গণমানুষের স্বপ্ন ও সংগ্রামের ইশতেহার


জাহিদ আকতার:

আমাদের সময়ে একদিকে যেমন ইতিহাসে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, অন্যদিকে তেমন ইতিহাস-সত্তার প্রচলিত ধারণার আমূল পুনর্গঠন চলছে। প্রতিষ্ঠানের ছায়াতলে সনদপ্রাপ্ত ঐতিহাসিকের অতীতের আনুষ্ঠানিক বয়ানই মূলত বা একমাত্র ইতিহাস—এ ধারণা আজ জোর প্রশ্নবিদ্ধ। ইতিহাস যেহেতু ঘটনাপঞ্জির গাণিতিক সমাহার নয় এবং তা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে রচিত হয় না এবং ইতিহাস যেহেতু অনিবার্যভাবে ভাষার আশ্রয়ে আকার পায়, ইতিহাস তাই সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিক হতে বাধ্য। ইতিহাস তাই ফিকটিশাস।

কিন্তু ইতিহাসতত্ত্বের এ পাঠ মিথ, কবিতা, উপন্যাস ও আনুষ্ঠানিক ইতিহাসকে ঐতিহাসিকতার বিচারে সব বিভাজন ভেঙে দিয়ে হুড়মুড় করে এক কাতারে এনে নামায়। ইতিহাসের এ বহুরূপিতায় ইতিহাসের ওপর আমাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দাবি কি আড়ষ্ট হবে? আমরা কি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আমাদের ইতিহাস সৃষ্টিতে, বয়ানে ও প্রতিষ্ঠায় নিরস্ত হব? মোটেই নয়।

সত্য যেহেতু সংস্কৃতিনিরপেক্ষ নয়, যেহেতু নির্ভেজালভাবে সত্যের জোরে ইতিহাস হয়ে ওঠে না এবং যেহেতু শেষ পর্যন্ত কেনো ইতিহাস ওই সময়ে রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী ইতিহাস, সেহেতু আমাদের কর্তব্য হলো নিজেদের ইতিহাস চিহ্নিত করে বা প্রয়োজনে রচনা করে তা প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর সংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। বর্তমান সময়ের সংকটের বিচারে নিজেদের ইতিহাস অন্বেষণে, বয়ানে ও প্রতিষ্ঠায় আমরা চোখ রাখতে পারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’য়ে। এ উপন্যাসের মাধ্যমে আমরা আবার উঁচিয়ে ধরতে পারি ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে খেটেখাওয়া মানুষের সেইসব স্বপ্ন ও সংগ্রামকে, যা ধারণ করে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল বাংলাদেশ।

সন্দেহ নেই, ‘চিলেকোঠার সেপাই’ প্রথমত একটি উপন্যাস। কিন্তু পাছে ইলিয়াসের এ কাজকে উপন্যাসের সুনির্দিষ্ট কুঠুরীতে চালান করে দিয়ে এর ঐতিহাসকতাকে, এর রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে ম্লান করা হয়, সে জন্য উপরিউক্ত বক্তব্যের অবতারণা। প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, উপন্যাসকে গণমানুষের সংগ্রামের সঙ্গী হতে গেলে তাকে কি সব সময় ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক হয়ে উঠতে হয়? এর উত্তর হলো, অবশ্যই ‘হ্যাঁ’।

কারণ অরাজনৈতিক ও অনৈতিহাসিক উপন্যাস বলতে কিছু নেই। কিন্তু তা বলে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকতার বিচারে সব উপন্যাস নিমেষে এক কাতারে এসে দাঁড়ায় না। সামনে এসে দাঁড়ায় সেই সব উপন্যাস, যা সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে লক্ষ্য করে রচিত হয় এবং প্রয়োজনে যা ইতিহাসকে ব্যবহার করে। অর্থাত্, সেই সব উপন্যাস যা প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক। উল্লেখ করা যেতে পারে, গণবিচ্ছিন্ন ‘শিল্প-ভুকেরা’ এ ধরনের উপন্যাস সম্পর্কে সহজাত ঔদাসীন্য প্রকাশ করে থাকেন।

