বিরিয়ানির নাম ‘শোলে’


‘ফিউশন’ হলেও স্বতন্ত্র

হাজারা সম্প্রদায়ের খাদ্যসংস্কৃতিকে বলা চলে ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য এশিয়া ও পারস্যের রসনার ত্রিধারার এক অনবদ্য ‘ফিউশন’। তবে সেই মেলবন্ধন নিছক অন্যের রূপ-রস ও তাবৎ গুণাবলি ধার নেয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তা খাওয়া-দাওয়ার দুনিয়ায় এক আকর্ষণীয় স্বতন্ত্র ধারাও সৃষ্টি করেছে বৈকি। হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষ অতিথিকে খাইয়ে সুখ পান। তাই তাদের দস্তরখান বরাবরই মুখরোচক অভিনব সব পদে পূর্ণ হয়ে থাকে। বাড়িতে আসা অতিথিদের জন্য বরাদ্দ থাকে সবচেয়ে কোমল ও আরামদায়ক আসন।

রুটি বেশি চাল কম

দক্ষিণ এশিয়ার যে মরুময় এলাকাগুলোয় হাজারাদের আদি আবাস ছিল, সেখানে স্বভাবতই চাল দুর্লভ সামগ্রী বলেই গণ্য হতো। ফলে হাজারা খাদ্যসংস্কৃতিতে ভাত কী পোলাও, অথবা চাল দিয়ে তৈরি কোনো পদ ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। তাহলে আছেটা কী? আছে রুটি। বৈচিত্র্যপূর্ণ স্বাদের বহু রকমের রুটি হাজারা রসনার প্রধান আকর্ষণগুলোর একটি নিঃসন্দেহে। তাওয়ায় সেঁকা রুটি, তন্দুরে পোড়ানো রুটি… কত রকম চাই! ‘বোলানি’ নামের বিশেষ এক রুটি তৈরি করা হয় উৎসব ও বিশেষ যত দিনে।

মোটা পরোটার মতো দেখতে এ রুটির মধ্যে পোরা থাকে আলু, পেঁয়াজকলি, রসুনকুচি, গোলমরিচ ও নুনের তৈরি পুর। মাঝেমধ্যে আলুর বদলে কুমড়া দিয়েও পুরের ‘বেস’ বানানো হয়ে থাকে। আরো আছে ‘নান-বাটা’ নামের এক রুটি দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের খাবার— আকৃতিতে তা রীতিমতো একটা আস্ত ছোটখাটো চাকার সমান পুরু হয়ে থাকে। নান-বাটা তৈরি করতে উপাদান বেশি লাগে না। শুধু চাই টুকরো বা গুঁড়ো করা শুকনো রুটি (অর্থাৎ হালে ইংরেজি বুলিতে যাকে বলে ‘ব্রেডক্রাম্বস’), নোনতা মাখন, টক দই বা ঘন দুধ ও লবণ।

প্রথমে দই (দইয়ের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে জল মেশানো আবশ্যক) বা দুধ ঘন করে জ্বাল দিয়ে তাতে নুন মিশিয়ে নেয়ার পর রুটির টুকরোয় আচ্ছামতো গলানো মাখন মিশিয়ে একটা চাকার মতো আকৃতি দিয়ে বাটিতে রাখতে হয়। চাকার মাঝের অংশে জ্বাল দেয়া দই কিংবা দুধ-নুনের মিশ্রণ ঢেলে দিয়ে তার ওপর গলানো মাখন ছড়িয়ে দিলেই তৈরি হয়ে যায় নান-বাটা। সকালের নাশতা হিসেবে হাজারাদের মধ্যে এ পদটি বেশ জনপ্রিয় বৈকি।

সকালবেলার খিদে

হাজারাদের মধ্যে অনেকেই সকালে ভরপেট আস খেয়ে কাজে যান। ‘আউস’ বা ‘আস’ হাজারা রসনায় স্যুপ-জাতীয় পদগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তম। আস আদতে দূর পারস্য থেকে আসা পদ। যথারীতি তাতে হাজারাদের নিজস্ব খাদ্যসংস্কৃতির ছোঁয়া লেগে উেসর চেয়ে খানিক ভিন্ন কিসিমের হয়ে উঠেছে। পারস্যে আস বহু রকমের হলেও হাজারারা যে আস তৈরি করেন তা একান্তই মোটা আকৃতির নুডলস ও টমেটো দিয়ে মূলত তৈরি হয়। আর ওপরে ছড়িয়ে দেয়া হয় দই দিয়ে বানানো বিশেষ এক ধরনের চাটনি ‘ছাকা’ ও কুচি কুচি করা পুদিনা পাতা।

আস বানানোর সময় কখনো-সখনো মাংসের সুপক্ব কিমা বা নানা রকমের ডাল ও শস্যও দেয়া হয়। তবে প্রতিদিনের খাবার ও রোগীর পথ্য হিসেবে পূর্বোক্ত স্রেফ টমেটো দিয়ে তৈরি সাদামাটা আসই হাজারাদের মধ্যে অধিকতর জনপ্রিয়। মাংসমণ্ডিত আস উৎসবের দিন ছাড়া পাওয়া মুশকিল। সকালের নাশতা হিসেবে ‘ডালডা’ নামের গমের তৈরি এক পদও খুব সুস্বাদু (আমাদের চেনা ডালডার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই)। সারারাত গমের আস্ত দানা ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে তা পেঁয়াজ-রসুন ও নানা রকমের বাহারি মসলা মিশিয়ে বানাতে হয় ডালডা। সকালে রুটি দিয়ে ডালডা খাবার চল রয়েছে।

