অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রশান্তের অর্থ আত্মসাৎ


ইউএনভি ডেস্ক:

অস্তিত্বহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান খুলে আর্থিক খাতের অর্থ লুটে নিয়েছেন প্রশান্ত কুমার হালদার। এ কাজ করতে গিয়ে একে একে ১৪টি ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। ব্যবহার করেছেন ১০-১২ জনকে। তাদের মধ্যে একজনের নামে লুটের টাকার চেক ইস্যু হলেও শেষ পর্যন্ত সেই টাকা প্রশান্তের ব্যাংক হিসাবেই জমা হয়েছে।


এভাবে প্রশান্ত হালদার পিপলস লিজিংসহ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আত্মসাৎ করেছেন প্রায় তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এসব দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। প্রশান্ত হালদার ছিলেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের এমডি এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সের পরিচালক। পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে না থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় তার প্রত্যক্ষ হাত ছিল। বছরখানেক আগে দুর্নীতির খবর প্রকাশ পেলে তিনি গা ঢাকা দেন। তিনি দেশে নাকি বিদেশে আছেন- কেউ তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। অস্তিত্বহীন ও জালিয়াতির কাজে ব্যবহার করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, আনান কেমিক্যাল, ওকায়ামা লিমিটেড, মেসার্স বর্ণ, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, সুখাদা লিমিটেড, রেপটাইল ফার্ম, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, আরবি এন্টারপ্রাইজ, এসএ এন্টারপ্রাইজ ও ইমেক্সকো।

দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, প্রতারণা ও জালিয়াতি করে ঋণের নামে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজারে সরিয়ে নিয়ে এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এ লক্ষ্যে খোলা ১৪টি প্রতিষ্ঠানের জন্য রাজধানী ঢাকার মাত্র দুটি ঠিকানা ব্যবহার করা হয়। ঠিকানা দুটিতে অনুসন্ধান চালিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ব্যবহার করে তিনি পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স থেকে তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।

দেখা গেছে, বেশির ভাগ ঋণের ক্ষেত্রেই জামানত (মর্টগেজ) ছিল না। থাকলেও এর পরিমাণ ছিল খুবই নগণ্য। কিছু ঋণের ক্ষেত্রে জামানত নেওয়ার কথা থাকলেও পরে তা নেওয়া হয়নি। এক পর্যায়ে ঋণের জন্য খোলা হিসাব থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়। দুদক উপপরিচালক অনুসন্ধান কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধানের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দুর্নীতির নানা তথ্য-প্রমাণ।

যেসব তথ্য-প্রমাণ মিলেছে : অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, অমিতাভ অধিকারী আনান কেমিক্যালের এমডি, উজ্জ্বল কুমার নন্দী চেয়ারম্যান ও উজ্জ্বল কুমার নন্দীর স্ত্রী অনিতা কর পরিচালকের দায়িত্বে থাকলেও এই পর্যায়ে সুবিধাভোগী ছিলেন প্রশান্ত। একটি লিজিং কোম্পানি থেকে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য আনান কেমিক্যালের নামে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পুরো টাকা বিভিন্ন জনের হিসাবে স্থানান্তর করে পরে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। এটি মানিলন্ডারিং অপরাধ। এই ঋণের ক্ষেত্রে কোনো জামানত ছিল না। ২০১৬ সালের ১৫ জুন ওকায়ামা লিমিটেডের নামে পাঁচ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আইএফআইসি ও ব্র্যাক ব্যাংকের হিসাবে স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করা হয়।

