ত্র জব্দ করা হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে  তদন্তে এ চালান উলফার কাছে পৌঁছানোর জন্য  বিএনপি-জামায়াত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি প্রমাণিত হয় ।

এই চাঞ্চল্যকর তথ্যটি প্রকাশিত হয়েছে হার্পারকলিন্সের এই মাসে প্রকাশিত একটি নতুন বইতে, যেটি লিখেছেন ভারতীয় অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখক রাজীব ভট্টাচার্য। এখন নতুন একটি তথ্য সামনে এসেছে, যাতে দেখা যায়, শুধু বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলেই নয়, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভের পর প্রথম মেয়াদে সরকার গঠনের পরও উলফার অস্ত্রের প্রথম চালান বাংলাদেশ দিয়ে পাচার হয়। উলফা নেতৃত্ব ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে বাংলাদেশে তার ঘাঁটি স্থানান্তরিত করার প্রায় দুই বছর পর, ১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঘটা যে ঘটনাটি গোপন ছিল  ‘উলফা: দ্য মিরাজ অফ ডন’ শিরোনামের বইটি তা প্রকাশ করে।

বই অনুসারে, উলফার জন্য প্রথম অস্ত্রের চালানটি রোমানিয়া থেকে এসেছিল। অভিযোগ রয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক ব্যক্তি যিনি একটি বিদেশী গুপ্তচর সংস্থার জন্য কাজ করেছিলেন, তিনি উলফার হয়ে চুক্তিটি করেছিলেন। সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক সেই এজেন্ট উলফা চিফ অফ স্টাফ পরেশ বড়ুয়া এবং সংগঠনের অন্য দুই কর্মকর্তার সাথে অ্যাসল্ট রাইফেল, পিস্তল, হালকা মেশিনগান এবং বিস্ফোরক ক্রয়ের  চুক্তিটি করার জন্য রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে ভ্রমণ করেছিলেন। বইটিতে দাবি করা হয়েছে যে ওই এজেন্ট ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের হয়ে কাজ করতেন।

বইটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে এই ঘটনাটি ২০০৪ সালের বহুল প্রচারিত চট্টগ্রাম মামলার সাথে সম্পৃক্ত ছিল না, যেখানে উলফা এবং আরও কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জন্য ১০ ট্রাক-বোঝাই অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাংলাদেশী নিরাপত্তা বাহিনী বাজেয়াপ্ত করেছিল। বইটি, যার একটি অনুলিপি এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।  সাংবাদিক এবং লেখক রাজীব ভট্টাচার্যের দশকব্যাপী ক্ষেত্র গবেষণার উপর ভিত্তি করে লেখা বইটিতে উলফার পাকিস্তান , ভুটান থেকে বাংলাদেশ, মায়ানমার এবং চীন পর্যন্ত বিস্তৃত বিদেশী ঘাঁটি এবং অপারেশনগুলির উপর অনেক অজানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

বইটিতে প্রকাশিত নতুন তথ্য অনুসারে, কয়েক মাস যোগাযোগ করার চেষ্টার পর, পরেশ বাড়ুয়া সিঙ্গাপুরের একজন এজেন্ট সম্পর্কে বিশদ সংগ্রহ করতে সফল হয়েছিল যার বাবা-মা কয়েক দশক আগে তামিলনাড়ু থেকে সিঙ্গাপুরে এসেছিলেন। তিনি মোসাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, এবং দ্রুত অর্থ উপার্জনের জন্য মাঝে মাঝে অস্ত্র ব্যবসা করে ফুলে ফেপে উঠেন। কীভাবে চুক্তিটি চূড়ান্ত করা হয়েছিল সে সম্পর্কে বিশদ বিবরণ সহ বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়তে পারেন  গোয়েন্দা জালে ধরা তারেক রহমান পরেশ বড়ুয়ার ফোনালাপ

