রামেক হাসপাতালে পাঁচ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ


জিয়াউল গনি সেলিম :
ক্ষমতাসীন দলের ঠিকাদারদের অনিয়মে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই কোটি টাকার টেন্ডারের মালামাল কেনা যায় নি।সরকার এ খাতে বরাদ্দ দিলেও ঠিকাদারদের গাফিলতির কারণে বাইরে থেকে নিজেদের টাকাতেই সার্জিক্যাল সরঞ্জাম কিনতে হচ্ছে রোগীদের। এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেছে কার্যাদেশের মেয়াদ। মালামাল কিনতে না পারলে টাকা ফেরত দিতে হবে। অর্থবছর শেষে এখন বিপাকে পড়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রোগীদের জন্য গজ, ব্যান্ডেজ, ক্যাটগার্ড ও কেমিক্যালসহ সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনার জন্য গেল বছরের ২১ সেপ্টেম্বরে দরপত্র আহ্বান করেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক। টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ায় (স্মারক নং: রামেকহা/প্রশা/২০২০-২১/৭১৪৮ তারিখ : ৩০/১২/২০২০) এমএসআর-সি গ্রুপের ৬টি আইটেমের প্রায় ২৮লাখ টাকার মালামাল সরবরাহের জন্য নির্বাচিত হয় জানে আলম ট্রেডার্স। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক রাজশাহী মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের শ্রম ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক জানে আলম খান জনি। এরপর চুক্তিনামার জন্য তাকে চিঠি দেয়া হলেও তাতে সাড়া দেন নি তিনি।দেন নি জামানতের টাকাও। এরইমধ্যে পার হয়ে গেছে কার্যাদেশের মেয়াদ।

একই টেন্ডারে ঢাকার এনএইচ ট্রেডার্স নামের আরেকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে এমএসআর-ডি অর্থাৎ কেমিক্যাল রিএজেন্ট গ্রুপের ৪টি আইটেমের দুই লাখ ৩৭ হাজার টাকার মালামাল সরবরাহের জন্য নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তি করে নি এই প্রতিষ্ঠানটিও। অর্থবছরও প্রায় শেষ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলছেন, ‘এই দুটি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র দেখে আমরাও খানিকটা অবাক হয়েছিলাম। কারণ, তারা যে দর দিয়েছিল, তাতে মালামাল কেনা সম্ভব নয়। আমাদের ধারণা, কাজটি নিজেরা পেতে এই কৌশল করেছিল তারা। অন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাওয়ার সুযোগ না দিতেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারসাজি করেছিল খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলো।

এদিকে পাবনার আরজেডএস এন্টারপ্রাইজ, ঢাকার পল্লবীর আইয়ান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও নাটোরের এমদাদুল হক কার্যাদেশের চুক্তি মোতাবেক মালামাল সরবরাহ করে নি। আরজেডএস এন্টারপ্রাইজ এমএসআর-সি (সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি) গ্রুপের ১১টি আইটেমের মালামাল সরবরাহের কার্যাদেশ (স্মারক নং রামেকহা/এমএসআর/২০১৯-২০২০/৩৩৯ তারিখ: ১৯/০১/২০২১) দেয়া হয়েছিল। তারা মোট ৬৮লাখ ১৩হাজার ৭০৬টাকার কাজ পায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কার্যাদেশের ৮নং ও ১০নং মালামাল সরবরাহ করে নি। এমএসআর-ই (লিলেন সামগ্রী)গ্রুপের দুটি আইটেমে মালামাল সরবরাহের জন্য কার্যাদেশ দেয়া হলেও একটি আইটেম সরবরাহ করে নি। একইভাবে এমএসআর-এফ (আসবাবপত্র) গ্রুপের ৫টি আইটেম সরবরাহের কাজ পেয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। এরমধ্যে ৪টি আইটেমই সরবরাহ করে নি। কার্যাদেশের মেয়াদ শেষ সত্ত্বেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সমস্ত মালামাল সরবরাহের জন্য চিঠি (স্মারক নং রামেকহা/ প্রশা/২০২০-২০২১/১৩৬৩ তারিখ : ২২/৩/২০২১) দিয়ে তাগাদা দেয় প্রতিষ্ঠানটিকে। কিন্তু মালামাল সরবরাহ না করে উল্টো চিঠি দিয়ে দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়েছেন ঠিকাদার। তবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের এই চিঠি আমলে নেয় নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, নাটোরের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এমদাদুল হককে (স্মারক নং: রামেকহা/এমএসআর/২০১৯-২০২০/৩৩৮ তারিখ: ১৯/১/২০২১) এমএসআর-সি (সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি) গ্রুপের ৮টি আইটেমে মালামাল সরবরাহের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছিল। তিনি কার্যাদেশের ৫,৬ ও ৭নং আইটেমের মালামাল সরবরাহ করেন নি। এছাড়া, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য এমএসআর-ডি (কেমিক্যাল রিএজেন্ট) গ্রুপের দুটি আইটেমের মালামাল সরবরাহেও চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। কার্যাদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তিনি ২নং আইটেমের আল্ট্রাসনো ফ্লিম-২০০ রোল সরবরাহ করেন নি। মোট ৭৬লাখ ৬৪হাজার ৩৬৬টাকার মালামালের মধ্যে মাত্র ৯লাখ টাকার মালামাল সরবরাহ করেছেন এমদাদুল হক।

ঢাকার পল্লবীর আইয়ান ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে এমএসআর-সি (সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি)গ্রুপের ৯টি আইটেমের মালামাল সরবরাহের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো মালামাল সরবরাহ করে নি তারা। একইভাবে এমএসআর-বি (গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা) গ্রুপের দুটি আইটেমের মালামাল কাজ পায় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু তারা কার্যাদেশের ১নং আইটেমের এক ইঞ্চি মাইক্রোপোর ৩৩৮০টি এবং ২নং আইটেমের দুই ইঞ্চি মাইক্রোপোর ৮৮০টি সরবরাহ করে নি।

এদিকে মালামাল সরবরাহ না করায় পিপিএ -২০০৬ ও পিপিআর -২০০৮ মোতাবেক এই ৫টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্রয় কার্যক্রমে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। একইসাথে পিপিআর-এর শর্ত ভঙ্গ করায় জানে আলম ট্রেডার্সের বায়না হিসেবে দরপত্রের সাথে দাখিল করা পে-অর্ডারের তিন লাখ ৩৫হাজার টাকা ও এনএইচ ট্রেডার্সের পাঁচ লাখ ৮৮হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। গেল ২৪মে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী স্বাক্ষরিত চিঠিতে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানে আলম ট্রেডার্সের মালিক জানে আলম খান জনির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে সব আইটেমেরই দাম বেড়ে গেছে। এ কারণে চুক্তি করি নি। বিষয়টি জানিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠিও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সেটা শোনেন নি।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন. ‘আগে নানা ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা হয়েছে। কখনো ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। তবে আমি যোগদানের পর এই প্রথম ঠিকাদারদের অনিয়মের অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়া হলো। যদিও এরইমধ্যে অর্থবছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। রি-টেন্ডার করে মালামাল কিনতে না পারলে সরকারী বরাদ্দের টাকাটা ফেরত দিতে হবে’। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরো বলেন, ‘সরকার রোগীদের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে। কিন্তু ঠিকাদারদের গাফিলতিতে রোগীরা এর সুফল পেলেন না। রোগী হয়তো ভাবলেন, সরকার-ই দেয় নি। কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়। আমি সরকারী অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই’।#


শর্টলিংকঃ