একজন গুপ্তচর কেন গুপ্তচর


গুপ্তচরবৃত্তি, স্পাইয়িং বা এসপিওনাজ দুনিয়ার প্রাচীন পেশাগুলোর মধ্যে অন্যতম। গুপ্তচরবৃত্তিকে বলা হয়, ‘সেকেন্ড ওল্ডেস্ট প্রফেশন’। কিন্তু মানুষ কেন গুপ্তচরবৃত্তিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে, অর্থাৎ কেন তারা গুপ্তচরবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নেয় এবং তাদের মনোজগৎ বা মানসিকতা কেমন হয়? এ কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্নটির জবাব খোঁজা হবে এ লেখায়।

গুপ্তচরবৃত্তি হচ্ছে সেই কাজ, যার মাধ্যমে একজন মানুষ গোপনে অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য দেশের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। পরে সংগৃহীত গোপন তথ্য ধারকের অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করে কিংবা প্রতিপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। গুপ্তচরবৃত্তির প্রধান উদ্দেশ্য হলো অন্যের বা প্রতিপক্ষের গোপন তথ্য সংগ্রহ করা। মুখোশের অন্তরালে যে ব্যক্তি গুপ্তচরবৃত্তি করে তাকে গুপ্তচর অথবা গোয়েন্দা বলা হয়।

গুপ্তচরবৃত্তির ইংরেজি এসপিওনাজ শব্দটির উদ্ভাবন নিয়ে অনেক মতবাদ রয়েছে। অনেকের মতে ‘এসপিওনাজ’ শব্দটির উত্পত্তি হয়েছে ফরাসি শব্দ ‘espionner’ এবং পুরনো ইতালীয় শব্দ ‘spione’ থেকে। অন্যদিকে অনেকে মনে করেন যে ‘এসপিওনাজ’ শব্দটির উত্পত্তি বিভিন্ন পুরনো শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘দেখতে বা দেখা’, যেমন লাতিন ‘specere’ অথবা অ্যাংলো-নরম্যান ‘espier’।

গুপ্তচরবৃত্তি অর্থাৎ স্পাইয়িং বা এসপিওনাজ প্রাচীনতম পেশার একটি। পেশা হিসেবে গুপ্তচরবৃত্তি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এবং বিপজ্জনকও। একই সঙ্গে রোমাঞ্চকরও বটে। অনেক সময় দেখা যায় গুপ্তচররা ধরা পড়ার পর কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হন এবং সেই শাস্তি চাকরিচ্যুত হওয়া থেকে শুরু করে কারাবাস, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। এসব ঝুঁকি থাকার পরও অনেকে এ পেশায় এক বা একাধিক কারণে জড়িয়ে পড়েন, স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় অর্থাৎ কোনো কোনো সময় জটিল পরিস্থিতির শিকার হয়ে। তাই গুপ্তচর হওয়ার আড়ালে উদ্দেশ্যের তারতম্য হতে পারে, তবে মার্কিন রিস্ক কনসালটিং ফার্ম Discernum (২০১৭) উল্লেখ করেছে যে মোটামুটিভাবে গুপ্তচর হওয়ার কারণ চারটি নির্দিষ্ট শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়, যেমন অর্থকড়ি (Money), মতাদর্শ (Ideology), সমঝোতা (Coercion) এবং অহংকার (Ego), সংক্ষেপে MICE । মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই গুপ্তচর এজেন্টদের জন্য এ সংক্ষিপ্ত নাম ব্যবহার করে। Grabianowski (২০০৭) প্রায় একই ধরনের চারটি কারণ উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো নিজ দেশের (মাতৃভূমির) সঙ্গে মতানৈক্য, অর্থকড়ি, ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হওয়ার ইচ্ছা এবং ব্ল্যাকমেইল।

