রেল কর্মকর্তা অসীমের দুর্নীতির বিষয়ে দুদক সচিবের ক্লিনচিটে তোলপাড়


বিশেষ প্রতিবেদক :

দুদক সচিব চিঠি দিয়ে তাকে ক্লিনচিট দিলেও এই প্রতিবেদক রোববার বিকেলে খোদ অসীম কুমার তালুকদারের সঙ্গে কথা বলেন। তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলমান আছে কিনা জানতে চাইলে অসীম কুমার তালুকদার বলেন, দুদকের অনুসন্ধান এখনো চলমান। তিনি দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে চাহিদামতো সব নথিপত্র সরবরাহ করেছেন। তাকে দুদক কার্যালয়ে ডেকে কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।

রেল কর্মকর্তা অসীমের বিষয়ে দুদক সচিবের চিঠি নিয়ে তোলপাড়

পশ্চিম রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী ( সঙ্কেত ও টেলিকমিউনিকেশন্স) অসীম কুমার তালুকদারকে দুর্নীতির অভিযোগে কয়েকমাস আগে বদলি করা হয়েছিল চট্টগ্রামে পুর্ব রেলওয়ের একই পদে। তবে সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়েছেন। তাকে বাংলাদেশ রেলওয়ের রেলপথ পরিদর্শক (জিআইবিআর) পদে পদায়ন করা হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ও বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান চলমান থাকার পরও তাকে পদোন্নতি দেওয়ার ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন রেলের কর্মকর্তা কর্মচারিরা। এই ঘটনা জানাজানির পর রেল কর্মকর্তা কর্মচারিদের মাঝে তোলপাড় চলছে। অনেকেই বলছেন বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক এই কর্মকর্তা টাকার বিনিময়ে সবকিছু ম্যানেজ করেই পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অসীম কুমার তালুকদারকে পদোন্নতির আগে রেলপথ মন্ত্রণালয় দুদকে একটি চিঠি পাঠিয়ে তার সম্পর্কে অনুসন্ধানাধীন অভিযোগের তথ্যাবলী সংগ্রহ করেন। দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান চলমান থাকার পরও দুদক সচিব ফেরত চিঠিতে অসীম কুমার তালকুদারকে ক্লিনচিট দিয়েছেন। দুদক সচিবের এই চিঠির ঘটনাটি জানাজানির পর দুদকেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে সচিব উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ায় দুদক কর্মকর্তা কর্মচারিরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

এ সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে, পুর্বরেলের সিএসটিই বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী পদে থাকাকালীল রেল কর্মকর্তা অসীম কুমার তালুকদার সম্প্রতি তার পদোন্নতি ও সিনিয়র স্কেলের জন্য আবেদন করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ে। এ সূত্রে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব গত ৩০ ডিসেম্বর দুদক সচিব বরাবর একটি চিঠি দিয়ে অসীম কুমার তালুকদারের বিরুদ্ধে দুদকে কোন মামলা আছে কিনা-বা তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন অভিযোগ তদন্ত বা অনুসন্ধান চলমান রয়েছে কিনা, জানতে চান। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের চিঠির জবাবে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত গত ১৬ জানুয়ারি একটি ফেরত চিঠি দেন। এই চিঠিতে দুদক সচিব উল্লেখ করেন, পুর্ব রেলওয়ে ( চট্টগ্রাম) কর্মকর্তা অসীম কুমার তালুকদারের বিরুদ্ধে দুদকে কোন মামলা তদন্ত বা অভিযোগ অনুসন্ধান চলমান নেই।

পশ্চিম রেলওয়ের

রেলভবন সূত্রে জানা গেছে, দুদক সচিবের এই চিঠি প্রাপ্তির পর রেলপথ মন্ত্রণালয় অসীম কুমার তালুকদারের পদোন্নতি ও সিনিয়র স্কেল প্রদানপুর্বক অতি সম্প্রতি তাকে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সমমানের পদ- বাংলাদেশ রেলের রেলপথ পরিদর্শক ( জিআইবিআর) পদে পদোন্নতি ও পদায়ন করা হয়েছে। সিনিয়র স্কেলও প্রদান করা হয়েছে তাকে। ফলে অসীম কুমার তালুকদার দুই সপ্তাহ আগে চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে রেলভবনে বদলিকৃত পদে যোগদান করেন।

এদিকে নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অসীম কুমার তালুকদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান চলমান রয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে। দীঘদিন ধরে পশ্চিম রেলওয়ের বিভিন্ন পদে কর্মরত থাকাকালে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে। অভিযোগ যাচাই বাছাই শেষে ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক (অনুসন্ধান ও তদন্ত-১) সেলিনা আক্তার এক চিঠিতে তার বিরুদ্ধে হওয়া অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদকের রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক ও রাজশাহী সমন্বিত দুর্নীতি দমন কমিশন জেলার উপ-পরিচালককে চিঠি দেন।

অনুসন্ধান নং-ইআর-৩৫/১৯। তাং-১৬/১০/২০১৯ ইং। এরপর থেকে অসীম কুমার তালুকদারের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগটি তদন্ত করছেন রাজশাহী দুদকের সহকারি পরিচালক (এডি) নাজমুল হক।