প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে সামনে রেখে একটি উপন্যাস রচনা করে তাকে উপন্যাস হিসেবে সফল করে তোলার দৃষ্টান্ত দুনিয়াতে বেশি নেই। সন্দেহ নেই, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসে ব্যক্তি তীব্রভাবে রাজনৈতিক এবং তা আমাদেরকে উদ্দীপিত করে। কিন্তু এ উপন্যাসে ব্যক্তি মনোগঠনের গভীরে এবং জীবনযাপনের নানান সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্তরে রাজনীতির উপস্থিতি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’র আপাত-বিস্তৃত ক্যানভাসে জায়গা করে নেওয়া মুহূর্মুহু বায়বীয় রাজনৈতিক প্রতর্কে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র বাস্তবের অংশ হয়ে উঠতে পারে না। এ রকম উপন্যাসের ফিরিস্তি কম হলেও অনুপস্থিত নয় এবং এ প্রসঙ্গে যেসব ঔপন্যাসিকদের নাম দ্রুত আমাদের মনে উঠে আসে, তাঁরা হলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও মহাশ্বেতা দেবী।

প্রথমেই প্রবন্ধের শিরোনামের দিকে চোখ রেখে দু-একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। এক. ইলিয়াস যখন চিলেকোঠার সেপাই লিখছেন, তখন তিনি ‘ক্যান দ্য সাবঅলটার্ন স্পিক’-এ স্পিভাক উত্থাপিত হাইপেনেটেট রেপ্রিজেনটেশন বা উত্থাপন অর্থে ঊনসত্তরের গণমানুষের সংগ্রামের ছবি আঁকছেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে গণমানুষের লড়াইয়ের প্রতিনিধি হয়ে উঠছেন না।

সন্দেহ নেই যে, যে মাধ্যমে ইলিয়াস গণমানুষের সংগ্রামের ছবি আঁকছেন অর্থাত্ উপন্যাস, তা এখন পর্যন্ত গণমানুষের জীবনচর্চার অংশ হয়ে ওঠেনি। ফলে ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই সীমাবদ্ধ থাকছে মধ্যবিত্তের মধ্যে। গণমানুষের রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি না হয়ে নিজ শ্রেণীর কাছে গণমানুষের স্বপ্ন ও সংগ্রামের ছবি তুলে ধরে তিনি তাদের মুক্তির আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করছেন। এ প্রবন্ধের শিরোনামে রূপক অর্থে ব্যবহূত ‘ইশতেহার’ তাই গণমানুষের জন্য দাঁড় করানো মধ্যবিত্তের ‘ইশতেহার’ নয়; বরং মধ্যবিত্তের উপলব্ধির জন্য মধ্যবিত্ত-উত্থাপিত ‘ইশতেহার’, যা চিলেকোঠার সেপাইয়ের রাজনৈতিক তাত্পর্যের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে।

দুই. চিলেকোঠার সেপাই একটি উপন্যাস এবং মতাদর্শ নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব উপন্যাসই কোনো না কোনো মতাদর্শের আওতায় থেকে ক্রিয়াশীল থাকে। চিলেকোঠার সেপাই এর ব্যত্যয় নয়। এ প্রসঙ্গে শিল্প ও মতাদর্শ নিয়ে আন্দ্রে দাস পারেকে লেখা লুই আলথুসারের সেই বিখ্যাত চিঠির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আলথুসার লিখছেন, ‘শিল্প আমাদের দেখায় কীভাবে মতাদর্শ থেকে শিল্প জন্ম নেয় এবং অপরিহার্যভাবে তা মতাদর্শ দ্বারা স্নাত হয়। শিল্প মতাদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে মতাদর্শের দিকেই ইঙ্গিত ছুড়ে দেয়।’ চিলেকোঠার সেপাইয়ের এ মতাদর্শিক ইঙ্গিতকে এ প্রবন্ধের মূল বিষয়বস্তু করে তোলা হয়েছে।

