হাজারাদের শিল্প-সংস্কৃতি ভাষা ও সাহিত্য


ভৌগোলিক দিক থেকে আফগানিস্তান পাহাড়-পর্বতে ঘেরা এক রুক্ষ প্রকৃতির দেশ। দেশটির সমাজ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত অসংখ্য জাতি, উপজাতি, আদিবাসী, গোত্র ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এসব জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে হাজারা অন্যতম। যদিও হাজারাদের অধিকাংশই মধ্য আফগানিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত, যা হাজারজাত অঞ্চল নামে পরিচিত, তবে পাকিস্তানের বালুচিস্তানে ও ইরানে হাজারারা বসতি গড়ে তোলে। আফগানিস্তানে হাজারাদের সঠিক সংখ্যা জানা নেই। কারণ সে দেশে কখনো সম্পূর্ণ জাতীয় আদমশুমারি হয়নি। তবে ধারণা করা হয়, আফগানিস্তানে হাজারাদের সংখ্যা আনুমানিক ২৭ লাখ এবং পাকিস্তানে তাদের সংখ্যা দেড় লাখের বেশি। এছাড়া বিশ্বের উন্নত বিভিন্ন দেশে হাজারাদের বসতি রয়েছে। অধিকাংশই শিয়া মুসলমান।

হাজারা জাতিগোষ্ঠীর উত্পত্তি কোথায় কিংবা তাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কী ছিল, তা নিয়ে সঠিক এবং বাস্তবসম্মত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়নি। কেননা হাজারাদের পরিচয় প্রমাণ করার জন্য বিশ্বাসযোগ্য কোনো দলিল বা তথ্য নেই। তাই তাদের পরিচয় সম্পর্কে নৃতত্ত্ববিদ, জাতিবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদদের মধ্যে একাধিক মতামত চালু আছে। এসব বিশেষজ্ঞের বিভিন্ন মতামত পর্যালোচনা করে হুমায়ুন সারাবি (২০০৬) চারটি মতবাদ উপস্থাপন করেছেন। এগুলো হলো: মধ্য আফগানিস্তানের হাজারজাত এলাকার আদি অধিবাসী, জাতিগতভাবে মঙ্গোল অর্থাৎ মঙ্গোলদের বংশধর, মঙ্গোল-তুর্কি জাতিগোষ্ঠী এবং মিশ্র জাতি। তবে সর্বাধিক স্বীকৃত তত্ত্বটি হলো হাজারা সম্প্রদায় মিশ্র জাতি। এ তত্ত্বের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়, একসময় কিছু সংখ্যক মঙ্গোল উপজাতি পূর্ব পারস্য ভ্রমণ করেছিল এবং বর্তমান আফগানিস্তানে আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সেই দলটি তখন তাদের নিজস্ব সম্প্রদায় গঠন করে এবং পরবর্তী সময়ে হাজারা সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। হাজারা শব্দটি সম্ভবত ফার্সি শব্দ ‘হাজার’ [যার উত্পত্তি এক হাজার সৈন্যদল] থেকে উদ্ভূত।

যদিও অধিকাংশ হাজারা মধ্য আফগানিস্তানের হাজারাজাত এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল, কিন্তু মর্মান্তিক বিষয় হলো ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তাদের ওপর নির্মম নিপীড়ন শুরু হয়, যার জন্য তাদের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা নিহত হয় বা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়। যাহোক, এ কথা সত্যি যে, হাজারারা কেবল তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে আক্রান্ত হয় না, তা হলে অ-হাজারা শিয়াদের বিরুদ্ধেও নিয়মিত আক্রমণ করা হতো না। বরং বলা যায়, হাজারা জনগণ অনস্বীকার্যভাবে তাদের জাতিসত্তার কারণে আক্রান্ত হয়। তাদের ‘আসল’ বা ‘আদি’ আফগান হিসেবে গণ্য করা হয় না। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে হাজারা জনগণকে আফগান সরকার টার্গেট করেছে। কেননা সরকারের ধারণা, তারা দেশটির প্রভাবশালী শক্তিগুলোকে চ্যালেঞ্জ ও হুমকি দেয়ার ক্ষমতা রাখে। বলা হয়, মূলত এ কারণেই আফগান শাসকদের হাতে হাজারা জনগণকে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, স্থানচ্যুতি ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে।

