শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার বন্ধ বড় চ্যালেঞ্জ


ইউএনভি ডেস্ক:

আজ (৩০ জুলাই) আন্তর্জাতিক মানবপাচার প্রতিরোধ দিবস। চার বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার সূচকে (ট্রাফিকিং ইন পারসন-২০২০) একধাপ উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার সূচকে টায়ার-২-এ অবস্থান করে বাংলাদেশ।

এরপর তিন বছর টায়ার-২ নজরদারির তালিকায় অবস্থান শেষে চতুর্থ বছরে আবারও টায়ার-২ স্তরে ফিরে যায় বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র এ বছর ১৪টি সুপারিশ করেছে বাংলাদেশকে। আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে পরিস্থিতির আরও উন্নতি করতে চায় সরকার। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতির মূল চ্যালেঞ্জ হলো, শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার বন্ধ করা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে যে সুপারিশগুলোর কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে প্রথমেই আছে, শ্রম অভিবাসনের নামে পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টি। এছাড়া আরও আছে– নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সির দ্বারা কর্মীদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ বন্ধ করে সরাসরি নিয়োগকর্তাকে টাকা দিয়ে নিয়োগের ব্যবস্থা; রোহিঙ্গা পাচারের বিষয়ে তদন্ত বাড়ানো; পাচারের শিকার ব্যক্তির যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিতে গাইডলাইন এবং স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসেডিওর (এসওপি) তৈরি; পাচারের শিকার ব্যক্তিদের দেশে-বিদেশে সেবার পরিমাণ বৃদ্ধি; কোর্টের আদেশ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে সেবার সুযোগ দেওয়া; সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র ত্যাগের আগে অভিভাবকের অনুমতির বিষয়টি বাদ দেওয়া।

এছাড়া সুপারিশমালায় আরও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের পাচারকারীদের হাত থেকে সুরক্ষা দিতে পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন এবং সমন্বয় গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয় আরও বাড়াতে হবে; মানবপাচার রোধে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শ্রম পরিদর্শক, অভিবাসন কর্মকর্তাসহ সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ আরও জোরদার করতে হবে; রিক্রুটিং এজেন্টদের তদারকি ও দালালদের নিবন্ধন নিশ্চিত করতে হবে; প্রাক বহির্গমন প্রশিক্ষণের মান আরও ভালো করতে হবে; রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যাতে অভিযোগ দায়ের করতে পারে সেজন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে; বেসরকারি সংস্থা ও সুশীল সমাজের সঙ্গে সমন্বয়ে উন্নয়ন করতে হবে এবং মানবপাচার প্রতিরোধে জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা ২০১৮-২০২০ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে।

মানবপাচার প্রতিরোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার যেমন চ্যালেঞ্জ তেমনি ক্রসবর্ডার ট্রাফিকিং অর্থাৎ নিজ সীমান্ত দিয়ে পাচারের ঘটনাও কিন্তু কম না। দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানবপাচার মামলা ঝুলে আছে। এর মধ্যে নয়টি জেলায় এই মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই নয় জেলায় ২০০ মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছে জাস্টিজ অ্যান্ড কেয়ার বাংলাদেশ। সেখানে তারা দেখতে পায়, ৮০ শতাংশ মামলাই ক্রসবর্ডার ট্রাফিকিং। আর বাকি ১২ শতাংশ অভ্যন্তরীণ পাচার এবং ৮ শতাংশ বহির্বিশ্বে পাচার।

সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর তরিকুল ইসলাম মনে করেন, গত বছরের অর্জন ছিল আশানুরূপ। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলো আবারও নতুন করে চিন্তা করতে হবে। এর জন্য আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এবং সমন্বয় তৈরি করা। এছাড়া বহির্বিশ্বে অপরাধের নেটওয়ার্ক ভাঙতে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজন আছে।’

মানবপাচার প্রতিরোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করছে, আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশ টায়ার-২ থেকে টায়ার-১-এ উন্নীত হতে পারবে। এক্ষেত্রে সুপারিশ অনুযায়ী যে ব্যবস্থাগুলোর কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের সাগর পার হয়ে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করার বিষয়টি আছে। সেখানে নিরাপত্তাও বেশ দুর্বল। তাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশে সীমানা প্রাচীর তৈরি করছে সরকার। এতে মূল গেট ছাড়া কেউ ক্যাম্প ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনটি সুপারিশ এই পদক্ষেপে বাস্তবায়ন হয়ে যাবে। এছাড়া আরও আর চারটি সুপারিশ আছে ভিক্টিম কেয়ার সংক্রান্ত। এটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত, আর দেশের বাইরে মাত্র চার-পাঁচটা ভিক্টিম কেয়ার সেন্টার আছে। সেগুলোর ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলাপ করছে বলে জানা গেছে।