অন্যদিকে মাইকেল স্মিথ (২০১৯) সম্প্রতি প্রকাশিত তার গ্রন্থে (দি অ্যানাটমি অব আ স্পাই) সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তার মতে কারণগুলো হলো (১) সেক্সুয়াল রিলেশনশিপ (যৌন সম্পর্ক), (২) মানি (অর্থকড়ি), (৩) প্যাট্রিয়টিজম (দেশপ্রেম), (৪) অ্যাডভেঞ্চারার্স, ফ্যান্টাসিস্টস ও সাইকোপ্যাথস (দুঃসাহসিক মানসিকতা, স্বপ্নবিলাসী ও মনোবিকারগ্রস্ত), (৫) রিভেঞ্জ (প্রতিশোধ), (৬) দ্য রাইট থিংক টু ডু (সঠিক কাজ) এবং (৭) আনকনশাস এজেন্টস (অবচেতন প্রতিনিধি)। উপরোল্লেখিত কারণগুলোর মধ্যে প্রধান চারটি কারণ সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া কয়েক জন গুপ্তচরের কর্মকাণ্ড ও পরিণতি আলোকপাত করা হয়েছে (বলাবাহুল্য, মাইকেল স্মিথের গ্রন্থে বিস্তারিত আছে)।

মানি (অর্থকড়ি)

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, অর্থের বিনিময়ে একজন পুরুষ বা মহিলা গুপ্তচর ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করে। অনেক গুপ্তচর আছে, যারা শুধু অর্থকড়ির বিনিময়ে একজন বা এক দেশের গোপন তথ্য অন্যের কাছে পাচার করে। তারা মহামূল্যবান তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ক্রেতা বা ক্লাইন্ট খোঁজে এবং আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাব নিয়ে তাদের কাছে যায়। সে লেনদেন হয়তো এককালীন হতে পারে কিংবা বছরের পর বছর, এমনকি দশকের পর দশক ধরেও চলতে পারে। তবে দেখা গেছে যারা টাকার জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করে, তারা প্রায়ই ধরা পড়ে, এমনকি তাদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলে অনায়াসে তাদের সঙ্গে লেনদেন বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলা যেতে পারে। তবে অন্য কারণে যারা গুপ্তচরগিরি পেশা হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের চাকরিচ্যুত করা খুব সহজ নয়। তাই এ কারণে অনেক গুপ্তচর আছে, যাদের অন্য কারো প্রতি কোনো আনুগত্য নেই। যার গোপন তথ্য প্রয়োজন হবে এবং অর্থকড়ি দেবে, গুপ্তচর তার কাছেই তথ্য সরবরাহ বা বিক্রি করবে। অনেক সময় দেখা গেছে, গুপ্তচররা সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে গোপন তথ্য বিক্রি করেছে, এমনকি অর্থের বিনিময়ে একই তথ্য একাধিক গ্রাহকের হাতে তুলে দিয়েছে। এ রকম একজন গুপ্তচর ছিলেন Arsene Marie Verrue নামে (তিনি Frederic Rue নামেও পরিচিত ছিলেন), তিনি একজন বেলজিয়ান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশ ওয়ার অফিসের পক্ষে গুপ্তচর ছিলেন এবং একই সঙ্গে তিনি বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্রিউয়ারি কোম্পানির ইউরোপিয়ান প্রতিনিধি ছিলেন। দ্বিতীয় কাজের জন্য তাকে অনেক সময় জার্মানিতে থাকতে হয়েছিল। সে সময় তিনি জার্মানির যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে অনেক গোপন তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি ছিলেন একজন ক্রিমিনাল এবং জালিয়াতির কারণে কয়েকবার জেলও খেটেছেন। একসময় তিনি চাকরিচ্যুত হন এবং নিজে ফ্রিল্যান্স গুপ্তচর হিসেবে এজেন্সি খোলেন। সেই এজেন্সির মাধ্যমে তিনি বেশি অর্থদাতার কাছে গোপন তথ্য বিক্রি করেন।

১৯৩১ সালে Hans-Thilo Schmidt নামে একজন জার্মান সরকারি কর্মচারী একটি অপ্রতিরোধ্য প্রস্তাব নিয়ে বার্লিনের ফরাসি দূতাবাসে যান। তার কর্মক্ষেত্র ছিল জার্মান যুদ্ধ অফিসের সাইফার বিভাগ। তাই তিনি প্রস্তাব করেন যে তার কাছে গোপন তথ্য রয়েছে, যা দিয়ে ফরাসিরা জার্মান সামরিক বাহিনীর অত্যাধুনিক সামরিক কোড ভাঙার ক্ষমতা লাভ করতে পারবে। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াই ছিল Schmidt-এর উদ্দেশ্য। এছাড়া নারীদের প্রতি আসক্তিও ছিল আরেক কারণ। পরবর্তী সময় Schmidt Bertrand (ফরাসি সংস্থা Deuxieme Bureau-এর কোড-ভাঙার কাজের অফিসার-ইন-চার্জ), মন্তব্য করেছেন, (Schmidt) ‘was fond of money’, which he needed ‘because he was even fonder of women’। যাহোক, তিনি দীর্ঘ সময় ফরাসিদের পক্ষে এবং জার্মানদের বিপক্ষে নানা ধরনের গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করেন, এমনকি ধারণা করা হয় সেই সময় রাশিয়ার পক্ষেও তিনি গুপ্তচর ছিলেন। অবশেষে ১৯৪৩ সালে তিনি জার্মানির গেস্টাপোদের হাতে গ্রেফতার হন এবং ফাঁসি এড়ানোর জন্য আত্মহননের পথ বেছে নেন।