হাজারা জনগোষ্ঠীর শিল্প-সংস্কৃতিসমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। বিশেষ করে তাদের বিভিন্ন আনন্দ উৎসব ও অনুষ্ঠান, সংগীত, পোশাক-পরিচ্ছদ, হস্তশিল্প নির্মাণ, খাদ্যাভ্যাস, বিনোদন এবং ভাষা ও সাহিত্য কৌতূহলোদ্দীপক।

শিল্প-সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য

হাজারা সংস্কৃতি বলতে শুধু হাজারা জনগণের সংস্কৃতিকেই বোঝায়। তাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এবং অনেক অনন্য রীতিনীতি ও ঐতিহ্যগত প্রথা রয়েছে, যার সঙ্গে পারস্য, মঙ্গোল এবং বিভিন্ন মধ্য এশিয়ার সংস্কৃতির মিল আছে। বর্তমানে হাজারাজাতের বাইরের হাজারারা তাদের বসবাসকারী শহরগুলোর সংস্কৃতি গ্রহণ করেছে। আফগানিস্তানে তাজিক ও পশতুনদের মতোই অনেক ক্ষেত্রে তারা পশতু ও পারস্য সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে।

আফগানি সংস্কৃতির মধ্যে হাজারারা তাদের সংগীত, কবিতা ও প্রবাদের জন্য বিখ্যাত। কবিতা ও সংগীত প্রধানত লোকগাথাভিত্তিক, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চালু রয়েছে। তাদের সামাজিক সমাবেশের মধ্যে রয়েছে সংগীত ও নাচ। তারা গান করার সময় গলায় বিশেষ ধরনের কণ্ঠস্বর তৈরি করে যেন শব্দ বিরতির সৃষ্টি হয়। নারী ও পুরুষরা আলাদাভাবে নৃত্য পরিবেশন করে। তাদের প্রত্যেকের বিভিন্ন ধরনের নৃত্যকলার কৌশল রয়েছে। অনেক সময় সেসব অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করা হয় এবং প্রেমের গল্প বলা হয়। কবিতা আবৃত্তি এবং গল্প বলার সময় দাম্বুরা (এক ধরনের দোতরা বাদ্যযন্ত্র) বাজানো হয়। এছাড়া হাজারাদের মধ্যে বিভিন্ন লোকগান রয়েছে, যেমন:

‘তারাগুলি উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে এবং আমি জেগে শুয়ে ছিলাম

আমি ছিলাম ভাঙা প্রাচীরের পিছনে

যেই না মোরগ ডাকা শুরু করে, তখনও

আমি আমার ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’

হাজারারা সাধারণ গ্রামীণ কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, যেমন অশুভ চোখ, ভূত এবং রাতের সঙ্গে জড়িত নানা ধরনের কুসংস্কার। তবে তারা গল্প বলা উপভোগ করে, বিশেষ করে তাদের ইতিহাস, পূর্বপুরুষ এবং নায়কদের গল্প।

হাজারা পুরুষরা খেলাধুলা খুবই পছন্দ করে। হাজারাদের অন্যতম প্রধান খেলা হলো ‘বুজকাশি’ (আফগানিস্তানের জাতীয় খেলা)। এটি এমন একটি খেলা, যেখানে ঘোড়ার পিঠে প্রায় এক হাজার লোক মৃত ছাগল বা বাছুর রাখার জন্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। এছাড়া অন্যান্য খেলাধুলার মধ্যে রয়েছে শিকার, কুস্তি, তীরন্দাজ ছোড়া ও ঘোড়দৌড়।

