এবার মিষ্টতা না থাকায় খ্যাতি হারাচ্ছে রাজশাহীর আম!


নিজস্ব প্রতিবেদক :

নির্ধারিত সময়ের পরও আম না পাকায় ও আমের  কাঙ্ক্ষিত স্বাদ-গন্ধ না পাওয়ায় ক্রেতা ও ভোক্তা পর্যায়ে জাত আমের চাহিদা কমে যাচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ফল গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারাও। তারা বলছেন, এ বছর আবহাওয়ার চরম প্রতিকূলতা ও বৈপরীত্যের কারণে আমের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

প্রতি বছর গাছ থেকে পরিপক্ব আম পাড়ার ৩ দিনের মধ্যেই আমের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে। ধারণ করত লাল-হলুদ বর্ণ। আম হয়ে উঠত তুলতুলে নরম। আমের নরম ফাইবার মুখে দিলেই গলে যেতে। কিন্তু এ বছর তা হচ্ছে না। আম পাকার এ বৈপরীত্য গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে চাষী থেকে শুরু করে বাগান মালিক ও চালানি ব্যবসায়ীদের। গুণগতমানে অন্যান্য জাতের আম কিনেও এ বছর এমন বিড়ম্বনায় পড়ছেন ক্রেতা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন বলেন, এ বছর আমের ওপর দিয়ে নানা বিপর্যয় যাচ্ছে। এর কারণ আবহাওয়ার চরম বৈপরীত্য। আম বড় হওয়া শুরু হয় এপ্রিল থেকে। ঠিক সেই সময় থেকে রাজশাহী অঞ্চলে ঘনঘন ঝড় বৃষ্টি চলছেই। আমের ফাইবার বা ভেতরের আঁশ পুষ্ট হওয়া থেকে আমের ভেতর ও বাইরে রঙ ধরার জন্য পর্যাপ্ত সূর্যকিরণ, ঝলমলে রৌদ্রতাপ আর কিছুটা শুষ্কতার প্রয়োজন। কিন্তু এ বছর রাজশাহী অঞ্চলে সেই আবহাওয়া এখনও নেই।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষী ও বাগান মালিকরা জানান, আমের গুণগতমান রক্ষা ও কেমিক্যালমুক্ত আম বাজারজাত নিশ্চিত করতে গত কয়েক বছর ধরে জেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন জাতের আম পাড়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়ে আসছে। প্রশাসনের বেঁধে দেয়া সময়ের আগে রাজশাহী অঞ্চলের আম প্রধান চার জেলায় কেউ আম পাড়তে পারে না। গত ৩ বছরে গাছে আম পেকে পড়ে গেলেও কেউ সেই আম প্রশাসনের নির্দেশিত সময়ের আগে বাজারে নামাতে পারেনি। চাষীরা এ বছরও সেইভাবে আম পাড়ার প্রস্তুতি নেয় করোনার মধ্যেও। কিন্তু আম পাড়া ও পাকা নিয়ে এ বছর নানান বিড়ম্বনায় পড়েছেন চাষী ও বাগান মালিকরা।

রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছি গ্রামের আমচাষী সোলেমান সরদার, মোহনপুরের চাষী মোকিম বিশ্বাস, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহারাজপুর গ্রামের চাষী এজাবুল হক জানিয়েছেন, প্রশাসন গত ১৫ মে গুটিসহ দেশি আঁটিজাতের আম পাড়ার সময় দিয়েছিল। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, এসব আম পুষ্ট হতে ২ জুন পর্যন্ত সময় লেগেছে। প্রতি বছর যেভাবে পাকা আম গাছেই রঙিন হয়ে উঠে তা এ বছর কোথাও দেখা যায়নি। এমনতি নির্ধারিত সময়ের ১৬ দিন পর আম পেড়ে আরও ৭ দিন ঘরে রাখার পরও আমে রঙ আসেনি। আম নরম হয়নি বা পাকা আমের যে সুঘ্রাণ ছড়ায়, তাও পাওয়া যায়নি। উপরন্তু গোপালভোগ, ন্যাংড়া ও ক্ষিরসাপাতের মতো অতি মিষ্টি আমের ভেতরে মিলছে পোকা।

