হুন্ডিতে আসছে পাকিস্তানি থ্রিপিস : ম্যানেজে চলছে কার্যক্রম


ইউএনভি ডেস্ক:

পাকিস্তানি থ্রিপিসে (লন) সয়লাব দেশের বাজার। এগুলোর বেশিরভাগই আসছে হুন্ডিতে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের বড় একটি অংশ এ কারবারে জড়িত। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি শপিং মলে এ চক্রের শোরুম রয়েছে।


দেশে ব্যবসা করলেও আয়কর, ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে সেই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাকিস্তানে পাচার করা হচ্ছে। কাস্টমস, সিএন্ডএফ এজেন্ট, স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, মার্কেট কমিটির নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করেই চলছে এসব কার্যক্রম।

শুধু তাই নয়, শুল্ক ফাঁকি দিতে কাস্টমসে থ্রিপিসকে কাপড়ের রোল হিসেবে মিথ্যা ঘোষণা দেয়া হয়। এতে মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ চক্রের দৌরাত্ম্যে অসহায় স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্প।

ফলে এ খাতে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।  অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শান্তিনগরের ইস্টার্ন প্লাস, এলিফ্যান্ট রোডের সুবাস্তু অ্যারোমা, ইস্টার্ন মল্লিকা, ধানমণ্ডির প্রিন্স প্লাজা ও গুলশানের পিংক সিটি পাকিস্তানি থ্রি-পিসের সবচেয়ে বড় বাজার।

এসব মার্কেটের কিছু ব্যবসায়ী নিজেরা সরাসরি পাকিস্তান থেকে থ্রিপিস আমদানি করেন। কিন্তু বেশিরভাগই হুন্ডিতে থ্রিপিস আনেন। এক্ষেত্রেও মিথ্যা ঘোষণায় অভিনব কায়দায় কাস্টমসে শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়। থ্রিপিসকে ঘোষণা দেয়া হয় কাপড়ের রোল হিসেবে। ফলে সরকার শুল্ক বাবদ মোটা অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসা করলেও নিয়মমাফিক ভ্যাট দেন না তারা।

সবই চলে সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে। বৈধ আমদানিকারকরা বলছেন, পাকিস্তান থেকে থ্রিপিস আমদানির তথ্য এবং রাজধানীর বড় বড় কয়েকটি শপিং মলের বেচাবিক্রির তথ্য পর্যালোচনা করলেই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। ২০১৪ সালে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর গুলশানে অভিযান চালিয়ে চোরাকারবারে জড়িত পাকিস্তানি ব্যবসায়ী আবদুল হালিম পুরীকে আটক করে।

অভিযানে ৫ কোটি টাকা মূল্যের শাড়ি-থ্রিপিস আটক করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে অতি উন্নতমানের ৩ হাজার ৭৪টি থ্রিপিস সেট (আনস্টিচড), ১৩৭টি থ্রিপিস সেট (স্টিচড) ও ৭১টি সিনথেটিক শাড়ি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বৈধপথে পাকিস্তান থেকে মাত্র ১৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার মহিলাদের থ্রিপিস, জ্যাকেট, ব্লাউজ, শার্ট, ওয়ান পিস, স্কার্ফ, মাফলার আমদানি হয়েছে।

অথচ সরেজমিন শুধু ইস্টার্ন প্লাস মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, তৃতীয় তলার প্রতিটি দোকানেই কোটি টাকার থ্রিপিস র‌্যাকে র‌্যাকে সাজানো। এসব দোকানের আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে গোডাউন রয়েছে। একই অবস্থা এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা, ধানমণ্ডির প্রিন্স প্লাজা ও গুলশানের পিংক সিটির।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, এয়ারপোর্ট দিয়ে কীভাবে ব্যাগেজ রুলের আওতায় এত বিপুল পরিমাণ লন থ্রিপিস ঢুকছে তা বোধগম্য নয়।

পাকিস্তানিরা গুলশান, বনানী, বারিধারায় গেস্টহাউসে অবস্থান করে মহিলাদের পরিচালিত বুটিক হাউস ও বড় বড় শোরুমে থ্রিপিস বিক্রি করছেন।এ টাকা আবার পাকিস্তানেই নিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে টাকা নিয়ে গেলেও কোনো সংস্থার তৎপরতা চোখে পড়েনি।

তিনি আরও বলেন, আরেকটি চক্র আছে, যারা হুন্ডির মাধ্যমে থ্রিপিস আমদানি করছে। এর বড় প্রমাণ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কাস্টমসের পাকিস্তান থেকে থ্রিপিস আমদানির তথ্য এবং শপিং মলগুলোতে থ্রিপিসের স্তূপের চিত্র।