হাজারাদের বিবাহ অনুষ্ঠান ঐতিহ্যগত ইসলামী নিয়মনীতি অনুসরণ করে। বেশির ভাগ বিয়েশাদি তাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কিংবা হাজারা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। তবে চাচাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ পছন্দনীয়। যখন একটি মেয়ে প্রায় ১৫ বছর বয়সে পৌঁছায়, তখন সে সাধারণত তার পিতা-মাতার পছন্দের পুরুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। বর্ধিত পরিবারগুলো একই সঙ্গে এ বাড়িতে বসবাস করে। সেখানে দাদা-দাদি, বাবা-মা এবং সন্তানরা বাস করে। তবে দাদা-দাদির, বিশেষ করে দাদার মৃত্যুর পর, বাবা সাধারণত তার নিজস্ব পৃথক পরিবারে থাকতে শুরু করে।

বছরের দুটি ঈদ ছাড়াও হাজারাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসব চালু আছে। গত কুড়ি বছরের মধ্যে আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে কমপক্ষে চারটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন দাম্বুরা কালচারাল ফেস্টিভ্যাল, সিল্ক রোড ফেস্টিভ্যাল, পটেটো ফ্লাওয়ার ফেস্টিভ্যাল এবং নাইট উইথ বুদ্ধা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম দাম্বুরা কালচারাল ফেস্টিভ্যাল ২০১৭ সালের ৭-৯ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় কট্টরপন্থীরা এ অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান করে এবং তারা জনগণকে সেই অনুষ্ঠানে যাওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য উপস্থিত হয়েছিল হাজার হাজার দর্শক ও শ্রোতা। কেননা অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন বিখ্যাত হাজারা শিল্পী জাহরা এলহাম ও আব্দুল হামিদ সাখিজাদা। এছাড়া উৎসবের সময় বিখ্যাত সংগীতশিল্পী সফদর তাওয়াকলিকে ঐতিহ্যবাহী হাজারগি (অর্থাৎ হাজারাদের) সংগীতে অর্ধ শতাব্দীর নিরলস কাজের জন্য পুরস্কৃত করা হয়।

পোশাক-পরিচ্ছদের দিক থেকে হাজারারা অন্যদের থেকে আলাদা। তাদের পোশাকের মধ্য এক ধরনের সাংস্কৃতিক স্পর্শ ছাড়াও রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ। হাজারা পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ পোশাক হলো ‘পিরাহান-উ-তুনবান’ (পায়জামার মতো এক ধরনের পোশাক)। তারা সেই পোশাকের ওপর পাগড়ি, গেঞ্জি, ওভারকোট ও সোয়েটার পরিধান করে। তাদের মাথায় থাকে পশমের তৈরি গোলাকৃতি টুপি এবং তার উপর পাগড়ি। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে তারা সূচিকর্ম করা টুপি পরে। তাদের পোশাক পশম বা তুলা থেকে তৈরি করা হয়। সাধারণত পুরুষদের পোশাক সাদা বা হালকা ঘিয়ে রঙের হয়। শীতের সময় তাদের ঘাড়ের ওপর ঝুলে থাকে পশমের শাল।

অন্যদিকে হাজারা মহিলারা উজ্জ্বল রঙ ও নকশা করা পোশাক পরে। তাদের জন্য ঐতিহ্যবাহী পোশাক হলো ট্রাউজার, কোমরের দিকে খুব চওড়া লম্বা হাতার পোশাক এবং মাথা ঢাকার জন্য বড় রুমাল। অনেক সময় তারা ওয়েস্টকোট পরিধান করে, যা বোতাম, রঙিন পুঁতি, রুপার মুদ্রা ও শামুক দিয়ে সাজানো হয়। অতীতে অনেক হাজারা মহিলা তাদের মুখ একটি ‘রুবান্ড’ (মুখের ঘোমটা) দিয়ে ঢেকে রাখত। তারা সাধারণত হালকা ওজনের পোশাক পরে। কারণ তারা বেশি সময় বাড়ির ভেতরে থাকে। তবে বর্তমানে হাজারা নারীদের মধ্যে এক ধরনের প্রবণতা দেখা যায়, বিশেষ করে আনুষ্ঠানিক পোশাকের জন্য তাদের পছন্দের তালিকায় থাকে আকর্ষণীয় নকশা, উন্নতমানের ফ্যাব্রিক ও ঝলমলে রঙের বাহার। সব পোশাক ডিজাইনারকে সেই দিকে মনোযোগ দিতে হয়। বেশির ভাগ আনুষ্ঠানিক পোশাক নীল ও সবুজ রঙের হয়, কেননা রঙ দুটি একে অপরের সঙ্গে পুরোপুরি রোমান্টিক মনে হয়। তবে অনেকের পছন্দ লাল ও বেগুনি রঙের পোশাক। হাজারা মহিলারা আনুষ্ঠানিক পোশাকের সঙ্গে প্রাচীন গহনা ব্যবহার করে। কারুশিল্প এবং শখের মধ্যে হাজারারা বিভিন্ন ধরনের কোট, ওভারকোট, সোয়েটার, জ্যাকেট, জুতা, টুপি, গ্লাভস ও স্কার্ফ তৈরি করে। এসব কারুপণ্যের বেশির ভাগই মহিলারা তৈরি করে।

