চীনের ঋণ ফাঁদে বাংলাদেশ যেন না জড়ায়


ড. জেসমিন চৌধুরী:

পাকিস্তানের অধীনে জাতি যে বঞ্চনা, অবিচার, বৈষম্য ও যন্ত্রণার শিকার হয়েছে, তা আজও আমাদের মনে জ্বলজ্বল করছে। তাদের বর্বরতার কারণে বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতার লড়াই ছাড়া বিকল্প ছিল না। সেই সংকটময় পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক, সামরিক ও মানবিক ফ্রন্টে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে ভারত, আমাদের সঙ্গে তারা ভ্রাতৃত্বপূর্ণ বন্ধন প্রমাণ করেছে। কারণ বাংলাদেশ থেকে দশ লাখের বেশি শরণার্থী ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এভাবেই স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক।

ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রায়ই বলেছেন, চীন বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের প্ররোচনা দিয়েছে। চীন সব সময় মিয়ানমারের পাশে থাকে; যে কারণে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি করাতে পারছে না।

চীনের ঋণ ফাঁদ কূটনীতিতে বাংলাদেশ যেন জড়িয়ে না পড়ে। চীনা ঋণ পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, কেনিয়া, সুদান, জিম্বাবুয়ে, ইথিওপিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রোসহ অনেক দেশের অর্থনীতিকে বিপন্ন করে তুলেছে। চীনের নেতৃত্বে রয়েছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। এটি চীনের ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড (ওবিওআর) কর্মসূচির অংশ। করাচি স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে চীনের সংযুক্তি পাকিস্তানের শেয়ার বাজারকে ধ্বংস করেছে।

উল্লেখ্য, পাকিস্তান ১৯৬৯ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নীত হলেও বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের অর্থনীতিকে অতিক্রম করেছে।

শ্রীলঙ্কা বর্তমানে একটি গুরুতর বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের সাক্ষী, যা বেশ কয়েকটি প্রকল্পে চীনের প্রতি আর্থিক বাধ্যবাধকতা পূরণে অক্ষমতার কারণে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে, কারণ শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড (আইএসবিএক্স) ঋণের পরিপক্কতার তারিখগুলো পূরণ (ঋণের কিস্তি) করতে ব্যর্থ হয়েছে, এই প্রকল্পে ঋণের পরিমাণ ৮০০ কোটি ডলার। চীনা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় শ্রীলঙ্কাকে তাদের হাম্বানটোটা বন্দর চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে হয়েছিল।

উল্লেখ্য যে, বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) হল একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, যা অর্থায়ন এবং অবকাঠামো নির্মাণের জন্য; যা চীনকে বিশ্বের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করে। প্রকল্পটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ঋণ-ফাঁদ কূটনীতি’ বলে উল্লেখ করেছে।

এশিয়ান এজ চীনা ঋণ ফাঁদ কূটনীতির দ্বারা সৃষ্ট হুমকির বিষয়ে বেশ কয়েকটি নিবন্ধ এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এশিয়ান এজ আশা করে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে- যাতে বাংলাদেশ আরেকটি শ্রীলঙ্কায় পরিণত না হয়।

বিআরআইয়ের ছয়টি প্রধান অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে: (১) নতুন ইউরেশিয়ান ল্যান্ড ব্রিজ; (২) চীন-মধ্য এশিয়া-পশ্চিম এশিয়া করিডোর; (৩) চীন-পাকিস্তান করিডোর; (৪) বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমার করিডোর; (৫) চীন-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া করিডোর; (৬) চীন-ইন্দোচীন উপদ্বীপ করিডোর।

ইতিহাসের পেছনে তাকালে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। চীন বরাবরই পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ১৯৭১ সালে ত্রিশ লক্ষ শহীদকে চীনা বুলেটে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সুতরাং এইভাবে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া আদর্শগতভাবে ১৯৭১ সালের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তান ও চীন উভয়েরই বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত থাকাকালে চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীন সফর করেননি।

উইঘুর মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়নের জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো চীনের কড়া সমালোচনা করছে। ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধাক্কা দিয়েছে। কারণ আমদানি ব্যয় রপ্তানি আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের চীনা পণ্য আমদানি করে, যেখানে চীনে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারেরও কম।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পেছনে দায়ী চীন। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকিতে পরিণত হয়েছে, কারণ এই শরণার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্বারা সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশগত পবিত্রতা ও জীববৈচিত্র্যও বিনষ্ট হচ্ছে। মিয়ানমার কয়েকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করলেও বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী আত্মসংযম দেখিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা ও তা বৃদ্ধি করেন। জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনেকাংশে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। চীনের কমিউনিজমে বিশ্বাসী বিপুল সংখ্যক রাজনীতিবিদ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন। এভাবে বিএনপি ও চীনা মিউনিস্ট পার্টি একে অপরের রাজনৈতিক মিত্র হয়ে উঠে।

ধর্মীয় উগ্রবাদী, সাম্প্রদায়িক সংগঠন এবং উগ্রবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও আমাদের সত্য কথা বলা উচিত। হেফাজতে ইসলামের মতো ধর্মান্ধ ইসলামী দলগুলো বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির হুমকি। ২০২১ সালের দুর্গাপূজা উৎসবের সময় সাম্প্রদায়িক দলগুলো হিন্দুদের বাড়িঘর এবং মন্দির ভাংচুর করেছিল৷ হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা ২০২১ সালে বাংলাদেশের কিছু অংশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুর করেছিল৷

আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র। এটা মাথায় রেখে আমাদের দেশে ধর্মীয় বা অন্য কোনো ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টি করা থেকে দূরে থাকা উচিত। আমরা চাই না, আমাদের দেশে বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হোক। এটি যে আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তার বিরোধিতা করে এবং এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ তার বেশিরভাগ পণ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীরা বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠায় বেশিরভাগ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে, যারা রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিত্র।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। এ কারণে সারা বিশ্বে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির সময় বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে।

চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে কয়েক দশকের কৌশলগত সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে। তবে এটি সমালোচনার জন্ম দিয়েছে যে, এটি পাকিস্তানের জন্য ঋণের পাহাড় তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু ২৩ হাজার ৪২৫ টাকা বৈদেশিক ঋণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা বাংলাদেশকে ০.৭৫% সুদের হারে ঋণ দেয়। অথচ চীনা ঋণের সুদের হার ২.৪৫ শতাংশ। একই সঙ্গে চীন থেকে পরামর্শক নিয়োগ এবং চীনা সরঞ্জাম কেনার মতো শর্তাবলীও রয়েছে। কিছু চীনা প্রকল্প এবং পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ প্রজেক্ট (পিপিপি) নিয়ে অতিমূল্যায়নের অভিযোগে স্লেটিং মন্তব্য করা হয়েছে— যে বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা উচিত। তাই বাংলাদেশকে চীনের কাছ থেকে আরও ঋণ নেওয়ার আগে ভাবতে হবে, যাতে আমরা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো বিধ্বংসী পরিণতির সম্মুখীন না হই।

দ্য এশিয়ান এজ-এর প্রধান সম্পাদক ড. জেসমিন চৌধুরীর কলাম।


শর্টলিংকঃ