ছুটি উদযাপনের মাশুল দিতে শুরু করেছে ইউরোপ!


ইউএনভি ডেস্ক:

ইউরোপীয়রা গ্রীষ্মের শেষ সময়টুকু থেকে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে, তারা সমুদ্রসৈকতে, বারে, রেস্টুরেন্টে ও নাইট ক্লাবে গিয়ে আনন্দ করছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কম থাকায় মহাদেশজুড়ে কয়েক মাস ধরে ভ্রমণ ও পর্যটনকেন্দ্রিক বিধিনিষেধগুলো তুলে দেয়া হয়েছে। মানুষকে খাওয়ার জন্য, কেনাকাটা এবং ছুটি কাটাতে যেতে উৎসাহিত করেছে অনেক সরকার। যার ফলে এখন অনিবার্যভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে।

ফ্রান্সে ২০ আগস্ট একদিনেই ৪ হাজার ৭৭১ জন সংক্রমিত হয়েছে। মে মাসের পর প্রথমবারের মতো দেশটিতে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়াল। একই দিন জার্মানি ১ হাজার ৭০৭ জন সংক্রমিত হয়েছে বলে জানিয়েছে। এপ্রিলের পর সেটি ছিল দেশটির সর্বোচ্চ দৈনিক সংক্রমণ। স্পেন ও যুক্তরাজ্যেও সংক্রমণ বৃদ্ধির কথা জানা গেছে। ফলে বিজ্ঞানীরা ফের মহামারীর প্রকোপ বৃদ্ধির ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়েছেন দেশগুলোকে।

স্পেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ফার্নান্দো সিমন বলেন, কোনো ভুল করা যাবে না। ব্যাপারগুলো ঠিক হচ্ছে না।

সংক্রমণ বাড়ার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দোষ দেয়া হচ্ছে লোকজনের পার্টি করতে যাওয়া এবং ছুটি কাটানোকে। হ্যাঁ, অবশ্যই এ কাজগুলো সংক্রমণ বাড়িয়েছে। খুব বেশিদিন আগের কথা না যখন সরকারি কর্মকর্তারা কেবল সেসব করার অনুমতিই দেননি, বরং দেশের অর্থনীতিকে সচল করার জন্য মানুষকে উৎসাহিতও করেছেন।

কাতালোনিয়া অঞ্চলের করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গঠিত কমিটির ডিরেক্টর জাকোবো মেনডিওরোজ বলেন, আমরা টুরিস্ট ইন্ডাস্ট্রি থেকে ব্যাপক চাপের সম্মুখীন হয়েছিলাম, কারণ এটা স্পেনের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক খাত। বড় বড় দোকান খুলে দেয়ার জন্য আমাদের তাড়াহুড়ো করতে হয়েছিল, যাতে পর্যটকরা আমাদের দেশে আসে।

এ মাসে যুক্তরাজ্য সরকার অনেক টাকা খরচ করেছে রেস্টুরেন্টে ভর্তুকি দেয়ার জন্য। এটি করা হয়েছে মানুষজনকে বাইরে খেতে যেতে উৎসাহিত করার জন্য এবং এ শিল্পকে সাহায্য করার জন্য। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণরা প্রাথমিকভাবে সাম্প্রতিক সময়ে সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক ডিরেক্টর তাকেশি কাসাই বলেন, মহামারী বদলে যাচ্ছে। ২০, ৩০ ও ৪০ বছর বয়সী মানুষ সংক্রমণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।

স্পেনে কভিড-১৯-এ আক্রান্তদের গড় বয়স ৬২-৬৩ বছর থেকে কমে এখন ৩৭-৩৯ বছরে নেমে গেছে। সিমন বলেন, দেশে এখন উপসর্গহীন অনেক বেশি সংক্রমণ চিহ্নিত হচ্ছে। স্পেনে বার ও নাইট ক্লাবগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টায়।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সরকার বলেছে, দেশটির নিরাপদ ভ্রমণ তালিকা থেকে বাদ পড়ার পর অস্ট্রিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো থেকে আসা লোকদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। মূলত কভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পর এ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়া কিছু সংক্রমণ এসেছে ক্রোয়েশিয়া থেকে।

