ইউএনভি ডেস্ক:
এক মাসের ব্যবধানে পাবনার হাট-বাজারে পাটের দাম কমেছে মণপ্রতি প্রায় ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। দরপতনে তাদের বিঘাপ্রতি প্রায় পাঁচ হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। পাটচাষিরা বলছেন, পাটকল মালিকরা সিন্ডিকেট করায় বাজারে পাটের ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে না।তবে এ ব্যাপারে কৃষি বিপণন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন বিষয়টি তাদের জানা নেই। বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় এবং গুণগতমান ভালো না হওয়ায় এবার অনেক ব্যবসায়ীই বেশি দামে পাট কিনছেন না। এ কারণে পাটের বাজারে ধস নেমেছে।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে পাবনায় ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে প্রায় দুই হাজার ৯৫০ হেক্টর বেশি। প্রতি হেক্টরে দুই দশমিক ৫০ টন হিসেবে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক লাখ ২০ হাজার টন। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে প্রতি হেক্টরে দুই দশমিক ৮০ টন হিসেবে পাট উৎপাদন হয়েছে যা মোট হিসাবে এক লাখ ৩৪ হাজার ৪০০ টন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৪ হাজার ৪০০ টন বেশি। তবে উৎপাদিত পাটের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ ভাগ পাট ‘এ’ ও ‘বি’ গ্রেডের। অবশিষ্ট পাট ‘সি’ গ্রেডের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুর দিকে মাস খানেক আগে প্রতি মণ পাটের দর ছিল ৩২০০-৩৩০০ টাকা। প্রথম দিকে চাষিরাও খুব খুশি হয়েছিলেন। পাটের সোনালি অতীত ফিরে পাওয়ার আশায় ছিলেন তারা। কিন্তু হঠাৎ দাম কমে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন চাষিরা। দাম কমতে কমতে এখন তা ২৩০০-২৪০০ টাকায় নেমে এসেছে।
চাষিরা বলছেন, জমিতে যতটুকু পাট উৎপাদন হয়েছে সেটুকুরও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না তারা। উৎপাদন খরচ প্রতি বিঘা জমিতে ১২-১৫ হাজার টাকা। আর বিঘায় উৎপাদন হয় মাত্র ৫-৭ মণ পাট।
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রামের পাটচাষি হাফিজুর রহমান জানান, তিনি দুই একর (ছয় বিঘা) জমিতে তোষা পাট আবাদ করে ফলন পেয়েছেন মাত্র ৪২ মণ। উৎপাদন ব্যয় হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার টাকা। প্রতি মণ পাট ২৩০০ টাকা দরে বিক্রি করে পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৬০০ টাকা। এ বছর পাট উৎপাদন বাবদ তার লোকসান হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার ৪০০ টাকা। পাটকাঠি বিক্রি করেও লোকসান কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না।
শুধু হাফিজুর রহমান না, পাবনার সব চাষি পাট আবাদ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন। যেসব প্রান্তিক কৃষক জমি লিজ নিয়ে চাষ করেছেন তাদের আরও বেশি টাকা লোকসান হচ্ছে।বামনডাঙ্গা গ্রামের কৃষক মাহমুদুল হাসান বলেন, তিনি এ মৌসুমে দেড় বিঘা জমিতে পাট চাষ করে ১১ মণ পাট পেয়েছেন। গত বছর সমপরিমাণ জমি থেকে পাট পেয়েছিলেন ১৪ মণ এবং বিক্রি করেছিলেন ২ হাজার ৮০০ টাকা দরে। এবার পাট চাষ করে তিনি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ভবিষ্যতে পাট চাষ করবেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন তিনি।