চাষীরা বলছেন, সর্বশেষ রোববার পর্যন্ত রাজশাহী অঞ্চলের মোকামে গোপালভোগের পর নেমেছে ক্ষিরসাপাত বা হিমসাগর এবং ন্যাংড়া আম। ক্ষিরসাপাত শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পর ন্যাংড়া পাকা শুরু হয়। আমের রাজা ফজলি ও আম্রপালি জাতের আম ১৫ জুন থেকে বাজারে আসার কথা থাকলেও এসব আম আরও কয়েকদিন পর আসবে বলে জানিয়েছেন পবার ধর্মহাটার চাষী মোমিনুল। তিনি বলেছেন, আমরা যদিও পুষ্ট আম গাছ থেকে পাড়ছি কিন্তু ৭ দিন পরও আম পাকছে না। আমে রঙ নেই, ঘ্রাণও নেই। স্বাদ-গন্ধ বলতে কিছু নেই। এ সময়ে আমের ঘ্রাণ আচ্ছন্ন করে পথচারীদের। এ বছর এসব কিছুই নেই কোনো আমে। আমরা কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।

আমচাষী ফখরুল ইসলাম বলেন, বাড়িতে খাওয়ার জন্য ৪ দিন আগে কিছু ক্ষিরসাপাত আম নিয়ে যাই। কিন্তু রোববার পর্যন্ত একটা আমও পাকেনি। টিপে দেখি সব শক্ত। দীর্ঘ ৫০ বছরেও আমি আমের এমন বৈপরীত্য দেখিনি। আর ক্ষিরসাপাত বা হিমসাগর ও ন্যাংড়া আমে কোনোকালে পোকা ধরে না বলে জানতাম। এ বছর এসব আমের ভেতরেও পোকা পাওয়া যাচ্ছে।

এ বছর আম পাড়া ও আমের সহজাত স্বাদ-গন্ধহীনতা ছাড়াও জাত আমে পোকা থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন বলেন, এপ্রিল ও মে মাসে প্রয়োজনীয় ঝলমলে রৌদ্রতাপ আর কিছুটা শুষ্ক আবহাওয়ায় গাছে দ্রুত আম পেকে যায়। আমে রঙ ধরে। কিন্তু এ মধ্য জুনেও ঘন ঘন বৃষ্টির ফলে আম পাকতে পারছে না। আমচাষীরা পুষ্ট আম গাছ থেকে নামানোর ৭ দিন পরও আমে ঘ্রাণ মিলছে না। ভেতরের ফাইবারও নরম হচ্ছে না। তিনি বলেন, ক্ষিরসাপাত বা হিমসাগর ও ল্যাংড়া আমে পোকার আক্রমণ সাধারণত হয় না। কিন্তু এ বছর তাও ঘটেছে।

তিনি আরো জানান, ঘন ঘন বৃষ্টি আর অধিক আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে আমের শরীর ভিজে থাকছে অধিকাংশ সময়। মাছি পোকা নামে যে পোকাটি আমকে আক্রমণ করে সেটি এ কারণেই সহজেই ছোট ফুটা করে আমের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ফলে প্রায় প্রতিটা আমের গায়ে কালো দাগ পাওয়া যাচ্ছে। আর আমের ফাইবারকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ড. আলিম আরও বলেন, এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার দুটি পথের একটি হল- আমকে ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দেয়া যাতে পোকা ঢুকতে না পারে আর দ্বিতীয়টি হল হট ওয়াটার প্ল্যান্টের মাধ্যমে আমকে ভাপ দিয়ে নরম করা। তবে প্রাকৃতিক বিড়ম্বনা এড়ানো কঠিন বলে মনে করেন তিনি।


শর্টলিংকঃ