রুমন-পূর্ণির একদিনের সংসার!


নিজস্ব প্রতিবেদক :

রাজশাহীর পদ্মায় নৌকাডুবির ঘটনার পর বিয়েকে ঘিরে দুই বাড়ির দৃশ্যপট এখন এমনই শোকাবহ। স্বজন হারানোর ব্যথায় স্তব্ধ হয়ে গেছে বিয়ের ধুমধাম। কান্নার রোল পড়ে গেছে দুই পরিবারেই। নৌকাডুবির পর ভাগ্যক্রমে কোনোরকমে সাঁতরে পাড়ে উঠে প্রাণে বেঁচে আছেন বর আসাদুজ্জামান রুমন (২৫)। কিন্তু এখনও সন্ধান মেলেনি তার নববধূর। তিনি বেঁচে আছেন না স্রোতস্বিনী পদ্মাতেই তার সলিল সমাধি হয়েছে সে কথা জানা নেই কারও। তাইতো নদীর পাড়ে বসে অপেক্ষার প্রহর গুণছেন সবাই।

কনে সুইটি খাতুন পূর্ণি ও বর আসাদুজ্জামান রুমন

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নৌকায় চেপে হৈ চৈ করে নববধূ নিয়ে বাড়ি ফেরা। একদিন পরই হলো বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান। কিন্তু চিরসঙ্গীকে হারিয়ে সেইদিনই ফের নিঃসঙ্গ হলেন নতুন বর! এর চেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা কী আর হতে পারে?

তাই-তো বিয়ে বাড়ি সব আনন্দ মুহূর্তেই রূপ নিয়েছে বিষাদে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাকে ঘিরে স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীর মনে যখন আনন্দ আর উৎসবের ঘনঘটা। বর-কনের স্বপ্নের বাসরে তখনই নেমে এলো অমানিশার অন্ধকার। বর্ণিল উৎসবের রেশ না কাটতে না কাটতেই শুরু হলো শোকের মাতম! নতুন জীবনের মানেটা হারিয়ে গেলো ঠিকঠাক করে শুরুর আগেই।

পঁচিশ বছরের যুবক রুমন নদীর ওপারে থাকা চরখিদিরপুর গ্রামের মৃত ইনছার আলীর ছেলে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন- কনে সুইটি খাতুন পূর্ণিমা (২০)। তার বাড়ি রাজশাহী শহর সংলগ্ন পবা উপজেলার ডাঙেরহাট গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের শাহীন আলীর মেয়ে। বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) রুমন-সুইটির বিয়ে হয়।

হাতের মেহেদির রঙ না শুকোতেই হারিয়ে গেলেন নববধূ সুইটি। হয়তো কোনো অলৌকিক চমৎকারে বেঁচে আসবেন ফিরে। না হয় আসবেন নিথর দেহে। পরনের লাল টুকটুকে শাড়িটাও হয়তো তখন বিবর্ণ কান্না হয়ে বইবে স্বজনদের চোখে।

শুক্রবার (৬ মার্চ) সন্ধ্যায় রাজশাহী মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকার বিপরীতে মধ্যপদ্মায় এ নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এসময় বালুবাহী ট্রলারের সহায়তায় ১৪ জন প্রাণে বেচে যান। এরমধ্যে হাসপাতালে নেওয়ার পর এক শিশুর মৃত্যু হয়।

উদ্ধার হওয়া ১৪ জনের মধ্যে শুক্রবার দিনগত রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ছয়জনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন- খাদিমুল ইসলাম (২৩), রতন আলী (২৮) ও তার স্ত্রী বৃষ্টি খাতুন (২২), সুমন আলী (২৮) ও তার স্ত্রী নাসরিন বেগম (২২) এবং মেয়ে সুমনা আক্তার (৬)। এর মধ্যে খাদিমুল ছিলেন নৌকার মাঝি। আর রতন ও তার স্ত্রী বৃষ্টি খাতুন জীবিত উদ্ধার হলেও তাদের ছয় বছরের মেয়ে মরিয়ম খাতুন মারা গেছে। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে তাকে উদ্ধার করা হয়েছিল। আর মেয়েকে নিয়ে সাঁতরে উঠেছিলেন সুমন-নাসরিন দম্পতি।

স্থানীয়দের বরাত দিয়ে রাজশাহী সদর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বলছে, পদ্মা নদীতে বিয়ে বাড়ির দু’টি নৌকা ডুবে গেছে। দুই নৌকায় প্রায় ৩৮ জন যাত্রী ছিলেন। ঘটনার পর উদ্ধার করা হয়েছে ১৪ জনকে। এর মধ্যে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মরিয়ম খাতুন নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন- প্রায় ২৪ জন। তারা শুক্রবার সন্ধ্যায় বরের বাড়িতে বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান শেষে নববধূ নিয়ে ফিরছিলেন। ফিরোনি অনুষ্ঠানের জন্য বর-কনেসহ কনে পক্ষের লোকজন নদীর ওপারে চরখিদিরপুর থেকে ওপারে থাকা পবা উপজেলার ডাঙেরহাটে ফেরার পথে এ ঘটনা ঘটে।

ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের রাজশাহী সদর দফতরের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আব্দুর রউফ ইউনির্ভাসাল২৪নিউজকে জানান, শুক্রবার রাত ৭টা ৯ মিনিটে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ থেকে এ নৌকাডুবির ঘটনা জানানো হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যেই তারা বেরিয়ে পড়েন। তবে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত তারা কাউকে উদ্ধার করতে পারেননি। যারা উদ্ধার হয়েছেন তারা কেউ সাঁতরে উঠেছেন আবার কেউ বালুবাহী ট্রলারে উঠে কোনো রকমে বেঁচে এসেছেন।

মৃত শিশু মরিয়ম

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স রাজশাহী সদর দফতরের উপ-পরিচালক আবদুর রশীদ বলেন, তাদের ডুবুরি ইউনিটে মোট পাঁজন সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন নৌবাহিনীর একটি ট্রেনিংয়ে রয়েছেন। আর একজন রয়েছেন ছুটিতে। দুইজন সদস্য অবশিষ্ট রয়েছেন। তাদের দিয়েই বর্তমানে পদ্মানদীতে নিখোঁজদের উদ্ধারে অভিযান চলছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) একটি ডুবুরি ইউনিট রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। তারা ভোরের মধ্যে এসে পৌঁছাবে। এর আগ পর্যন্ত তাদের ডুবুরি ইউনিট নিখোঁজদের তল্লাশি অভিযান অব্যাহত রাখবেন। যদিও জীবিত অবস্থায় এখন নিখোঁজদের উদ্ধার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটেছে জানতে চাইলে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে আবদুর রশীদ জানান, দু’টি নৌকাই পাশাপাশি যাচ্ছিলো। হঠাৎ বাতাসে ডুবচরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্রথম নৌকাটি তলা ফেটে ডুবে যায়। এসময় দ্বিতীয় নৌকাটি প্রথম নৌকার সঙ্গে ধাক্কা গেলে ডুবে যায়। এমন সময় পাশ দিয়ে যাওয়া একটি বালুবাহী ট্রলারে উঠে ১৪ জন প্রাণে বেঁচে যান। এদের মধ্যে থেকে এক শিশুকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এদিকে, রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এ নৌকাডুবির ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্ধার কাজ মনিটরিং করা হচ্ছে। যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে এরই মধ্যে চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএর একটি ডুবুরি ইউনিট রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। তারা ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছালে যৌথভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালাবে। যতদূর সম্ভব নিখোঁজ প্রত্যেককেই উদ্ধারের জন্য তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।


শর্টলিংকঃ