এবার প্রশ্ন হতে পারে, চিলেকোঠার সেপাই গণমানুষের কোন স্বপ্ন ও সংগ্রামকে ধারণ করে? আঞ্চলিক বৈষম্য, নিপীড়ন, আর বর্বরতার সূত্র ধরে এটা কি শুধু আমাদের স্বাধিকারের প্রশ্নকে সামনে আনে? জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সব রসদ কি এখানে জাতীয় আন্দোলনের আপাত গন্তব্য তথা শাসক পরিবর্তনের মধ্যে খোঁজা হয়? এ প্রেক্ষিতে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে সব স্তরের জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও এর ব্যাপ্তির দিকে।

ইলিয়াস দেখান, এর আগে জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের যে আন্দোলনগুলো হয়েছে, যেমন—তেভাগা, হাজং কিংবা সাঁওতাল বিদ্রোহ—সেগুলো নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। গণ-অথ্যুত্থানের মতো দেশব্যাপী জাগরণ তুলতে পারেনি। ইলিয়াস প্রশ্ন তোলেন, দেশজুড়ে জেগে ওঠা গণমানুষের এ আন্দোলন শুধু মসনদে বিজাতীয় শাসক পাল্টে দেশি শাসক বসানোর জন্য কি না। আনোয়ারের মুখে শুনি, ‘ভাষা, কালচার, চাকরি-বাকরিতে সমান অধিকার, আর্মিতে মেজর জেনারেলের পদ পাওয়া—এসব ভদ্রলোকের প্রব্লেম। এই ভোটের রাইট পাওয়ার জন্যে মানুষের এতবড় আপসার্জ হতে পারে?’ (ইলিয়াস সমগ্র-২, পৃষ্ঠা-৩৮)

আর এত বড় ‘আপসার্জে’ আমরা মূলত কাদের দেখি? ইলিয়াস দেখান, সেখানে থাকে গওসল আজম স্যু ফ্যাক্টরির কর্মীরা, বস্তি থেকে টুটাফাটা কাঁথা, বেঢপ কোট ও রঙ-জলা জামা গায়ে বেরিয়ে আসা মানুষের দল, পাঁচঘাট লেনের শামসুদ্দীনের রুটির কারখানার লোকজন, হূষিকেশ দাস রোডের গ্যারেজ থেকে আসা রিকশাওয়ালার দল—এমনি আরও অগণন খেটে খাওয়া মানুষের দল।

ইলিয়াস প্রশ্ন তোলেন, যাদের ত্যাগে মূলত এ অভ্যুত্থান দানা বাঁধে (উপন্যাসের শুরুতে তালেব) এবং পরিণতির দিকে এগোয় (শেষের দিকে খিজির), এ আন্দোলনের সুফল শেষ পর্যন্ত সেই সব খেটেখাওয়া মানুষেরা পাবে কি না। জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের সমান্তরালে তিনি দৃষ্টি দেন বিদ্যমান সমাজের অন্তর্গত কাঠামোর দিকে, চক্রাকারে উত্থাপন করেন এ সমাজব্যবস্থার প্রধান দ্বন্দ্বিকতা; শ্রমিক ও মালিক, ধর্ম ও সমাজ এবং সামরিকতন্ত্র ও গণতন্ত্র; যে দ্বান্দ্বিকতার দুঃসহ ভূত আজও আমাদের ওপর জেঁকে বসে আছে।

এ কথা সত্যি যে, জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অকুণ্ঠ ও অবিচল। জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে তিনি অভিভূত এবং এ আন্দোলনের প্রতি তাঁর জোর নৈতিক ও আবেগিক আস্থা প্রকাশ সুস্পষ্ট। এর পরও তিনি এ আন্দোলনের চরিত্রে ও গন্তব্যে বারবার গভীর দৃষ্টি দেওয়ার পক্ষে। আনোয়ার আর আলতাফের কথোপকথনে আনোয়ারের নিম্নোক্ত উক্তি আমাদের দৃষ্টি কাড়ে, ‘কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের ভাত-কাপড়ের কোনো গ্যারান্টি তো তোমরা দিচ্ছো না।

