রাজশাহীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকা কর্মকর্তার পকেটে


ইউএনভি ডেস্ক:

রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির কালচারাল একাডেমির আওয়াতায় এই সম্প্রদায়ের মেধাবী ও গরিব শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য ১২ লাখ টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এই টাকা বিতরণ করতে গিয়ে নিজেদের পছন্দের শিক্ষার্থী, আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।

রাজশাহীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকা কর্মকর্তার পকেটে

আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তালিকায় নাম থাকলেও সেই শিক্ষার্থীদের হাতে টাকা দেওয়া হয়নি। অনিয়ম থেমে থাকেনি এখানেই। রাজশাহী বিভাগের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শিক্ষার্থীদের জন্য এই বৃত্তির ব্যবস্থা করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। কিন্তু রাজশাহী বিভাগের বাইরেও বেশকিছু শিক্ষার্থীর নামে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যেও অনেকেই টাকা পাইনি বলে কালের কণ্ঠের কাছে দাবি করেছে।

অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষা বৃত্তির এই টাকা লুটপাটের অন্যতম হোতা হলেন রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির কালচারাল একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা বেঞ্জামিন টুডু। তাঁর সঙ্গে যোগসাজস করেই এই টাকার অধিকাংশ একটি চক্র নিজেদের পকেটে পুরেছেন। ফলে বঞ্চিত হয়েছে রাজশাহী বিভাগের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীরা।

আরোও পড়ুন:তুরাগ থেকে তরুণের মরদেহ উদ্ধার

রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির কালচারাল একাডেমি সূত্র মতে, ২০১৮-১৯ অর্ত বছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির জীবনমাণ উন্নয়নে গৃহীত ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতিত) শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় রাজশাহী বিভাগের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মেধাবী ও গরিব শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।

এর জন্য ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় গত বছরে। এরপর গত বছরের ২৭ মে একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বৃত্তি সুবিধা পাওয়ার যোগ্য শিক্ষার্থীদের তালিকা চাওয়া হয়। সেই গণবিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ক্ষুদ্র নৃ-ঘোষ্ঠির বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থীর বৃত্তির জন্য আবেদন জমা পড়ে।

এর মধ্যে প্রাথমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য যোগ্য প্রায় ৫০০ শির্ক্ষাথীর তালিকা সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়। তবে এই তালিকায় নিজেদের ইচ্ছামত শিক্ষার্থীদের নাম দেওয়া হয়। যাদের অনেকেই সেই টাকা এখনো হাতে পায়নি। আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থীর নাম-পরিচয় ও মোবাইল নম্বরও ভুল করে দেওয়া রয়েছে তালিকায়।

অভিযোগ উঠেছে, রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির কালচারাল একাডেমির গবেষণা কর্মকর্তা একক ক্ষমতা বলে তিনি নিজের ইচ্ছামতো তালিকা তৈরী শিক্ষার্থীদের বৃত্তির অধিকাংশ অর্থই লোপাট করেছেন একটি চক্রের সহায়তায়। ফলে সরকারের নেওয়া উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। বঞ্চিত হয়েছে প্রকৃত উপকারপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা।

কলেজ পর্যায়ে তালিকার ১৪ নম্বরে নাম থাকা নাটোর জেলার কাজলী রানীর বাবা কানাই চন্দ্র বলেন, ‘আমা মেয়ে কোনো শিক্ষা সহায়তা পাইনি রাজশাহী কালচারাল একাডেমি থেকে। কারা আমার মেয়ের নাম দিয়েছে বলতে পারব না। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ। অনেক কষ্টে মেয়েকে পড়া-লেখা করাচ্ছি। সে এখন দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে।’

রাজশাহী বিভাগের বাইরে নিয়ম ভেঙে রংপুর বিভাগ থেকেও বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় নাম দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কলেজ শিক্ষার্থী সন্ধ্যা সরেন বলেন, ‘দাদা আমি তো কোনো টাকা পাইনি। আমার নাম কিভাবে গেলো ওই তালিকায়। আমাকে কেউ বৃত্তিরা টাকা দেয়নি।’

ফোন করা হয় নাটোরের শুভ্র তিরকীকে। তিনিও একই দাবি করেন। এছাড়াও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কলেজ শিক্ষার্থী জানায়, ৫ হাজার টাকার পরিবর্তে তাকে দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার টাকা।সূত্র মতে, প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য এক হাজার ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ৪ হাজার টাকা এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ হাজার টাকা করে বৃত্তি দেওয়া হয় বলে ব্যয় দেখানো হয়। তবে এখনো স্কুল পর্যায়ে কাদের বৃত্তি দেওয়া হয়েছে সেই তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে গবেষণা কর্মকর্তার বেঞ্জামিন টুডুর আপন দুই ভাই হরেন্দ্রনাথ টুডু ও নরেন্দ্রনাথ টুডুর সন্তানদের নামেও এই বৃত্তি উত্তোলন করা হয়েছে। আবার কালচারাল একাডেমির প্রশিক্ষক ম্যানুয়েল সরনের মেয়ে মেলোডি রীলামালা সরেনও পেয়েছেন ৫ হাজার টাকা। কালচালার একাডেমির নির্বাহী সদস্য যোগেন্দ্রনাথ সরেন ও চিত্তরনঞ্জন সরদারের সন্তানরাও পেয়েছেন বৃত্তির টাকা। কিন্তু তারা সকলেই চাকরিজীবী বা ধনি শ্রেণির।

অভিযোগ রয়েছে, নানা অনিয়মের কারণে এই বেঞ্জামিন টুডুকে ২০১২ সালে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিলো। এর প্রায় ৫ বছর পরে নির্বাহী কমিটির কোনো সুপারিশ ছাড়ায় মন্ত্রণালয় থেকে তাঁর বরখাস্তের আদেশটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
তবে বৃত্তির টাকা লোপাটের কথা অস্বীকার করে গবেষণা কর্মকর্তা বেঞ্জামিন টুডু বলেন, ‘নাটোর আর জয়পুরহাট জেলার কয়েকজন শিক্ষার্থীকে টাকা দেওয়া হয়নি। বাকিরা সবাই টাকা পেয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়নি। কারো কারো নাম খুঁজে পেতেই আমাদের কষ্ট করতে হয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘নিজেদের অনেক শিক্ষার্থীরও তালিকায় নাম উঠে গেছে। তারা টাকা পেয়েছে। তাদের অধিকার আছে পাওয়ার।’এদিকে রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির কালচারাল একাডেমির উপপরিচালক চিত্রলেকা নাজনীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বৃত্তি বিতরণের বিষয়টি অবগত নন বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, বৃত্তি বিতরণের দায়িত্ব গবেষণা কর্মকর্তা নিজেই নিয়েছেন বলে জানি। কারা বৃত্তি পেয়েছে বলতে পারব না। এই তালিকা অনেক আগেই করা হয়েছিল। তখন আমি ছিলাম না।’


শর্টলিংকঃ