 

ভাষা ও সাহিত্য

হাজারাদের মাতৃভাষা ‘হাজারাগি’, যা আফগানিস্তানের কথ্য দারি ভাষা। দারি হলো ফার্সির একটি প্রকারভেদ এবং যাকে খোরাসানি ফার্সিও বলা হয়। তবে এ হাজারাগি ভাষার ইতিহাস নিয়ে মতবিরোধ আছে। যদিও অনেকে মনে করেন, হাজারা সম্প্রদায় মূলত মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত সম্রাট বাবরের সময়ে মঙ্গোলিয়ান ভাষায় কথা বলত। অন্যদিকে অনেকে বিশ্বাস করেন, শুরু থেকেই হাজারাদের মূল ভাষা ছিল দারি। একজন উল্লেখ করেছেন যে, মধ্যযুগে হাজারাদের ভাষা ছিল ফার্সি ও হিন্দির মিশ্রণ। যাহোক, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে হাজারাজাতের জনগণের মধ্যে পারস্যের একটি স্বতন্ত্র উপভাষা উদ্ভূত হতে শুরু করে। হাজারা সম্প্রদায়ের লোকজন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত মঙ্গোলিয়ান ভাষায় কথা বলতেন।

বর্তমানে অধিকাংশ হাজারা দারি ভাষায় কথা বলে। বলা হয়, আনুমানিক ২২ লাখ হাজারা এ ভাষায় কথা বলে। তার মধ্যে ১৮ লাখ আফগানিস্তানে এবং বাকিরা পাকিস্তান ও ইরানে। কিছু ভাষাবিদ বিশ্বাস করেন, হাজারগি ভাষাভাষীরা ফার্সি গ্রহণ করায় এ সংখ্যা ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। তবে ফার্সি ছাড়াও কিছু সংখ্যক হাজারা পশতু, বালুচি ও তুর্কি ভাষায় কথা বলে। উল্লেখ্য, কিছু সংখ্যক হাজারা হাজারাগিকে ভাষা হিসেবে স্বীকার করে এবং অন্যদিকে কেউ কেউ এটিকে ভাষার পরিবর্তে উপভাষা বলে অভিহিত করে।

হাজারা সাহিত্যের পরিধি খুবই সীমিত। কেননা অনেক কবি ও কথাসাহিত্যিক মাতৃভূমি ছেড়ে বিভিন্ন দেশে অভিবাসন গ্রহণ করেছেন। তারা অভিবাসী দেশের ভাষায় কিংবা ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চা করেন। হাজারা বংশোদ্ভূত সমকালীন কবিদের মধ্যে নরওয়েজিয়ান কবি, সাংবাদিক এবং মানবতাবাদী কর্মী কামরান মীর হাজার (জন্ম ১৯৭৬) আন্তর্জাতিক সাহিত্য মহলে সুনাম অর্জন করেছেন। তিনি কাবুল প্রেস এবং রিফিউজি ফেসের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সম্পাদক। তিনি একাধিক কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। তার সম্পাদনায় ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘Poems for the Hazara: A Multilingual Poetry Anthology and Collaborative Poem’ কাব্য সংকলন। এ সংকলনে ১২৫টি দেশের ১৬৮টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং সব কবিতাই ছিল হাজারাদের দুর্দশা নিয়ে রচিত। কেননা তাদের প্রগতিশীল ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে তারা বারবার গণহত্যা, দাসত্ব এবং জোরপূর্বক স্থানচ্যুতির শিকার হয়েছে।