অটোনমি অটোনমি করে পাকিস্তান হয়েছে। তোমাদের অটোনমিতে বাঙালি সিএসপি প্রোমোশন পাবে, বাঙালি মেজর সায়েব মেজর জেনারেল হবে, বাঙালি আদমজী ইস্পাহানী হবে। তাতে বাঙালি চাষার লাভ কী? ডিপার্টমেন্ট ভাগাভাগি করে মানুষের ইম্যানসিপেশন হয়? তাহলে ওয়াপদা, পিআইডিসি, রেলওয়েজ ভাগ করে আইয়ুব খান বাঙালির ইম্যানসিপেশনে হেলো্প করেছে?’ (রচনাসমগ্র-২, পৃষ্ঠা-৮০)

ইলিয়াস শুধু ইম্যানসিপেসনের প্রশ্ন তুলেই ক্ষান্ত হয় না। গণমানুষের মুক্তির সফল অভিযানের লক্ষ্যে নেতৃত্বের তথা প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নকে সামনে আনে। জনগণের মুক্তির জন্য বড় ঘরের উচ্চশিক্ষিত মানুষের নেতৃত্ব অপরিহার্য কি না তা বোঝা যায়, যখন আনোয়ার বিদেশি শাসক ও দেশি সুবিধাবাদী উচ্চবিত্তদের অভিন্ন স্বার্থের দিকে ইঙ্গিত করে, ‘কিন্তু বড়ো ঘরের মানুষদের যদি বিদেশি শাসকরা পোষে, তাহলে এই দুইয়ের স্বার্থ যদি এক হয় তাহলে বড়ো ঘরের শিক্ষিত মানুষ বিদ্রোহীদের সঙ্গে আসবে কেন?’ (রচনাসমগ্র-২ পৃষ্ঠা-১৪৫)

প্রতিনিধিত্বের এ প্রশ্নের উত্তর পরোক্ষভাবেও দেন ইলিয়াস। আলিবক্সের নেতৃত্বে গ্রামে যখন খয়বার গাজীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, আনোয়ারের মতো সমমনা ও তত্পর রাজনৈতিক কর্মীকেও আগন্তুকের ভূমিকা নিতে বাধ্য হতে হয়। শুধু শিক্ষা নয়, প্রতিনিধিত্বের জন্য মানুষের জীবনসংগ্রামের সঙ্গী হতে হয় তাকে।

শ্রেণীশোষণের মধ্যে আটকে যাওয়া এ সমাজব্যবস্থার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে ইলিয়াস যুগপত্ভাবে উত্থাপন করেন, কীভাবে এ সমাজকাঠামোয় বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী রাজনৈতিক ক্ষমতা লুণ্ঠনের অপপ্রয়াস চালায়। তিনি দেখান, কীভাবে মনিব নিজ স্বার্থে নিপুণভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে। খিজিরকে উদ্দেশ্য করে মহাজন রহমাতুল্লার বক্রোক্তি, ‘অ্যাগো আবার নামাজ। ঈমান নাই, অ্যাগো আল্লা-রসুলের ডর আছে?’ (পৃষ্ঠা-৫৫) একই সঙ্গে ইলিয়াস দেখান, কীভাবে মিলিটারিরা অর্থনৈতিক ফায়দা লোটার পাশাপাশি রাষ্ট্রের টুটিও টিপে ধরে। হাড্ডি খিজিরের প্রশ্ন, ‘মিলিটারির মায়ের বাপ রাস্তা আগো জমিন্দারি। চুতমারানিরা দালান ইমারত ব্যাকটি কজ্জা করছে। রাস্তা ভি দখল করবো?’ (রচনাসমগ্র-২, পৃষ্ঠা-৩২৪)

আনোয়ার ও খিজিরের নিপীড়ন, বর্বরতা ও সম্পদের এ ন্যায্য হিসাবের প্রশ্নে ইলিয়াসের কলমে ধরা পড়ে ৬৯-এ আন্দোলনরত জনগণের স্পষ্ট মুক্তির আকাঙ্ক্ষার কথা, যা নিঃসন্দেহে একাত্তরেও জাজ্জ্বল্যমান ছিল। জনগণের এ সার্বিক মুক্তির কথা মাথায় রেখে ইলিয়াস এমন একটি সমাজব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরেন, যে ব্যবস্থা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরন্ন মানুষের স্বার্থের কথা ভুলে যায় না, যে ব্যবস্থা ধর্মীয় মৌলবাদী সামরিক শক্তির ছোবলে বারবার আক্রান্ত হয় না। ইলিয়াস দেখান, কীভাবে সেই স্বপ্নের সমাজ একটি সত্যিকার পরিবর্তনকারী রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়; কীভাবে একটি অকৃত্রিম আন্দোলন জনগণের বেহাত হয়।