এছাড়া স্রেফ অর্থের জন্য ‘ওয়াক-ইন’ গুপ্তচর হওয়া প্রসঙ্গে সিআইএর কর্মকর্তা অল্ড্রিচ অ্যামেসের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। তিনি ১৯৮০-এর দশকে একাধিক কারণে সোভিয়েতে সরকারের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করেন। তখন তিনি প্রচুর ঋণের মধ্যে ডুবে ছিলেন এবং তার প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। তিনি সিআইএতে কর্মরত সোভিয়েতে নাগরিকদের নাম প্রকাশ করার পরিকল্পনা নিয়ে নিউইয়র্ক সিটির সোভিয়েত দূতাবাসে যান। জানা গেছে, তিনি ৫০ হাজার মার্কিন ডলার দাবি করেন। পরবর্তী সময় তিনি বেশ কয়েক বছর টাকার জন্য গুপ্তচরবৃত্তির মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ চালিয়ে যান। তার গুপ্তচরবৃত্তির জন্য সোভিয়েত সরকার অন্তত তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। তবে নয় বছর কেজিবি এবং মিনিস্ট্রি অব রাশিয়ান ফেডারেশনের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করার দায়ে তিনি ১৯৯৪ সালে ধরা পড়েন। সিআইএর হয়ে কাজ করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে অ্যামেসকে সবচেয়ে ক্ষতিকর গুপ্তচর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

দেশপ্রেম

প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক E.M. Forster বলেছেন, ‘If I had to choose between betraying my country and betraying my friend, I hope I should have the guts to betray my country’ । তার এ উক্তি দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার পক্ষে অন্যতম যুক্তি হিসেবে অহরহ ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে যা এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের এজেন্সি কেজিবির কুখ্যাত কেমব্রিজ গুপ্তচরদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা স্নায়ুযুদ্ধের (কোল্ডওয়ার) সময় কেজিবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনে গুপ্তচর এজেন্ট নিয়োগে সাফল্যতা অর্জন করেছিল। সেসব গুপ্তচর এজেন্টরা কমিউনিজম বা কমিউনিস্ট সংগঠনের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে, ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার দৃষ্টি পূর্ব দিকে সরিয়ে নিয়েছিল। বলশেভিক বিপ্লব (১৯১৭) এবং পরবর্তী সময় ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের অবনতির জন্য ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস গুপ্তচরের জন্য বেশ কয়েকজনকে নতুন নিয়োগ প্রদান করে। তারা ছিল দেশপ্রেমিক রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয়, যারা নতুন শাসনের বিরোধিতা করেছিল। তাদের মধ্যে ইউক্রেনীয় দেশপ্রমিক, কিন্তু বলশেভিক বিপ্লবের বিরোধী, Boris Bazhanov সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সম্পাদক হয়েছিলেন। তখন তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ গুপ্তচর।

তবে ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশদের নিয়োজিত দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীদের গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করার বিব্রতকর কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয়। তখন প্যারিসে অবস্থিত ব্রিটিশ বার্নডিপ্ট ওয়্যারলেস কোম্পানির প্রতিনিধি John Leather এবং তার দুই সহযোগী তরুণীকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ফরাসি পুলিশ গ্রেফতার করে। সেই দুই তরুণীর দায়িত্ব ছিল ফরাসি কর্মকর্তাদের প্রলুব্ধ করা এবং ফরাসি সামরিক বিমান ঘাঁটিতে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা। যাহোক, বিশ্বাস, দেশপ্রেমকে হত্যা করে কুখ্যাত গুপ্তচর হিসেবে ইতিহাসের খাতায় নাম লেখানোর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এদের মধ্যে জার্মান গুপ্তচর জন ড্যাশ, মার্কিন গুপ্তচর বেনেডিক্ট আর্নল্ড ও ইউক্রেনের গুপ্তচর আলফ্রেড রেড উল্লেখযোগ্য।