হাজারা বংশোদ্ভূত অভিবাসী কবিদের মধ্যে যারা সুনাম কুড়িয়েছেন, তারা হলেন আলী বাবা তাজ (জন্ম ১৯৭৭), মহসীন চাঙ্গেজি (জন্ম ১৯৭৯) এবং বসির আহাং (১৯৮৪)। পাকিস্তানের অভিবাসী উর্দু কবি আলী বাবা তাজ কবিতায় নাজম শৈলী ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত পরিচিত। সাংবাদিক ও ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মাতা শারমীন ওবায়িদ চিনোর সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, ‘কবিতা হলো জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার, যা জীবন আমাকে দিয়েছে। কবিতা আমাকে সব সময় কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে এবং এটি আমার জন্য এক ধরনের সমর্থন। আমার জন্য কবিতা যদি না থাকত, তাহলে আমি হারিয়ে যেতাম। আমি কবিতার মাধ্যমে ভয়, উদ্বেগ, আশা, সুখ এবং দুঃখ প্রকাশ করি। কবিতাই আমার আশ্রয়।’ অন্যদিকে কবি, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী বসির আহাং বর্তমানে ইতালিতে থাকেন। এছাড়া ফার্সি ভাষায় কবিতা রচনা করেন হাজারা কবি সৈয়দ আবুতালিব মোজাফ্ফরি (জন্ম ১৯৬৬)।

সমকালীন হাজারা কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে জাবেদ খাভারি (জন্ম ১৯৬৭) এবং মোহাম্মদ হুসেইন মোহাম্মদী (জন্ম ১৯৭৬) আন্তর্জাতিক সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেছেন। বর্তমানে তারা ইরানের অভিবাসী। জাবেদ খাভারি তার লেখায় হাজারাদের জীবনের বিভিন্ন নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরেছেন। এরই মধ্যে তার একাধিক গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০০৪ সালে ‘কালচারাল প্রাইজ অব আফগানিস্তান’ লাভ করেন।

 

মোহাম্মদ হুসেইন মোহাম্মদী ১৯৯৭ সাল থেকে ছোটগল্প এবং সাহিত্য সমালোচনা লেখার মাধ্যমে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। তিনি একাধিক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এগুলোর মধ্যে ইরানের সম্মানিত ‘গলশিরি অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘ইস্পাহান লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড’ উল্লেখযোগ্য। তার গল্পের মূল বিষয় আফগানিস্তানের যুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা, হত্যা, অত্যাচার, সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা এবং তালেবানদের আত্মঘাতী বোমা হামলার নিষ্ঠুর কাহিনী। ‘দাশৎ-ই লাইলি’ তার বিখ্যাত গল্প। গল্পটির মূল বিষয় দাশৎ-ই লাইলির মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ, যা শুধু আফগানিস্তানের নয়, বরং বিশ্ব ইতিহাসের এক অমানবিক, নৃশংস হত্যাকাণ্ড। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০১ সালের ডিসেম্বরে, যা পশ্চিমা মিডিয়ায় তেমন করে প্রকাশ পায়নি। মাজার-ই-শরিফের কালা-ই জঙ্গি দুর্গের কাছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একপর্যায়ে তালেবান সেনারা সাদা পতাকা উড়িয়ে ন্যাটো এবং আমেরিকার দোসর ও কমান্ডার দুর্ধর্ষ আফগান জেনারেল আবদুর রশিদ দুস্তমের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের প্রধান শর্ত ছিল, আটককৃত তালেবানদের কোনো মতেই শারীরিকভাবে কোনো ক্ষতি করা যাবে না। আটককৃত আনুমানিক সাড়ে সাত হাজার তালেবানকে লোহার বন্ধ কনটেইনারের ট্রাকে করে কুন্দুজ থেকে শেবিরগানের সন্নিকটে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন কনটেইনারের ভেতর গাদাগাদির জন্য শ্বাসরুদ্ধ হয়ে, অনাহারে এবং তৃষ্ণায় অনেক তালেবান মারা যায়। ভাগ্যক্রমে যারা বেঁচেছিল, নর্দান অ্যালায়েন্সের অঙ্গ সংগঠন জানবিশ-ই মিলি দলের উগ্র সেনারা তাদের গুলি করে হত্যা করে। পরে দাশৎ-ই লাইলির মরুভূমিতে মৃত তালেবানদের গণকবর করে মাটি চাপা দেয়া হয়। উল্লেখ্য, এরই মধ্যে গল্পটি বাংলায়ন করেছেন এ নিবন্ধের লেখক এবং ‘আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সায়েদ আসকার মুসা (জন্ম ১৯৫৬) একজন লেখক ও ঔপন্যাসিক। ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘The Hazaras of Afghanistan’ গ্রন্থের রচয়িতা। এছাড়া তিনি অন্যান্য গ্রন্থ, যেমন ‘Saaf’ এবং ‘Jawali’ রচনা ও সম্পাদনা করেন।