এ রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে আমরা দেখি, মধ্যস্বত্বভোগী সুবিধাবাদীরা শুধু যে আন্দোলনের ফসল নিজেদের ঘরে তুলে নেওয়ার পাঁয়তারা করে, তা নয়। তারা সময় বুঝে ভোল পাল্টে আন্দোলনকেই দখল করে ফেলে। দেখি, একদিকে কীভাবে গ্রামে গণবিরোধী আফসার গাজীরা আন্দোলনের সামনের সারিতে চলে আসে, অন্যদিকে কীভাবে শহরে একসময়ের আন্দোলন-বিরোধী মহাজনদের ‘কৌশলগত’ কারণে আন্দোলনের পক্ষে টানা হয়। ইলিয়াস-উত্থাপিত তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্গত একটি দেশের বেহাত গণ-আন্দোলনের প্রতিধ্বনি আমরা শুনি ফ্যানো, গ্রামসি ও অ্যাডওয়ার্ড সাইয়িদের কণ্ঠস্বরে।

এবার আসা যাক রাজনীতি ও ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ ধারণ করে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাস হিসেবে কোথায় অবস্থান করে, সে বিচারে। আমাদের সংস্কৃতিতে শিল্পের বিদ্যমান প্রকাশভঙ্গির প্রকরণে চিলেকোঠার সেপাইকে উপন্যাসের তকমা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। শেষপর্যন্ত তাকে উপন্যাসশিল্পে শক্তি নিয়ে উজ্জীবিত রাখতে হবে গণমানুষের স্বপ্ন ও সংগ্রামকে। সে জন্য দেখা দরকার ইতিহাস আর রাজনীতির উজ্জ্বল আলোয় ব্যক্তি ঢাকা পড়ে চিলেকোঠার সেপাই নিছক রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা হয়ে ওঠে কি না; শিল্প হিসেবে মুষড়ে পড়ে কি না। সে নিরিখে উপন্যাসটিতে একটু উঁকি দেওয়া যাক।

এ উপন্যাসের শুরুতে রঞ্জুর স্বপ্নের মধ্যে পড়তে হয়, মৃত্যুদৃশ্য আর তার যন্ত্রণাদায়ক উত্থাপনে আমাদের অস্বস্তিতে হাঁশফাশ করতে হয়। রঞ্জু জেগে ওঠে তার অচেতনে, মনের গভীরে। কিন্তু রঞ্জু জেগে ওঠায় আমরা কোনো রোমান্টিকতার নরম, নীল জগতে প্রবেশ করি না, আমরা জেগে উঠি চিলেকোঠায়, রঞ্জুর বাথরুম-বিহীন নিঃসঙ্গ কক্ষে, যা উলম্ব বরাবর ভূতলের বাস্তবতা থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচুতে নয় বরং তার মধ্যে জেঁকে বসে আছে। স্বপ্নে ওসমান যে মৃত্যুদৃশ্য দেখে, অব্যবহিত পরে তা-ই ঘটতে দেখা যায়—তালেব মারা যায়।

পরে জানা যায় সে মিছিলে গুলি খেয়ে শহীদ হয়। ক্রমে বাইরের গণআন্দোলন ও প্রতিদিন অনিশ্চয়তার মুখে ঝাঁপিয়ে পড়া সংগ্রামরত মানুষের খবর পাওয়া যায়। ওসমানের স্বপ্ন আর ব্যাখাতীত, ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে দেখা যায় না; বরং তা ব্যক্তি-অনুভূতির গভীরে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের অনিবার্য প্রচ্ছায়া হিসেবে প্রতিভাত হয়। তারপর একে একে সামনে এসে দাঁড়ায় রহমতুল্লাহ, আলাউদ্দিন, আলতাফ, আনোয়ার, খিজির, শওকত, রঞ্জু, রানু, জালাল মাস্টার, চেংটু, আলিবক্স, করমালিসহ আরও অনেকে। এদের সবার চেতনে-অচেতনে, স্বপ্নে ও সংগ্রামে এবং আকাঙ্ক্ষায় নিবিড়ভাবে মিশে থাকে সে সময়ের রাজনৈতিক সংগ্রাম।