বাংলাদেশে অবস্থানরত উলফার দুই সিনিয়র কর্মকর্তা “ভারতীয় বংশোদ্ভূত মোসাদ এজেন্ট” সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছেন। বুখারেস্টে, বড়ুয়া রোমানিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিবের সাথে বৈঠকে বসেছিলেন যিনি উলফা এবং তাদের অস্ত্রের চাহিদার ব্যাপারে  জিজ্ঞাসা করেছিলেন। পরে পরেশ বড়ুয়াকে বীপূল পরিমাণে অস্ত্রের স্যাম্পল  দেখানো হয়েছিল যেখান থেকে তিনি পছন্দমত অস্ত্র নির্বাচন করেছিলেন। অবশেষে, ওই চালানের জন্য প্রায় ৬০০ টি অস্ত্র নির্বাচন করা হয়  যা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম (তখন চট্টগ্রাম নামে পরিচিত) বন্দরের কাছে একটি জাহাজের মাধ্যমে এক মাস পর সরবরাহ করা হয়েছিল । সেসময় উলফার শীর্ষস্থানীয় নেতারা চট্রাগ্রাম এলাকায় তাদের দেড়া গেড়েছিল।

বইটিতে দাবি করা হয়েছে যে, রোমানিয়ায়  অস্ত্র কেনাকাটার সমইয় উপস্থিত উলফা ত্রয়ীদের মধ্যে একজন ছিলেন লাচিত হাজারিকা ওরফে সেলিম। সেলিম সেসময় তাদের ভবিষ্যত অস্ত্রের যোগান নিশ্চিত করতে একটি সংক্ষিপ্ত সফরে সিঙ্গাপুর থেকে এজেন্টের সাথে ইউক্রেন গিয়েছিলেন। সেলিম  সম্প্রতি মিয়ানমারের একটি জঙ্গি সংগঠনের  দ্বারা ‘মৃত্যুদণ্ডে’ দণ্ডিত হয়েছেন।

অস্ত্র গ্রহণের জন্য বাংলাদেশে ফিরে বড়ুয়া গভীর সমুদ্র থেকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ট্রলার ভাড়া করেন।  বড়ুয়ার দলের সাথে সিঙ্গাপুরের এজেন্টও চট্রগ্রামের গভীর সমুদ্রে গিয়েছিলেন কিন্তু দুই রাত পর্যন্ত তারা জাহাজটির কোনো খোঁজ পাননি। বইয়ের তথ্য অনুসারে, উদ্বিগ্ন হয়ে সিঙ্গাপুরের ওই এজেন্ট তখন বুখারেস্টে তার সোর্সের সাথে যোগাযোগ করে জাহাজের অবস্থান নিশ্চত হবার জন্য।  উলফা স্কোয়াড জাহাজটি  খুঁজে পায়নি কারণ সেটি ভিন্য পথে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে যায়।

জাহাজটি বন্দরে আসার খবর পেয়ে উলফা নেতারা শঙ্কিত হয়ে পড়ে কেননা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে  ট্রাকে অস্ত্র লোড করা একটি কঠিন কাজ বলে তাদের মনে হয়ে। তারা জাহাজটিকে সুবিধাজনক সময়ের অপেক্ষায় বন্দরে ভিড়িয়ে রাখার চেষ্টাও করেন। এরইমধ্যে জাহাজটি সন্দেহজনকভাবে বন্দরে অবস্থানের ফলে সন্দেহ হওয়ায় তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্রের প্রথম চালানটি জব্দ করে পুলিশ।

পরে মোসাদের সেই এজেন্ট নিরাপদে বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে ফিরতে সক্ষম হয় কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সে “নিখোঁজ” হয়ে যায়, আর কখনো তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বইয়ের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে নিরাপদ অবস্থানে থাকা উলফা নেতারা ধরে নিয়েছিলেন যে তাদের সাথে মোসাদের ওই এজেন্টের যোগসূত্র প্রকাশের পর ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা তাকে হত্যা করেছে। \

আরও পড়তে পারেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষে বিএনপির অবস্থান নিয়ে হার্পারকলিন্সের নতুন বইয়ে তথ্য

 


শর্টলিংকঃ