গুরুপাক পদ

বিশেষ পর্ব বা উপলক্ষের দিনে দুপুরের গুরুপাক পদ হিসেবে হাজারা রসনায় এক অদ্ভুত নামের খাবার প্রচলিত আছে। নাম তার ‘শোলে’ বা ‘শোলা’! না না, ধর্মেন্দ্র-অমিতাভ বচ্চনের শোলে নয়। নয় আমাদের চেনা শোলাও। এ শোলে অথবা শোলা কার্যত হাজারাদের হাতে তৈরি বিরিয়ানি। চিকন চাল, প্রচুর মাংস, নানা রকম ডাল ও শস্য আর বহু কিসিমের মসলা দিয়ে তৈরি শোলে একাই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ভোজের আয়োজন। ‘চাউল তরকারি’ নামের মাংসের কারি ও ভাপানো ভাত মেশানো আরেকটি পদ বিবাহ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করার রীতি রয়েছে।

তবে আগেই বলেছি কিনা, আবহাওয়াহেতু হাজারাদের চালের মজুদ বাড়ন্ত। তাই দুপুরের খানায় বেশির ভাগ সময় রকমারি রুটিই সই। আর রুটির সঙ্গে খাবার জন্য আছে বহু রকমের চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য পদ। ‘কাবারদাঘ’ নামের এক বিশেষ ধরনের মাংসের পদের কথা প্রথমে বলি। প্রথমে গরু, ছাগল বা ভেড়ার মাংস রসুন ও নুন দিয়ে ভাজার আয়োজন। উপরাংশ ভাজা ভাজা হয়ে এলে পরে তা ভাপে ৩-৪ ঘণ্টা ঢিমাতালে ভাপিয়ে পরিবেশন করা হয়। ‘পাইচা’ পদটিও রান্না করার বেলায় হাতে সময় রাখা আবশ্যক।

পাইচা বানানো হয় গরু-ছাগলের পা ও মাথা প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে ধীরলয়ে সেদ্ধ করে—যেমন সুস্বাদু তেমনি স্বাস্থ্যকর। মুখ্যত শীতকালে বাড়ির সবাই মিলে পাইচা খাওয়া হয়। শীতকালে পূর্ব এশিয়ার মোমো বা ডাম্পলিংয়ের মতো একটি পদও হাজারারা পরিবারের সবার জন্য বানিয়ে থাকেন, সেটির নাম ‘মান্টু’। মান্টুর রন্ধনপ্রক্রিয়া মোমোর মতো হলেও তা গড়নে-ধরনে অনেকটা আলাদা।

প্রথমে ময়দা দিয়ে প্রস্ফূটিত গোলাপের মতো মান্টুর মূল কাঠামো বা মোড়ক তৈরি করা হয়। তারপর সেগুলো ভাপিয়ে ভেতরে ছাগলের মাংসের কিমার পুর ভরে দেয়া হয়। ওপর দিয়ে পেঁয়াজ-রসুন ও বুটের ডাল দিয়ে তৈরি এক ধরনের কারি ছড়িয়ে দেয়ারও চল। এর ওপরেও আবার কেউ কেউ রসুনকুচি ও পেঁয়াজকলি মেশানো দইয়ের রায়তা দিয়ে থাকেন। মাংসের শুটকির মতো হাজারারা গোমাংস শুকিয়ে তাতে মসলা মিশিয়ে ‘কাদিদ’ নামের একটি জিনিস বানান। কাদিদ বানাতে কমপক্ষে ছয় সপ্তাহ লাগে।

মিঠাই ও পানীয়

সত্যি বলতে কী, হাজারাদের মধ্যে শেষপাতে মিষ্টি খাবার অভ্যাস খুব একটা দেখা যায় না। তাদের মধ্যে মিঠাইজাতীয় খানাখাদ্যের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে, তা-ও বলা মুশকিল। তবু দুয়েকটি ব্যতিক্রম আছে। ‘সির ইয়াখ’ নামের একটি পদের কথা বলা যায়, সেটি আদতে আইসক্রিমের আদিপুরুষ। ঘন দুধের সঙ্গে পেস্তাবাদাম ও নানা রকম মুখরোচক মসলা মিশিয়ে তৈরি করা শির ইয়াখের সঙ্গে মিল পাবেন কুলফি বরফের।

আর ‘সির বিরিঞ্জ’ আদতে ফিরনি কী পায়েসের জাতভাই। গোলাপজল, দারচিনি, এলাচ, নানা রকম বাদাম, চাল ও দুধের অপরূপ সমন্বয়ে নির্মিত এ মিষ্টি পদটি যে কাউকে মুগ্ধ করবে। আটা, বহুদিন ভিজিয়ে নরম করে তোলা গমের দানা ও চিনি মিশিয়ে তৈরি ‘হালুয়া-ই-সামানাক’ও মিষ্টি পদ হিসেবে হাজারাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে।

এছাড়া রয়েছে পানীয়। ‘মলিদা’ নামের একটি বিশেষ পানীয় হাজারারা খুব পছন্দ করেন। বিশেষ ধরনের সুগন্ধি চাল ও নানা রকম ফল মিশিয়ে তৈরি এ মলিদা উৎসবের পানীয় হিসেবে খ্যাত। ‘সির রোগো’ নামে দুধ-চার সঙ্গে মাখন মিশিয়ে তৈরি আরেক পানীয়ও তারা নিয়মিত খেয়ে থাকেন। ধারণা করা হয়, সির রোগো আদতে এসেছিল তিব্বত থেকে। তিব্বতীদের নুন-মাখন মেশানো চা খাবার ‘ট্র্যাডিশন’ দেখেই নাকি হাজারারা একদম স্বকীয় এক মিঠে পানীয় বানিয়ে ছেড়েছেন।

শাকের আনোয়ার: প্রাবন্ধিক


শর্টলিংকঃ