তাকে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে ও ওপর-নিচে চাপানো মনে হয় না। লেখক কর্তৃক ব্যক্তিকে রাজনৈতিক করে তোলার প্রয়াস মনে হয় না। মানুষের গল্প পড়তে গিয়ে আমাদের স্বাভাবিকভাবে তার ইতিহাস, রাজনীতি, স্বপ্ন ও সংগ্রামের মধ্যে পড়তে হয়। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, ইতিহাস ও রাজনীতির সীমানা ভেঙে একাকার করে দিয়ে চিলেকোঠার সেপাই হয়ে ওঠে প্রখর জীবনবাদী শিল্প।

এ শিল্পে ব্যক্তির মুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ওসমান আসে আর ব্যক্তির মুক্তি অন্যের মুক্তি ছাড়া সম্ভব নয়, তাই খিজির আসে, আনোয়ারের মুক্তিকামী স্বপ্নের সাথে এক ঝটকায় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় চেংটু, আলিবক্স ও করমালির মুক্তির প্রশ্ন। বহুস্বর আর বিবিধ স্বপ্নে মুখর হয়ে ওঠে চিলেকোঠার সেপাই। বিভেদ-বৈষম্য ভেঙে তারা নেমে আসে সংগ্রাম আর স্বপ্নের সমভূমিতে। ওসমান বিবৃত হয়, বিবৃত হয় খিজির ও আনোয়ার।

স্থানের অসাম্যও ভেঙে যায়, শহরের সমান্তরালে গ্রাম হয়ে ওঠে রাজনীতির নিয়ামক শক্তি। গ্রাম ও শহরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো বিচ্ছিন্ন ও বিযুক্ত থেকে ক্রিয়াশীল থাকে না বরং তারা একে অপরের পরিপূরক হয়ে পরস্পরকে জিইয়ে রাখে। একদিকে গ্রামীণ জোতদার ও মহাজনরা কৃষক নিষ্পেষণ, সম্পদ লুণ্ঠন ও রক্ষায় শহরে বসবাসরত কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যবহার করে, অন্যদিকে শহরের নেতারা গ্রামে শ্রেণীমিত্র গড়ে তুলে নিজেদের অর্থের জোগান অটুট রাখে। গ্রামীণ জোতদার খয়বার গাজীর ভূমি-প্রহরীর জবানে এর প্রমাণ মেলে, ‘খয়বার গাজীর কাছে লোক পাঠানো হয়েছে, এমএনএ সাহেবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। গবরমেন্টের খোঁয়াড়-এর লাভের ভাগ মন্ত্রী গবর্নর ভোগ করে। (উপন্যাস সমগ্র-২, পৃষ্ঠা-২০৫)

স্বর ও স্থানের বহুত্বের বাখতিনিয়ান সমাবেশ ইলিয়াসের উত্তরাধুনিক প্রবণতার ছাপ নয় বরং তাঁর গণতান্ত্রিক সংবেদনের ঔপন্যাসিক প্রকাশ। ইলিয়াসেরও নায়ক-ভাবনা থাকে আর তা আবর্তিত হয় সংগ্রামী মানুষকে কেন্দ্রে রেখে; থাকে স্পষ্ট, দ্বিধাহীন মেটান্যারেটিভ-জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে গণমানুষের অনিবার্য মুক্তির প্রশ্ন। আনোয়ার, ওসমান, খিজির ও রহমতউল্লাহরা যুগপত্ভাবে জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিরাজ করে উপন্যাসজুড়ে। শুধু চরিত্রের মগজে প্রবেশ করে ক্ষান্ত হন না ইলিয়াস, তিনি তাদের পাকস্থলীর মধ্যেও প্রবেশ করেন। মিছিলে হাঁটার সময় আমরা যেমন প্রবেশ করি ওসমানের চিন্তায়, তেমনি জানতে পারি, কখন তার তেষ্টা পায়, ক্ষিদেয় পেট চিনচিন করে এবং বমি আসে।