এর আগে জুলাইয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্পেনকে লিস্ট থেকে বাদ দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। সম্প্রতি স্পেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ফার্নান্দো সিমন দেশের তরুণ সমাজের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, যারা কিনা এখনো বিশ্বাস করছেন তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম তারা যেন সতর্ক হন। পাশাপাশি তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তারা যেন তাদের অনুসারীদের সতর্কবার্তা প্রদান করেন।

তিনি বলেন, এটা বলা মোটেই ঠিক না যে আমি তরুণ তাই আমি ভুগব না, আমার কিছুই হবে না। কারণ আমরা জানি যে প্রত্যেক তরুণ ঘরের অন্যদের আক্রান্ত করতে পারে এবং বয়স্ক ও দুর্বল মানুষদেরও সংক্রমিত করতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপের আঞ্চলিক ডিরেক্টর হান্স ক্লুগ বলেন, আমরা তরুণদের মাঝে ক্রমবর্ধনশীল সংক্রমণ নিয়ে বেশ চিন্তিত। কম ঝুঁকি মানে এই নয় যে কোনো ঝুঁকি নেই। কেউই অপ্রতিরোধ্য না।

এদিকে সংস্থার এপিডেমিওলজিস্ট মারিয়া ভ্যান কেরকোভে বলেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য তরুণদের বলির পাঁঠা বানানো ঠিক হবে না। যারা নিজেদের জীবন যাপন করতে চান তাদের দোষ দেয়া উচিত না। আমরা সবাই নিজেদের জীবন যাপন করতে চাই। আমরা সবাই নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাই।

ক্লুগের মতো তিনিও অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন, তরুণদের ওপর ভাইরাসের প্রভাব মারাত্মক হতে পারে এবং সবাইকে ঝুঁকিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে সতর্কবার্তা নিতে হবে। আমরা অনেক তরুণকে ভাইরাসে মৃত্যুবরণ করতে দেখছি। যদি ভিড় এড়িয়ে চলা সম্ভব হয় দয়া করে তা করুন।

অনেক দিক থেকেই ইউরোপ মহামারীর শুরুর সময়ের চেয়ে এখন ভাইরাস মোকাবেলায় প্রস্তুতিতে এগিয়ে আছে। বিজ্ঞানীরাও শুরুর দিক থেকে এখন এসে করোনাভাইরাসকে অনেক ভালোভাবে বুঝতে পারছেন। চিকিৎসকরাও রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার ব্যাপারে এখন অনেক কিছু জানেন। পাবলিক অফিশিয়ালরা আশা করেন স্বানীয় পর্যায়ে লকডাউন এবং সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নীতি ভাইরাসের সংক্রমণকে নিচে নামিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট হবে।

এর আগে জুলাইয়ে লকডাউন নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার সময় ইউরোপিয়ান কমিশন সর্তক করেছিল। তখন বলা হয়েছিল, দেশগুলোকে চিকিৎসা সরঞ্জাম, টেস্টিং ও ট্রেসিংয়ের দিক থেকে আরো ভালোভাবে প্রস্তুত হতে হবে দ্বিতীয় ঝড় মোকাবেলা করার জন্য। কমিশন বলেছিল গ্রীষ্মকাল প্রস্তুতির সময়, আরামের না।

স্বাস্থ্য কমিশনার স্টেলা বলেন, আমাদের এটা বলার অধিকার নেই যে অনেক হয়েছে, আমি অনেক ক্লান্ত, এটা যথেষ্ট। এর অর্থ সব উৎসর্গ যা এতদিন ধরে করে এসেছি তাতে পানি ঢেলে দেয়া।

এখন এ আশঙ্কাও আছে যে গ্রীষ্মের বাকি দিনগুলোতে উৎসবের আমেজ কাটালে মৌসুম বদলানোর পর সবকিছু বদলে যেতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দেবী শ্রীধর সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, যদি এ অবস্থা চলতে থাকে তবে শীতকালে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। তখন আবারো দেশব্যাপী লকডাউনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যা প্রভাব ফেলতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর।

হাফপোস্ট


শর্টলিংকঃ