এ দুটো মিলিয়ে দেখলেই পুরো বিষয়ট স্পষ্ট হয়ে যাবে। এ কারণে দেশীয় শিল্প ব্যবসা হারাচ্ছে। উদ্যোক্তারা ঋণখেলাপি হচ্ছেন। নতুন কোনো বিনিয়োগ আসছে না। সর্বোপরি দেশের ক্ষতি হচ্ছে।

সরকারের উচিত এ দিকে বিশেষ নজর দেয়া। কারণ প্রতি বছর মোটা অঙ্কের অর্থ পাকিস্তানে পাচার হয়ে যাচ্ছে শুধু থ্রিপিস আমদানিতে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাকিস্তানি লনের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে দেশে বসবাসরত পাকিস্তানিরাই। এরা ট্যুরিস্ট ভিসায় প্রবেশ করে দীর্ঘদিন বসবাসের সুবাধে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্ট নিয়েছেন।

অভিজাত মার্কেট ও বাণিজ্য মেলায় স্টল নিয়ে ব্যবসাও করেন তারা। অথচ ব্যবসার সপক্ষে ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, আয়কর সনদপত্র নেই অনেকের।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজধানীর ইস্টার্ন প্লাস, খদ্দরবাজার, নবাবপুর রোড, চাঁদনী চক মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোডের সুবাস্তু অ্যারোমা ও বলাকা সুপার মার্কেটসহ বিভিন্ন অভিজাত বিপণিবিতানে ২ শতাধিক পাকিস্তানি নাগরিক অবৈধভাবে ব্যবসা করছেন।

কেউ কেউ দীর্ঘদিন বাংলাদেশে থাকার সুবাদে জাতীয় পরিচয়পত্র ও বাংলাদেশের পাসপোর্ট করে নিয়েছেন। অভিনব কায়দায় শুল্ক ফাঁকি : আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি রোধে এনবিআর থ্রিপিসের ন্যূনতম দর নির্ধারণ করে দিয়েছে।

সাধারণ মানের একটি থ্রিপিসের ন্যূনতম শুল্ক মূল্য ৪ ডলার, মধ্যম মানের ৫ ডলার, সুপার কোয়ালিটি ৮ ডলার এবং প্রিমিয়াম কোয়ালিটির দাম ১২ ডলার নির্ধারণ করা আছে।

এ দামের ওপর কাস্টমসকে ১২৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। অর্থাৎ সাধারণ মানের একটি থ্রিপিসে ৫ ডলারের বেশি শুল্ক দিতে হয়। এ শুল্ক ফাঁকি দিতে কাস্টমসে থ্রিপিসকে কাপড়ের রোল হিসেবে মিথ্যা ঘোষণা দেয়া হয়।

কাপড়ের রোলের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি কাপড়ের ন্যূনতম মূল্য ৩ ডলার নির্ধারণ করা আছে। আবার শুল্কও কম। কাপড়ের রোলে ৮৯ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা আছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা কাস্টমস হাউস দিয়ে বেশিরভাগ থ্রিপিস আসে। পাকিস্তান থেকে আমদানির সময় থ্রিপিস আলাদা প্যাকেটে না এনে একটি থ্রিপিসের ওপর আরেকটা পেঁচিয়ে রোল বানায়।

পরে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এগুলোকে কাপড়ের রোল হিসেবে শুল্কায়ন করা হয়। এতে সুবিধা হল যে, এক কেজি কাপড়ের শুল্ক দিয়ে অনায়াসে ৩-৪টি থ্রি-পিস আনা যায়।

হিসাব মতে, যেখানে একটি থ্রিপিসে শুল্ক দেয়ার কথা ৫ ডলারের বেশি। সেখানে কেজির হিসাবে রোল আকারে ৩-৪টি থ্রিপিস আনলে শুল্ক দিতে হয় আড়াই ডলারের সামান্য বেশি।

অর্থাৎ একটি থ্রিপিসের শুল্ক আসে ৯০ সেন্ট থেকে সর্বোচ্চ ১ ডলার। তার ওপর ওজনে কারচুপিতো আছেই। এই কায়দায় শুধু পাকিস্তান থেকে আসা মহিলাদের থ্রিপিসে সরকার বছরে কয়েকশ’ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে ৩ হাজার ৫০ কোটি টাকার ওভেন ফেব্রিক্স আমদানি হয়েছে। আগের অর্থবছরে এসেছিল ২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকার ওভেন কাপড়। অবশ্য দোকানদাররা বলছেন, পাকিস্তান থেকে মহিলাদের থ্রিপিসই আসে বেশি। পুরুষের শার্টিং-সুটিংয়ের কাপড় আসে ভারত থেকে।


শর্টলিংকঃ