দুঃসাহসিক মানসিকতা, স্বপ্নবিলাসী ও মনোবিকারগ্রস্ত

সাধারণত দুঃসাহসিক কাজে আগ্রহী, ঝুঁকি গ্রহণকারী, ফ্যান্টাসিস্ট এবং অহংকারীদের মধ্যে গুপ্তচর হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। গুপ্তচর নিয়োগকারীরা গৃহকর্মীদের মতো এমন সাধারণ লোকজন খোঁজে, যাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভাণ্ডারে প্রবেশাধিকার আছে এবং যারা সহজেই সুযোগ লুফে নিতে পারে। কেননা কিছু মনস্তাত্ত্বিক উপাদান, যেমন দুঃসাহসিক মানসিকতা, স্বপ্নবিলাসী ও মনোবিকারগ্রস্থতা কিছু মানুষকে গুপ্তচর হতে বাধ্য করে। তার জন্য তারা মানসিকভাবে নিজেদের শক্তিশালী অনুভব করে। তবে অধিকাংশ নিয়োগকারীরা তাদের সরাসরি কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয় না। তারা মনে করে যে সেসব নিয়োগপ্রাপ্তদের ব্যক্তিত্বে ত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে গুপ্তচর এজেন্ট হিসেবে অনেকেই সফলতা অর্জন করেছে।

আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত ঝুঁকি গ্রহণ করা দুঃসাহসিক গুপ্তচর Sidney Reilly, যাকে ‘Ace of Spies’ বা ‘গুপ্তচরদের শিরোমণি বা গুরু’ নামে অভিহিত করা হয়। তিনি ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের সময় রাশিয়ায় ব্রিটিশ সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের প্রধান ম্যান্সফিল্ড কামিংয়ের জন্য কাজ করেন। আসলে তিনি একজন রাশিয়ান এবং ওডেসার এক ইহুদি পরিবারে তার জন্ম। তার আসল নাম Sigmund Georgievich Rosenblum। তিনি ২০ বছর বয়সে ব্রিটেনে গমন করেন এবং সেখানে ব্রিটিশ নারী বিয়ে করে ব্রিটিশ পাসপোর্ট গ্রহণ করে নাম পরিবর্তন করেন। তিনি ব্যবসায়িক কার্যকলাপের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকারের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি কার্যক্রম চালিয়ে যান। বলা হয়, তিনি একাধারে জাপান, রাশিয়া, জার্মান ও ব্রিটিশদের জন্য গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন।

এ কথা সত্যি, যেকোনো গোয়েন্দা সংস্থার জন্য ফ্যান্টাসিস্ট গুপ্তচর সম্ভাব্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জার্মান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (যার নাম ছিল Abwehr) ব্রিটেনের অভ্যন্তরে এজেন্ট নিয়োগ করতে মরিয়া ছিল এবং বিশেষ করে যা ফ্যান্টাসিস্টদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তার পরও ফ্যান্টাসিস্টদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গুপ্তচর ছিলেন Juan Pijol Garcia, যিনি ব্রিটিশ কোডনাম ‘গার্বো’ হিসেবে ইতিহাসে অধিক পরিচিত।

প্রতিশোধ

বলা হয়, প্রতিশোধ হচ্ছে একজন গুপ্তচরের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ও স্থায়ী উদ্দেশ্য। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যারা গুপ্তচরবৃত্তির বলয়ে প্রবেশ করেছেন, তাদের মধ্য একজন হলেন ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস নিয়োজিত জার্মান সামুদ্রিক প্রকৌশলী Karl Kruger। তিনি জার্মান উত্তর সাগর এবং বাল্টিক ডক ইয়ার্ড চালানোর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ১৯১৪ সালের নভেম্বরে হেগ শহরে ব্রিটিশ প্রতিনিধির কাছে জার্মানির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির প্রস্তাব দেন। কেননা যুদ্ধের জন্য জার্মান নৌবাহিনীর প্রস্তুতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করার মতো গোপন তথ্য তার কাছে ছিল।