কবি ও সাহিত্যিকদের মতো শিল্পকলার অন্যান্য শাখায় হাজারাদের উপস্থিতি দেখা যায়। বশির বখতিয়ারী ছিলেন বিখ্যাত হাজারা কার্টুন শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংবাদিক। বাচ্চে আজরা ছিল তার ছদ্মনাম। তিনি আফগানিস্তানের রাজনীতিবিদ এবং সরকারের সমালোচনা করে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’তে সংবাদ পরিবেশন করেন। তিনি বিবিসিসহ সংবাদ সংস্থার জন্য তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেন, যা আফগানিস্তানে যুদ্ধ ও সংঘর্ষের ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল। যদিও তিনি মাতৃভূমি ছাড়তে চাননি, কিন্তু ২০০৮ সালে পরিস্থিতির চাপে শরণার্থী হিসেবে তাকে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী হতে হয়।

শেষ কথা

হাজারা গোষ্ঠীর রয়েছে দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তবে এ কথা সত্যি, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যের জন্য তারা আফগানিস্তান সরকারের উদাসীনতার শিকার। এছাড়া রয়েছে কট্টরপন্থীদের হাতে নিগ্রহ ও গণহত্যা। হাজারা সমাজবিজ্ঞানী নোশিন রাড ব্রিটেনের ‘মর্নিং স্টার’-এ সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে হাজারা জনগণের দুর্দশার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। উল্লেখ্য, হাজারাদের নিয়ে লেখা খালেদ হোসেইনির বিখ্যাত ‘দ্য কাইট রানার’ (২০০৩ সালে প্রকাশিত) উপন্যাস এবং পরবর্তী সময়ে একই শিরোনামের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পশ্চিমা জগতে হাজারা সম্প্রদায় পরিচিতি পেয়েছে।

তথ্যসূত্র

Humayun Sarabi (2006), Politics and Modern History of Hazara: Sectarian Politics in Afghanistan, Master of Arts in Law and Diplomacy Thesis, Tufts University, Medford, Massachusetts, USA.

Sharmeen Obaid Chino (2015), Living in the shadows: A Hazara man finds solace in poetry, The Dawn, Sunday Magazine, August 2, 2015.

Kamran Mir Hazar (2014), Poems for the Hazara: A Multilingual Poetry Anthology and Collaborative Poem, (Executive editor: Kamran Mir Hazar), Full Page Publishing, New York.

Hazara International (2010), Two Hazara story writers in International literature Festival Berlin.

Noshin Rad (2020), The Hazaras – Afghanistan’s oppressed minority, Morning Star (morningstaronline.co.uk).

আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প, ভূমিকা ও অনুবাদ: ফজল হাসান ইত্যাদি গ্রন্থ, প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩।


শর্টলিংকঃ