কিন্তু শুধু ব্যক্তিচরিত্র খুঁড়ে ইলিয়াস নিঃশেষিত হন না; ব্যক্তিকে দেখেন সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির মধ্যে ফেলে। কারণ ব্যক্তি নিজেই তো একটি রাজনৈতিক বর্গ। ব্যক্তির সেই আমোঘ রাজনৈতিক সত্তা, সম্পূর্ণ আড়াল করে তার অন্তর্লোকের নিগুঢ় সৌন্দর্য সন্ধানে সদা ব্যাপৃত থেকে ‘বিশুদ্ধ’ শিল্পচর্চায় মগ্ন লেখকদের ভিড়ে উপন্যাস আজ ভারাক্রান্ত। এ প্রসঙ্গে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতি, জয়েস, উলফ, পাউন্ড, কামুসহ অনেক নাম চলে আসে।

এ ধারার বিপরীতে ব্যক্তিকে জ্বলজ্বলে, প্রত্যক্ষ রাজনীতির মধ্যে ফেলে উপন্যাস লেখার দুঃসাহস দেখান ইলিয়াস, হাঁটেন অপেক্ষাকৃত অচেনা রাস্তায়, ইতিহাসে যেখানে ভ্রমণসঙ্গী নজরুল, মানিক, ডিকেন্স ও দস্তয়েভস্কি আর সমকালে মার্কেজ ও পামুক। চর্যাপদের ঐতিহ্য বেয়ে আবির্ভূত ইলিয়াস শিল্পের ভোজসভায় আত্মকেন্দ্রিক ভাবালুতার পরিবর্তে আপামর মানুষের স্বপ্ন ও সংগ্রামকে নিয়ে হাজির থাকেন। শিল্পের রসবিলাসী, সৌন্দর্যকাতর ও প্রতাপশালী অনটোলজি প্রত্যাখ্যান করে দাঁড় করান পাল্টা অনটোলজি যা প্রাচ্যের জন্য—তৃতীয় বিশ্বের একটি মুক্তিকামী দেশের জন্য—গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু তাই বলে ইলিয়াস নিরবচ্ছিন্নভাবে পাশ্চাত্য-বিরোধী নন, আধুনিকতাবাদের সব ফসল তিনি অবলীলায় প্রত্যাখ্যানও করেন না। আধুনিকতাবাদের কাছ থেকে উপন্যাস নিয়ে তিনি মুখ ফেরান নিজ বাসভূমির দিকে, উপন্যাসকে ব্যবহার করেন নিজের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কাজে। ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্জিত ঐশ্বর্য আর স্থিরতার কল্যাণে পাশ্চাত্যের মূলধারার আধুনিক তাত্ত্বিক ও সাহিত্যিকেরা শিল্পবিলাসের যে দৃষ্টান্ত রাখেন, ইলিয়াস তা প্রত্যাখ্যান করেন।

একই সঙ্গে নিজের অবস্থানের সাথে সঙ্গতি রেখে ইলিয়াস বিদ্রোহ করেন ভাষায়। কলকাতার বাবু বাংলার ঔরসে জন্ম নিয়ে বর্তমানে জারি থাকা ভদ্রলোকি গদ্য ছুড়ে ফেলে তিনি কান পাতেন বস্তি, রিক্সা গ্যারেজ ও রেললাইনে। মার্কসীয় অনুপ্রেরণায় শব্দে শব্দ ঘষে আগুন জ্বালান ইলিয়াস।