এছাড়া প্রতিশোধ ছিল আরেকজন জার্মান গুপ্তচরের প্রেরণায়। তিনি সম্ভবত ১৯৩০-এর দশকে জার্মান সংস্থা SIS নিযুক্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বাসঘাতক ছিলেন। Johann de Graaf, যার SIS কোড নাম ছিল Jonny, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হত্যাকাণ্ডের ফলে কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে পড়া অনেকের মধ্যে অন্যতম।

অনেক ক্ষেত্রে, যদিও সচারচর দেখা যায় না, আদৌ গুপ্তচর নিয়োগের প্রয়োজন হয় না। তবে দেখা গেছে, যদি কেউ বিদেশীদের কাছে স্বেচ্ছায় তথ্য সরবরাহ করতে চায় (যাদের বলা হয় ‘ওয়াক-ইন’ গুপ্তচর এবং এ প্রসঙ্গে আগে উল্লেখ করা হয়েছে), তাহলে তিনি দূতাবাস বা কনস্যুলেটে ঢুকে গুপ্তচর হওয়ার প্রস্তাব দেন। যদিও এ স্বেচ্ছা প্রস্তাবকারী লোক অবিশ্বাসী হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং ভুল তথ্য প্রদান করতে পারে, কিন্তু তারা মূল্যবান গুপ্তচরও হতে পারে।

গুপ্তচরের মনোজগৎ

যদিও বর্তমানে গুপ্তচরবৃত্তি করার সিদ্ধান্তের পেছনে প্রায়ই ব্যক্তিগত আকাঙ্কা অনুপ্রাণিত করে, কিন্তু তাদের আচরণ, প্রেরণা, ব্যক্তিত্ব এবং মানসিকতা বোঝা অত্যন্ত জটিল বিষয়। মানুষ শুধু টাকার জন্য নয়, বরং জটিল মানসিক চাহিদা পূরণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং গুপ্তচরবৃত্তির মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ে। অনেকে মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভোগেন। যাহোক, গুপ্তচরবৃত্তির জন্য ধরা পড়ার পরে অনেকের মধ্যে অনুশোচনা দেখা গেছে। এ প্রসঙ্গে সিআইএ কর্মকর্তা অল্ড্রিচ অ্যামেসের উদাহরণ তুলে ধরা হলো। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনি নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক টিম ওয়েনারের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে তার কর্মকাণ্ডের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেন, যা ১৯৯৪ সালের ৩১ জুলাই ‘Why I Spied: Aldrich Ames’ শিরোনামে ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সে সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, ‘They [the KGB] went around and they wrapped all the agents up. I was amazed. I was anxious and amazed and shocked and scared. And in the course of the following years, all of the agents I told them about were recalled, transferred, arrested, what not, and then later on some of them were shot. . . The KGB later told me that they regretted acutely that they had been forced to take those steps [thereby triggering a mole hunt at CIA]. Had I known they were going to do that, I either would not have gone and sold them that information or I would have passed them out one by one.’

শেষ কথা

সফল গুপ্তচর হতে গেলে অনেক গুণাবলি থাকা চাই, বিশেষ করে তাকে হতে হয় সাহসী বা রিস্ক টেকার, তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন, ধীরস্থির, প্রয়োজনে নীরব থাকা, বিরূপ পরিস্থিতিতে তত্ক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এবং একাধিক আন্তর্জাতিক ভাষায় দক্ষতা। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা MI6-এর প্রধান Alex Younger-এর ভাষণের আংশিক উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। তিনি ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে গুপ্তচর এজেন্টদের কার্যক্রমের অবদান স্বীকার করে বলেন, ‘we owe that to the brave men and women who work with us to obtain the intelligence we need, often at great personal risk. These people, who we call agents will never enter our headquarters; they will usually not be British. Their motives for helping the UK are as diverse as the human race itself. But they have one thing in common: they take risks to make you and your families safer. More than they or you can ever know, the people of this country, and those of our allies, are deeply in their debt.’

 

তথ্যসূত্র:

১. Smith, M (2019), The anatomy of a spy: A history of espionage and betrayal, The History Press, Gloucestershire, UK.

২. Discernum (2017), Why Do People Spy? California, USA.

৩. Grabianowski E D (2007), How Spies work?

৪. Kissiah M(2020), Espionage and spying: Stealing secret information from another.

 

ফজল হাসান: লেখক ও অনুবাদক


শর্টলিংকঃ