ভয়াল ‘কালরাতের’ বর্বরতার ভার বইছে রাবির বধ্যভূমি


সুব্রত গাইন, রাবি:

যাঁরা এই সৌম্য স্মৃতিস্তম্ভের সামনে এসে আজ দাঁড়ান, তাঁদের পক্ষে কল্পনাও করা সম্ভব নয়; একাত্তরে কী বীভৎস দৃশ্যের সূচনা হয়েছিল এখানে। তবে যাঁরা প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছিলেন, আর যাঁরা স্বজনদের খুঁজতে গিয়ে লাশের স্তূপ হাতড়ে বেড়িয়েছেন, তাঁদের স্মৃতিতে ওই দুঃস্বপ্নের দৃশ্য আজও জ্বলজ্বল করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখেনি বিশ্ব। আবার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাঙালির দৃঢ় প্রতিরোধও অবাক বিস্ময়ে দেখেছে বিশ্ববাসী। আজ সেই ২৫ মার্চ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াল কালরাত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ইতিহাসের ভয়াবহ এ হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে।

পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ণ সামরিক অস্ত্র নিয়ে ১৯৭১ সালের ঠিক আজকের দিনের দিবাগত রাত ১০টার পর দেশজুড়ে শুরু করে মানবতার ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে তৎকালিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঙালি হত্যার নৃশংস নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে পা বাড়ান।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার সাক্ষী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে ক্যাম্প গড়ে তোলে হানাদার বাহিনী। রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন অভিযান চালিয়ে নিরপরাধ মানুষদের ধরে আনা হতো এখানে। নির্বিচারে হত্যা করা হতো। কাউকে গুলি করে, কাউকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বা জবাই করে হত্যা নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

তথ্যমতে, সেসময় জোহা হল পূর্ণাঙ্গভাবে নির্মাণের জন্য প্রচুর ইট এনে রাখা হয়েছিল, হলের পাশেই গর্তের মতো জায়গায়। পাকিস্তানি বাহিনী মানুষ হত্যা করে ওই গর্তের মধ্যে ফেলে রাখতো। কখনও কখনও নির্মমভাবে হত্যার পর শহীদদের মরদেহ গণকবর দিয়ে রাখা হতো।

পৈশাচিক হত্যাকান্ডের পর ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান জোহা হল থেকে অধা মাইল দূরে আবিস্কৃত হয় একটি গণকবর। এটি খনন করলে মিলে সহস্র মানুষের মাথার খুলি-নরঙ্কাল।

এছাড়াও পাওয়া যায় মানুষের ব্যবহৃত হাতঘড়ি ও কলম, টুপি, এক ও দশ টাকার নোট মিলে তিনশো টাকা, চাবির রিং, সাইকেলের চাবি, কানের দুল, সিগারেটে লাইটার, ম্যানিব্যাগ, কাজলের টিউব, ওড়না, পথর বসানো আংটি, চিরুনি ইত্যাদি।

এই সকল চিহ্ন থেকে বুঝা যায়, ৭১-এর দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞে রেহাই পায়নি রাজশাহীর মানুষগুলো। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী, কর্মকর্তাও। তাদের বর্বরতার সাথে হত্যা করে ফেলে গেছে নরপশুরা।

দেশ স্বাধীনের পর ওই বধ্যভূমি থেকে বহু মানুষের হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সংরক্ষণ করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহান শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মীরা স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিপরীত শক্তির হাতে সে উদ্যোগ বিপর্যস্ত হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে স্মৃতি সংরক্ষনের জন্য বধ্যভূমিতে ১৯৯৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হয়।

সে সময় স্মৃতিফলকটি উন্মোচন করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ূমের স্ত্রী অধ্যাপক মাস্তুরা খানম এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দারের স্ত্রী চম্পা সমাদ্দার। কিন্তু রাতের আঁধারে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা স্মৃতিফলকটি ভেঙে ফেলে।

পরবর্তীতে আবার স্মৃতিফলক নির্মাণের কাজ শুরু করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক সাইদুর রহমান খান। তিনি ১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর আবারও স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন।

পরে ২০০২ সালে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী রেদোয়ান আহমদ এবং ২০০৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ কাজ শেষ হলে এর উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।

স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরির পিছনে বেশ কয়েকটি দিক বিবেচনা করা হয়। প্রথমত এটি গোলাকৃতি একটি চৌবাচ্চাকে ভেদ করে চৌকাণাকৃতি ইটের দেয়াল ভেঙে এবরো-থেবরোভাবে গড়া। দেখে মনে হবে গুলির আঘাতে দেয়ালে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।

দেয়ালের এমন রূপ দেওয়ার কারণ হলো- ১৯৭১’এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর দ্বারা বাঙালিদের নির্মম নির্যাতনের মধ্যদিয়ে হত্যাকান্ডের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভটি ৪২ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে এটি বিস্তৃত। স্তম্ভের সামনে রয়েছে মুক্তি মঞ্চ।

এটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিকতার সাক্ষ্য। আর সেই স্মৃতিই ধারণ করেই মাথা উঁচু করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ। যা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।


শর্টলিংকঃ