উল্লেখ্য, জনগণের সার্বিক মুক্তির প্রশ্নে সোচ্চার ইলিয়াসও দুর্বলতার বাইরে অবস্থান নেন না। তিনি যে গণসংগ্রামের ছবি আঁকেন, তাতে নারীর অংশগ্রহণের চিত্র পাওয়া যায় না। জুম্মনের মা, খিজিরের মায়ের মাধ্যমে শ্রেণীসংগ্রামে জর্জরিত নারীর দেখা পাওয়া গেলেও আন্দোলনে নারীর সম্পৃক্তির প্রশ্নে ইলিয়াস আশ্চর্যজনকভাবে নীরব থাকেন। মিছিলে গুলি খেয়ে তালেবের মৃত্যু, তার বোন রানুর মনে গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে কোনো প্রশ্নের জন্ম দেয় কি না, ইলিয়াস তা জানার প্রয়োজন বোধ করেন না।

রানু আমাদের মনে আর পাঁচটা রোমান্টিক উপন্যাসের আটপৌরে চরিত্রের মতো শুধু ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে। একইভাবে আমরা জানতে পারি না খিজিরের রাত করে বাড়ি ফেরা নিয়ে জুম্মনের মায়ের মনে গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঁকি দেয় কি না। ইলিয়াস-উত্থাপিত গ্রাম ও শহর পুরুষে পুরুষে সয়লাব হয়ে যায়, নারীর তেমন দেখা মেলে না।

চিলেকোঠার সেপাইয়ের শেষে এসে ওসমানকে আর চেনা যায় না। সে হারিয়ে যায় শহরের গলিতে। বোঝা যায়, গ্রামে ফিরে করমালি হারাবে আফসার গাজীর রাজত্বে, ব্যক্তিগত জীবনযুদ্ধে শহরে ক্রমাগত ক্লান্ত হয়ে হারাবে আনোয়ার, তাকে আর আলাদা করে চেনা যাবে না। সমবেত বিস্মৃতির কবলে পড়ে হারাবে খিজির ও তালেব।

এভাবে আমরা প্রবেশ করি ইতিহাসের এক বিশেষ অন্ধকার নৈঃশব্দ্যে। কিন্তু সে নৈঃশব্দ্যে সমর্পিত হতে কলম ধরেন না ইলিয়াস; বরং অনিঃশেষ ইতিহাসে গণমানুষের স্বপ্ন ও সংগ্রামকে নতুন সময়ে পৌঁছে দিতে আবির্ভূত হয় চিলেকোঠার সেপাই। এর ধারাবাহিকতায় আমাদের সময়ে তাই চিলেকোঠার সেপাইয়ের মাধ্যমে ভাস্বর থাকে গণমানুষের স্বপ্ন ও সংগ্রামের ইশতেহার।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কবিতা

এলেমজির জন্য শোক

আমার এলএমজি, এলএমজি, এলেমজি আজ

কোথায় গিয়েছ তুমি? কতোদূর, বলো কোন লোকে

নিরুদ্দেশ যাত্রা করো? শীতল শরীরে রক্তশিখা

জ্বেলে দাও অন্ধকারে, ব্রাশ করো কোন সেক্টরে?

তোমার ট্রিগারে কার কিশোর তর্জনী টানে গান,

পূর্বজন্ম, মৃত্যু, সাধ? সুপ্তশিশ্ন ব্যারেলের কাম

এমবুশ করে কার রক্তে? তুমি কার অধিকারে?

এলেমজি, তুমি ছিলে হাত জোড়া, বুক জুড়ে, বুক ভরে ছিলে।

তুমি ছিলে, ক্রোধ ছিলো; প্রতিহিংসা ছিলো; হূিপণ্ডে

ঘৃণা; বাঁচবার নির্লজ্জ স্পৃহা। যাবার বেলায়

মহারাজ, ঠান্ডা ঠোঁটে শুষে নিলে সব, তুমিই তো

একদিন দিয়েছিলে। তুমি নাই, প্রতিহিংসা নাই;

ঘৃণা নাই; তুমি নাই, ক্রোধশূন্য বুক আজ ফাঁকা।

হূিপণ্ড নিদারুণ খালি, বুক নাই, চাঁদে চাঁদ

নাই। স্পৃহাশূন্য হাতে কেউ এসে গুঁজে দেবে—নাই।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র-৩ থেকে


শর্টলিংকঃ