তবে শ্রম অভিবাসনের নামে পাচার একটি চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন মানবপাচার প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক ও আইসিটি) আবু বকর সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের রিপোর্টে যেসব সুপারিশমালা আছে সেগুলো একটি একটি করে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করা হয়েছে, যাতে পরবর্তী বছর এই বিষয়গুলো পুনরায় সুপারিশে না আসে। ১৪টি সুপারিশের মধ্যে চারটি হলো অভিবাসন সম্পর্কিত। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। আসলে শ্রম অভিবাসনের নামে যেসব পাচারের ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন দেশে সে বিষয়ে এখানে কিছু করার সুযোগ কম।’

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘একজন কর্মী দুই বছরের ভিসা নিয়ে সৌদি কিংবা অন্য কোনও দেশে গেছে কাজে। দেখা গেছে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে দালালের পাল্লায় পড়ে ইউরোপ যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করছে। পরে দেখা যাচ্ছে, লিবিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে দিল বাংলাদেশকে নিয়ে। এই লোকটা কিন্তু বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবেই সৌদি গেছে। সেখান থেকে যদি অন্য দেশে অবৈধভাবে যায় সেখানে করার কিছুই থাকে না। দেখা যায় মেসিডনিয়া, গ্রিসে গিয়ে ধরা পড়ছে। এগুলোর বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’

তিনি বলেন, ‘এর বাইরে তিনটি সুপারিশ আছে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত। ক্যাম্পের বিশাল এলাকায় সীমানা প্রাচীর করে দিলেই কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে, বেশি বেতনের আশায় প্রলোভনে পড়ে যাচ্ছে। তাদের কীভাবে দেশে কাজ দেওয়া যায় সেটা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। কারণ দেশে যদি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, তাহলে বিদেশে আর যাবে না। আমরা এসব বিষয়ে দেখছি, বেশ কিছু প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি, আশা করি এই অবস্থার উন্নতি হবে। আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করছি একসঙ্গে।’

বর্ডার ম্যানেজমেন্ট আরেকটু শক্তিশালী করলে ক্রসবর্ডার ট্রাফিকিংয়ের মতো ঘটনা কমে যাবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘পাচারের আবার একটা বড় অংশ হলো ক্রসবর্ডার। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত দিয়ে অনেকে চলে যায়। এক্ষেত্রে আমরা বর্ডার ম্যানেজমেন্ট আরও শক্তিশালী করতে চাচ্ছি। এগুলোর জন্য আমাদের কিছু ট্রেনিং আর সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম আছেই। এতে আশা করি অবস্থার আরও উন্নতি হবে। আর বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের সাতটি ট্রাইব্যুনাল হয়েছে কিন্তু করোনার কারণে কার্যক্রম শুরু করতে পারিনি। শুরু হলে আশা করি ঝুলে থাকা সাড়ে চার হাজার মামলা দ্রুত কমে যাবে।’

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান মনে করেন, শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার আমাদের জন্য ভবিষ্যতে বড় হুমিক। তিনি বলেন, ‘টিআইপি রিপোর্টে যে সুপারিশগুলো আছে সেগুলোর সঙ্গে আমাদের জাতীয় কর্মপরিকল্পনার যে লক্ষ্য আর এসডিজি যে লক্ষ্য আছে সেগুলো কিন্তু প্রায় কাছাকাছি। এক্ষেত্রে আমাদের সমন্বয়গুলো জোরদার করতে হবে। একসময় আমাদের সঙ্গে যে ক্রসবর্ডার ট্রাফিকিং হতো এটিকে আমি ভবিষ্যৎ হুমকি হিসেবে মনে করি না। ভারত নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যেভাবে সুরক্ষা বাড়াচ্ছে তাতে এটা কমে আসবে। কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ হলো শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার বন্ধ করা। আমাদের দেশের নারীরা বিদেশে পাচার হচ্ছে, ড্যান্সবারে বিক্রি হচ্ছে, লিবিয়ায় গিয়ে মারা যাচ্ছে। শ্রম অভিবাসনের নামে পাচার আমাদের জন্য বড় হুমকি হয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের মেকানিজমে যদি খুব ভালো সমন্বয় না হয়, তাহলে কিন্তু হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘টিআইপি রিপোর্টে কিন্তু ভিসা কেনাবেচা, শ্রম অভিবাসনের নামে পাচার একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে। এই জায়গায় আমাদের বিচ্ছিন্নভাবে না করে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’


শর্টলিংকঃ