অনুদানের অর্থ ব্যয়ের অনুসন্ধানে গোয়েন্দারা


ইউএনভি ডেস্ক:

হেফাজতে ইসলামের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগরীর মোহাম্মদপুর, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী ও বারিধারায় বিভিন্ন মাদ্রাসার অনিয়ম-দুর্নীতির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ- এসব মাদ্রাসার অধিকাংশের আয়-ব্যয়ের হিসাব নেই। দেশের বাইরে থেকে আসা অনুদান কীভাবে খরচ করা হয় তার কোনো নথিও সংরক্ষণ করা হয় না অনেক মাদ্রাসায়।

এসব অর্থ শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যয় হয় নাকি অন্য কোনো খাতে খরচ করা হয়- এসব বিষয় আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এছাড়া হেফাজতের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোনো কোনো মাদ্রাসার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন অবৈধ- এমন অভিযোগের বিষয়েও অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানসংশ্লিষ্টরা জানান, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে কওমি মাদ্রাসা স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। তবে সম্প্রতি দেশব্যাপী সহিংস কর্মকাণ্ডের কারণে হেফাজতকে কোনো ছাড় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

এদিকে সহিংসতার ঘটনায় সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আল্লামা মামুনুল হকসহ অন্তত ১৫ কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হয়েছেন।বৃহস্পতিবার রাজধানীর বংশাল থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) হেফাজতের ঢাকা মহানগরের সহ-দফতর সম্পাদক মাওলানা ইহতেশামুল হক সাথীকে গ্রেফতার করেছে।

এদিন হেফাজতে ইসলামের সহকারী মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সহ-সভাপতি খুরশিদ আলম কাসেমীসহ পাঁচ নেতার ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এছাড়া সারা দেশে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা ১৬ মামলার তদন্তভার পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

হেফাজতের মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হেফাজত নেতারা সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সহিংসতার ঘটনাগুলোর উসকানিদাতা হিসাবে নিজেদের দায় স্বীকার করেছেন। অধিকাংশ হেফাজত নেতা বলেছেন, ‘জোসের’ কারণে তারা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন।

আর মাঠপর্যায়ে তাদের অনেক কর্মী থাকার কারণে নিজেদের সামর্থ্য জানান দিতেই কর্মসূচি দিয়েছিল। এছাড়া সরকারবিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দলের ইন্ধনও ছিল।

এর বাইরে কোনো কোনো হেফাজত নেতার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের উচ্চাকাক্সক্ষাও ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে পৃষ্ঠপোষক হিসাবে যারা আছেন তাদের বিষয়েও রিমান্ডে তথ্য দিয়েছেন হেফাজত নেতারা। তবে এসব তথ্য খুবই স্পর্শকাতর হওয়ায় আরও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। হেফাজতের অন্যতম শীর্ষ নেতা মামুনুল হককে মোহাম্মদপুর থানার একটি মামলায় ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হারুন অর রশিদ বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সাধারণ মানুষকে উসকানি, সরকারকে বিদায় করা, মন্ত্রীদের কটূক্তি করার বিষয়গুলো নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। এসব কাজে হেফাজতকে দেশে বা দেশের বাইরে থেকে কেউ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে কিনা- সবকিছুই আমরা তদন্ত করে দেখছি।

সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করেন। এ মাদ্রাসাটি ২০০১ সালে খেলাফত মজলিসের তৎকালীন আমির আল্লামা আজিজুল হক প্রভাব খাটিয়ে দখল করেন। পরে বিষয়টি আদালতে গড়ায়।

আদালত একটি স্বতন্ত্র বোর্ড গঠন করার বিষয়ে নির্দেশনা দেন। বোর্ড গঠন করতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগও দেওয়া হয়। আদালতের নির্দেশনার পর আজিজুল হক মাদ্রাসার দায়িত্ব দেন তার ছেলে মামুনুল হককে। তিনি প্রভাব খাটিয়ে সেই বোর্ড আর গঠন করতে দেননি।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, দেশের বাইরে থেকে কওমি মাদ্রাসাগুলোর জন্য অনেক অনুদান আসে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসব মাদ্রাসায় অনুদান আসে।এসব অনুদান কীভাবে খরচ করে, কোন খাতে খরচ করে- এ নিয়ে গোয়েন্দারা অনুসন্ধান করছেন। এসব অর্থ হেফাজতের সাংগঠনিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা- এ প্রশ্নটিও সামনে এসেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, যেসব হেফাজত নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ১৫ থেকে ২০টি করে সহিংসতার মামলা রয়েছে। তাদের অন্যান্য মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে রিমান্ড চাওয়া হবে। এ কারণে তারা আবদার করছেন, কম সংখ্যক মামলায় যেন তাদের শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ক্রাইম) শাহ আবিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, কাউকে শ্যোন এরেস্ট দেখানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নেন। তদন্ত কর্মকর্তা যদি মনে করেন, তবে সংশ্লিষ্ট মামলায় হেফাজত নেতাদের শ্যোন অ্যারেস্ট দেখাবেন।

খুরশিদ কাসেমীসহ পাঁচ নেতা রিমান্ডে : হেফাজতে ইসলামের সহকারী মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরের সহ-সভাপতি খুরশিদ আলম কাসেমীসহ পাঁচ নেতার ৫ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে শুধু একজনের দুই মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম বাকী বিল্লাহ এ আদেশ দেন। রিমান্ডে যাওয়া অপর আসামিরা হলেন- হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও খেলাফতে মজলিসের সাধারণ সম্পাদক মুফতি শরাফত হোসাইন, হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমেনী, হেফাজত ইসলামের ঢাকা মহানগরের সহ-সভাপতি মাওলানা জুবায়ের আহমদ ও হেফাজত নেতা মাওলানা সানাউল হক।

আসামিদের মধ্যে জুবায়ের আহমদের দুই মামলায় ৫ দিন করে ১০ দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। র‌্যাব, পুলিশ ও ডিবির পৃথক অভিযানে বুধবার তাদের গ্রেফতার করা হয়।

সম্প্রতি নাশকতা, হত্যার চেষ্টা, ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন অভিযোগে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার মধ্যে ১৬টি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে পিবিআই। বৃহস্পতিবার পিবিআইর প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।


শর্টলিংকঃ