করোনা যুদ্ধেও বৈষম্যে সাংবাদিকরা


বলা হচ্ছে,স্বাস্থ্যকর্মী,আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য এবং সাংবাদিকরা করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত আছেন।তাঁরা এই যুদ্ধে প্রথমসারির সৈনিক।ইতোমধ্যে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের জন্য বিশেষ সম্মানী ও বিমা বাবদ ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।এ ছাড়াও তিনি মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মাচারি,আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য,সশস্ত্রবাহিনী ও বিজিবি সদস্যসহ প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ বিশেষ ইন্সুরেন্স এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদানের কথা বলেছেন।

১৩ এপ্রিল জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি এসব ঘোষণা দেন।এইদিন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে প্রথম সারিতে যুদ্ধরত সাংবাদিকদের ভাগ্যে জুটেছে শুধু “ধন্যবাদ”।পুলিশবাহিনীর সদস্যদের বিশেষ ভাতা বা ঝুঁকি ভাতাসহ সব ধরনের ভাতা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে সরকার।সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি আদেশ গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।কিন্তু সাংবাদিকদের ভাগ্যে শুধুই ফাঁকাবুলি।স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী,তথ্যমন্ত্রী এবং বিভিন্ন মিডিয়ার মালিকপক্ষ একবাক্যে স্বীকার করছেন কিন্তু বাস্তবায়ন নেই।

সাংবাদিকদের ভাগ্যে চিরকাল জুটে এসেছে অবহেলা,অবহেলা আর অবহেলা।সর্বেক্ষেত্রেই তারা বৈষম্যের শিকার,নিগৃহিত।কী মালিকপক্ষের কাছে কী সরকারপক্ষের কাছে।এই মুহূর্তেও তাঁরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।কী অপরাধ তাঁদের?তাঁরা সবার সুখ-দুঃখের কথা বলে কিন্তু নিজেদের কষ্টের কথা বলতে পারে না,তাই! তাতে তাঁদের কোনো দুঃখ নেই।যুদ্ধ মোকাবিলায় তাঁরা কাউকে পরোয়া করে না।তাদের নিজের হাতে যা আছে,তাই নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছে।শুধু মুখে মাস্ক দিয়েই অসীম সাহসিকতার সাথে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

উপজেলা পর্যায়ের অনেক সাংবাদিক মাথায় পলিথিন দিয়েও কাজ করেছেন।তাঁরা মন ও আত্মার মুক্তির জন্য দেহকে কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করেই আনন্দ পান।তাঁদের উদ্দেশ্য হচ্ছে,সত্যের প্রতি প্রকৃত নিষ্ঠা প্রদর্শন,জনসাধারণের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে সরকারকে এবং দেশের আইন-কানুন সম্বন্ধে জনগণকে অবহিত করা।দুর্বার তাঁদের গতি।জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তাঁদের দায়িত্ব পালনে কখনো পিছপা হননি,ভবিষ্যতেও হবেন না।

একেবারে সামনের কাতারের যোদ্ধা বলে প্রধানমন্ত্রী এখন যাদের প্রশংসা করে ৮৫০ কোটি টাকার বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছেন,সেইসব চিকিৎসাকর্মীদের শর্তারোপের কারণে একসময় প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।এখনো প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় তাদের অনীহা,অবহেলার খবর পাওয়া যাচ্ছে।কিন্তু সাংবাদিকরা একেবারে প্রথম থেকেই কারো দিকে না চেয়ে, কোনো শর্তারোপ ছাড়াই পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকে কোনো অতিরিক্ত অর্থ বা প্রণোদনা ব্যতিরেকেই ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে একাদিক্রমে সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতির খবরা-খবর সরকারকে,জনগণকে জানিয়ে যাচ্ছেন।

পরিবার-পরিজনের কথা চিন্তা না করে,পদে পদে বিপদ জেনেও সবকিছু ভুলে কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে গভীর মমত্ববোধ নিয়ে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন করোনা জয়ের নেশায়।জনগণকে ঘরে থাকতে বলে নিজেরা বাইরে থাকার ঘোষণা দিয়ে আইন-শৃংখলাবাহিনীর পাশাপাশি সাংবাদিকরাও সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন।অনেক সাংবাদিক করোনাতে আক্রান্তও হয়েছেন।তাতেও তাঁরা মনোবল হারাননি।

সাংবাদিকদের চূড়ান্ত দায়বদ্ধতা সমাজের কাছে,মানুষের কাছে।মানবতার কল্যাণে জনমত সৃষ্টি করাই তাঁদের ব্রত।সমাজ ও মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য সাংবাদিকরা আত্মসমর্পিত,অকৃতদার।নানা ঘাত-প্রতিঘাত,বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে সামাজিক নীতি-নির্ধারণে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন।নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা,দুর্নীতি,স্বজনপ্রীতি,জ্ঞান-বিজ্ঞান,আবিষ্কার,যুদ্ধ-বিগ্রহ,প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ হাজারো বিষয় যথাযথ কর্তৃপক্ষ এবং জনগণের কাছে তুলে ধরে সমাজের অবিরাম সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।

অথচ সরকার এবং মালিকপক্ষের কাছে তার বিনিময়ে তাঁরা পাচ্ছেন অবহেলা আর অবিবেচকসূলভ আচরণ।এই করোনা যুদ্ধের সময় চিকিৎসা থেকে শুরু করে ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি ,নানা অনিয়ম,অব্যবস্থাপনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে সঠিক অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য সরকারকে এবং জনগণকে কী তারা সাহায্য করছে না?রোম সাম্রাজ্য কেনো টিকে থাকতে পারেনি? তার একটিমাত্র কারণ হলো,সেখানে কোনো সংবাদপত্র ছিল না।

সংবাদপত্র না থাকার কারণে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা মানুষের কাছে কেন্দ্রীয় শাসকদের মতিগতি জানাবার কোনও উপায় ছিল না। সাংবাদিকদের জাতির বিবেক বলা হয়।তারা রাষ্ট্রের চতুর্থ সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত।বাক স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায়,সাংবিধানিক নিয়ম-নীতি সমন্বিত মৌলিক বিষয়গুলি সঠিকভাবে রূপায়িত করার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা সাংবাদিকদের প্রধান কাজ।

ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার একদা পরিচালন সম্পাদক জেমস রাসেন উইগিনস বলেছেন,“সভ্যতা বলতে আমরা যা বুঝি তা বাঁচত না,যদি সংবাদ প্রচারের ব্যবস্থা না থাকতো।সংবাদ ছাড়া সমাজের বাসিন্দারা সেই সমতাবোধ থেকে বঞ্চিত হত,যা না থাকলে আনুষ্ঠানিক বা রীতিবহির্ভূত কোন আইন তৈরি করা সম্ভব নয়।এইসব দৃষ্টিকোণ থেকেই বোদ্ধাজনরা বলেছেন,“যে রাষ্ট্র বা সমাজ সাংবাদিকদের মূল্যায়ন করতে জানে না,সেই সমাজ কখনো আলোর মুখ দেখতে পারে না”।

লেখক : গোলাম সারওয়ার , সাবেক সভাপতি, রাজশাহী প্রেসক্লাব


শর্টলিংকঃ