এদিকে জোতদার শ্রেণির কৃষকরা কম দামে পাট বিক্রি না করে মজুত করে রাখছেন। আর মধ্যসত্ত্বভোগীরা হাট-বাজার থেকে কম দামে ‘এ’ ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রেডের পাট কিনে গুদামজাত করছেন। পরে তারা এই পাট সরকারি ও বেসরকারি জুটমিল ও রফতানিকারকদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হবেন।পাবনার আতাইকুলা হাটের পাট ব্যবসায়ী অশোক কুমার সরকার জানান, আমরা পাবনার বিভিন্ন হাট থেকে পাট কিনে খুলনা নারায়ণগঞ্জের বড় বড় আড়ৎদার, বেলার ও রফতানিকারকদের কাছে পাইকারি বিক্রি করি। দেশে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ফলে বড় বড় সিন্ডিকেট পাটের দর নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের কারণে দাম ওঠা-নামা করে। অনেক সময় বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকরা পাটের দাম কম পাচ্ছেন ঠিক, তবে সরকারের পক্ষ থেকেও বাজারদর ঠিক করা দরকার।
পাট রপ্তানিকারক সৈয়দ শাহিন রেজা জানান, হাট-বাজারে প্রতি মণ পাট দুই হাজার ৩০০ টাকা থেকে দুই হাজার ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে উন্নতমানের প্রতি মণ পাট আরও ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। চলতি পাট মৌসুমে অর্থাভাবে রফতানিকারক ও বেসরকারি জুট মিলগুলো পাট কিনতে না পারায় এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। স্পিনিং জুট মিলে সুতলি তৈরি ও রপ্তানিমানের ‘এ’ ও ‘বি’ গ্রেডের প্রতি মণ পাট ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
একাধিক পাট ব্যবসায়ী জানান, পাটকলগুলো গত বছরের বকেয়া টাকা পরিশোধ করেনি। চলতি মৌসুমে শুরু থেকে পাটকলগুলো বাকিতে পাট কিনছে। ফলে নগদ টাকার অভাবে পাট ব্যবসায়ী, বেলার ও রপ্তানিকারকরা পাট ক্রয় না করে হাত গুটিয়ে বসে আছেন। আশ্বিন-কার্তিক মাসে প্রান্তিক কৃষকের হাতে নগদ টাকা থাকে না। এজন্য তারাও লোকসান দিয়ে পাট বিক্রি করছেন।
বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের (বিজেএমসি) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, পাট উৎপাদন করে কৃষক সবসময় ঠিক দাম পায় না। আসলে পাট বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু বিষয় কাজ করে। বর্গা ও প্রান্তিক কৃষক তার প্রয়োজনে অপেক্ষাকৃত কম দামে পাট বিক্রি করে দেয়। সেটা মহাজনরা কিনে গুদামজাত করে রাখে। পরে তারা বেশি দামে বিক্রি করে। এদিকে কৃষকরা যে পাট বিক্রির মূল্য হিসাব করে তার সঙ্গে কিন্তু পাটকাঠির দাম ধরে না। সেই কাঠিটাও অনেক দামি। এক মণ পাটের সঙ্গে প্রায় দুই মণ কাঠি পাওয়া যায়। এখন অনেক দেশেই বাংলাদেশ থেকে পাট পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। বিদেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে বলেও তিনি জানান।
পাবনা জেলা সিনিয়র কৃষি বিপণন (বাজার) কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম বলেন, গতবার অনেক ব্যবসায়ী ৩ হাজার টাকা করে পাট কিনে পরে ২ হাজার টাকা করে বিক্রি করাতে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যে কারণে এবার পাট কেনার আগ্রহ কম। বৈশ্বিক বাজারের ওপর নির্ভর করে তারা পাট কিনে থাকেন।তিনি আরও বলেন, এবার পাটও ভালো হয়নি। আবার পানির অভাবে কৃষক সেটা ঠিকমতো জাগ দিতে পারেনি। পাটের মান খারাপ হওয়ায় পাটের দাম কমে যাচ্ছে। বাজারে সিন্ডিকেট আছে কিনা জানা নেই। তবে আমরা নিয়মিত পাটের দর তদারকি করছি।
পাবনার মূখ্য পাট পরিদর্শক হাজ্জাজুর রশীদ জানান, জেলায় পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। এ জলার পাটের মান ভালো হওয়ায় চাহিদাও বেশ ভালো। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. জামাল উদ্দীন বলেন, পাটচাষিদের উপযুক্ত দাম পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের কোনো হাত নেই। তবে চাষিরা পাট চাষ করে লাভবান না হলে ভবিষ্যতে আমাদের অর্থনীতির জন্য সংকট সৃষ্টি হতে পারে।