২০১৬ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে ৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা হাল ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক এশিয়ার হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে একই বছরের ২১ জুন ওই টাকা প্রশান্তের ব্যক্তিগত হিসাবে (নং ০২১৩৪০০৮২৫৪) স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করা হয়। ২০১৬ সালের ২৩ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চেক ব্যবহার করে ১১ কোটি ১৪ লাখ টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে ওই টাকা দিয়ে শিপিংয়ের ঋণ সমন্বয় করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর ১৫ কোটি টাকা ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জমা হওয়ার পর ওই টাকা একটি ব্যাংক শাখায় মেসার্স বর্ণ, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড ও আরবি এন্টারপ্রাইজের হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। একই বছরের ১৭ নভেম্বর ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে আরও সাত কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরে এই টাকা সুখাদা লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। অর্থাৎ ঋণের নামে নেওয়া অর্থ প্রশান্তের লোকজনের হিসাবে সরিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়।

অমিতাভ অধিকারী প্রশান্তের আপন খালাতো ভাই এবং উজ্জ্বল কুমার নন্দী পুরোনো সহকর্মী। উজ্জ্বল পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে এবং অমিতাভ পিপলস লিজিংয়ের পরিচালক হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ করেছেন। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে টাকা স্থানান্তর করে ওই টাকায় তারা পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন। পরে একই প্রক্রিয়ায় পিপলস লিজিং থেকে টাকা স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করা হয়। এভাবেই এই লিজিং কোম্পানিকে পথে বসানো হয়।

ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে ৬৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হলেও পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে সে টাকার মধ্য থেকে ব্যাংক এশিয়ার অনুকূলে ২০১৬ সালের ১৫ জুন চার কোটি করে আট কোটি টাকার দুটি চেক ও ২৮ জুন দুই কোটি টাকার দুটি চেক ইস্যু করা হয়। ওই টাকা পরে ব্যাংক এশিয়ার ধানমন্ডি শাখায় উজ্জ্বল কুমার নন্দীর ০২১-৩৪০০-৯০৯৯ নং ও অমিতাভ অধিকারীর ০২১-৩৪০০-৯০৯২ নং হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। উভয়ের হিসাব থেকে ওই টাকা ২০১৬ সালের ১৬ জুন দুটি চেকের মাধ্যমে ব্যাংকের একই শাখায় প্রশান্তের ০২১৩৪০০৮২৫৪ নং হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়।

দুদক জানায়, ২০১৬ সালের ২৩ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চেক ব্যবহার করে ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে ওই টাকা দিয়ে ইমেক্সকোর একটি ব্যাংক হিসাবের অর্থ সমন্বয় করা হয়। রেপটাইল ফার্মের ৯৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কাগুজে প্রতিষ্ঠান পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনালের নামে। যেটির পরিচালক উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও অমিতাভ অধিকারী।

দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, প্রশান্তের সহযোগী উজ্জ্বল মল্লিক ও সোমা ঘোষের নামে ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা বলে ৬৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৯টি চেক ব্যবহার করে এফএএস ফাইন্যান্সে ২০১৬ সালের ২৯ জুন ৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা স্থানান্তর করে। পরে একই দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি চেক ব্যবহার করে ১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে সরিয়ে নেওয়া হয়। ওই টাকা দিয়ে এসএ এন্টারপ্রাইজের একটি ঋণ হিসাব সমন্বয় করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে ১০ কোটি টাকা ব্যাংক এশিয়ায় পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে সরিয়ে নেওয়ার পর ওই টাকা ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ২৯ জুন একটি ব্যাংকে রেপটাইল ফার্মসের হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। গত ২০১৬ সালের ২৫ জুলাই ঋণের ছয় কোটি টাকা একটি ব্যাংকে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে স্থানান্তর হওয়ার পর তা একই ব্যাংকে রেপটাইল ফার্মসের হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়।

একইভাবে প্রশান্ত তার বন্ধু মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক একেএম শহীদ রেজার স্বার্থসংশ্নিষ্ট পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে ১০৪ কোটি টাকা ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের সাতটি ঋণ হিসাব থেকে ৩৩টি চেকের মাধ্যমে ওয়ান ব্যাংক গ্রাহক ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফান আহমেদ খানের জে. কে. ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের একটি হিসাবে ৭৪ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। এভাবেই পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সের তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

– সমকাল


শর্টলিংকঃ