সূত্র বলছে, অসীম কুমার তালুকদারের দীর্ঘ সময়ের কর্মস্থল পশ্চিম রেলওয়ের সদর দপ্তর রাজশাহী থেকে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ইতিমধ্যে বিপুল পরিমাণ নথিপত্র জব্দ করেন। একই সময়ে রাজশাহী দুদক কার্যালয়ে ডেকে তাকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী সমন্বিত জেলা দুদকের উপ-পরিচালক মো: জাহাঙ্গীর আলম জানান, পশ্চিম রেলওয়ের (রাজশাহী) সিএসটিই বিভাগের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী অসীম কুমার তালুকদারের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান আছে। তবে সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে ফলাফল সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা এডি নাজমুল হক মোবাইল ফোনে নয় বরং সরাসরি তার দপ্তরে উপস্থিত হয়ে কথা বলার অনুরোধ করেন।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখতের দপ্তরে ফোন দিলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ই-মেইল করে বক্তব্য চাওয়া হলে রোববার বিকালে এই প্রতিবেদন তৈরির সময় পর্যন্ত কোন উত্তর আসে নি। তবে এই বিষয়ে দুদকের বক্তব্য জানতে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘হতে পারে রেল কর্মকর্তা অসীম কুমার তালুকদারের অভিযোগ অনুসন্ধান শেষ হয়েছে অথবা অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি’। তবে অনুসন্ধান শেষ হয়েছে অথবা চলমান রয়েছে কিনা সেই বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করতে পারেন নি।

এদিকে দুদক সচিব চিঠি দিয়ে তাকে ক্লিনচিট দিলেও এই প্রতিবেদক রোববার বিকেলে খোদ অসীম কুমার তালুকদারের সঙ্গে কথা বলেন। তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলমান আছে কিনা জানতে চাইলে অসীম কুমার তালুকদার বলেন, তার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান এখনো চলমান রয়েছে। তিনি দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে চাহিদামতো সব নথিপত্র সরবরাহ করেছেন। তাকে দুদক কার্যালয়ে ডেকে কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সম্প্রতি তিনি পুর্ব রেলের সিএসটিই পদ থেকে জিআইবিআর পদে পদোন্নতি পেয়েছেন বলেও জানান।

দুদক

রেলের প্রভাবশালী কর্মকর্তা অসীম কুমার তালুকদারের বিরুদ্ধে ৪০ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। পশ্চিম রেলওয়ের সংস্থাপন কর্মকর্তা থাকাকালীন লোকবল নিয়োগে ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ছাড়া প্রধান সঙ্কেত ও টেলিকমিউনিকেন্স প্রকৌশলী থাকাকালে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি করেন বলে দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে জানা গেছে।

ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, রাজশাহী শহরের বিভিন্ন ব্যাংকে তার ও স্ত্রীর নামে ৮৫ লাখ টাকা ডিপোজিট রয়েছে। এছাড়া ৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। নগরীর সিপাইপাড়ায় স্ত্রী বণ্যা ঘোষের নামে একটি ৫ তলা ভবন কিনেছেন যা একটি ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টারকে ভাড়া দিয়েছে। অসীম কুমার তালুকদারের বিরুদ্ধে ঘন ঘন সিঙ্গাপুর ভ্রমণের তথ্য রয়েছে যার মাধ্যমে তিনি বিদেশে অর্থপাচার করে আসছেন।

ঢাকার সুত্রাপুরে ছেলের নামে কিনেছেন ফ্ল্যাট যে টাকার বৈধ কোন উৎস্য নেই। এর বাইরে ঢাকার বাড্ডা থানার পার্শ্বে প্রগতি সরণির সংলগ্ন এলাকায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়ে বাড়ি কিনেছেন অসীম কুমার তালুকদার। বাড়ি নং-২৪৫। মাদারীপুরে নিজ গ্রামে কিনেছেন ১৫০ বিঘা জমি নিজের নামে যার দলিল নং-১৩৬৭/১৬। ঢাকা ব্যাংকের কাকরাইল শাখায় নিজ নামে ৫৫ লাখ, প্রিমিয়ার ব্যাংক ফকিরাপুল শাখায় স্ত্রীর নামে ৭০ লাখ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক মিরপুর-১০ শাখায় নিজ ও স্ত্রীর যৌথনামে রয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, এক্সিম ব্যাংক সদরঘাট শাখায় নিজ নামে ৫০ লাখ টাকা রয়েছে।

এদিকে অসীম কুমার তালুকদার নিজে ৩৬ লাখ টাকায় একটি প্রিমিও সুপার প্রাইভেট কার কিনেছেন যার নং- ঢাকা-মেট্টো-গ-২৩-৮৫২২। রাজশাহীর অভিজাত আবাসিক এলাকা পদ্মা আবাসিক এলাকায় বানিয়েছেন বাড়ি। এসব বিপুল সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে অসীম কুমার তালুকদার বলেন, তার এতো সম্পদ নেই। কেউ হয়তো শক্রতা করে দুদকে অভিযোগ দিয়েছেন। যার কোন সত্যতা নেই।


শর্টলিংকঃ